সুমিতা চৌধুরী
তুতুলদের বাড়ির ছাদে বিশ্বকর্মা পুজোর ঘুড়ি ওড়ানোর হুল্লোড় লেগে গেছে। বাড়ির বাবা-কাকারা থেকে তুতুল, তুতুলের দাদা আর ওদের বন্ধুরা সবাই মিলে এক হইহই কাণ্ড। ঘন-ঘন ভোঁকাট্টার সোল্লাসে কান পাতা দায়।
হঠাৎই তুতুল লক্ষ্য করে তাদের একটা কাটা ঘুড়িকে ধরতে পাগলের মতো ছুটছে মনসুফ, যে ওদের বাড়িতে নিয়মিত ডিম, মাংস, এইসব দিতে আসে, বাবা-কাকারা বললেই। আজ পুজোর দিন বলে কথা, তাই মনসুফ, বাবার কথায় মাংস দিতেই এসেছিল। খুব শান্ত মনসুফকে কেউ কখনো এরকম হঠকারিতা করতে দেখেনি। তুতুল, তাই কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ থেকে, তারপর হুঁশে ফিরে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, ‘মনসু…ফ, সরে যা…ও। লরি আসছে…।’ ততক্ষণে তুতুলের বাবা, কাকাদেরও নজর গেছে মনসুফের প্রতি, তুতুলের বলা কথাকে অনুসরণ করে। সত্যিই মনসুফ উদভ্রান্তের মতো তাঁদেরই একটা কাটা ঘুড়ির পিছনে বড়ো রাস্তা অবধি ছুটে চলে গেছে। আর তার সামনেই একটি লরি আসছে ঠিক উল্টোদিক থেকেই।
সবাই দুদ্দাড়িয়ে ছুটে যতক্ষণে মনসুফকে বাঁচাতে বড়ো রাস্তায় পৌঁছেছে, ততক্ষণে ওঁদের সমবেত চিৎকারকে অনুসরণ করেই, একজন ট্রাফিক কনেস্টবল ক্ষিপ্রতার সঙ্গে হাত দেখিয়ে লরিটাই শুধু নয়, আশেপাশের সব গাড়িকেই আটকে দিয়েছেন। নাহলে সত্যিই আজ বোধহয় মনসুফের জীবন সংশয়ই হতো। কিন্তু এতো কিছুর মধ্যেও মনসুফের যেন কোনো হুঁশ নেই। সে ততক্ষণে ঘুড়িটা ধরতে গিয়ে খোয়া রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে, চারদিকে কেটেকুটে একশা। কিন্তু মুখে তার বিজয়ের হাসি, কারণ, ততক্ষণে তার হাতের মুঠোয় ধরা পড়েছে ঘুড়িটা।
সবাই উত্তেজনার বশে মনসুফকে ধরে তুলেই ভীষণ বকাবকি শুরু করেছে, ভয়ে আতঙ্কে, এমনকি কনেস্টবলও। কিন্তু মনসুফ নির্বিকার। সে তখনো হাসছে, ঘুড়িটাকে যত্নে ধরে। সবাই একটাই কথা তাকে বলছে, বোঝাচ্ছেন যে, সে তো ঘুড়ি চাইলেই পারতো, এরকম প্রাণ বাজি রেখে ঘুড়ির পিছনে কেউ ছোটে, কারো কথা না শুনে? শেষ পর্যন্ত মনসুফ হাসি মুখে বলল, ‘তুতুলদা, আমি ঘুড়ি ওড়াতে পারি না। আমি ঘুড়ির জন্য ছুটিওনি। এটা যে ঘুড়ি নয় শুধু, এটা যে আমার দেশের পতাকা। তাকে কীকরে রাস্তায় সবার পায়ের নীচে, গাড়ির নীচে পড়তে দিই বলো? তাই ওকে বাঁচাতেই ছুটেছিলাম। তখন আর কিছুই মনে ছিল না। সরি গো, আমার জন্য তোমাদের সবার হয়রানি হলো। আমি ঠিক আছি। এই নাও ঘুড়িটা। পারলে, এটা আর উড়িও না, যত্ন করে রেখে দিও।’ এতক্ষণে মনসুফের কথায় সবার ঘুড়িটার দিকে নজর গেল। সত্যিই তো ওর হাতে ধরা ঘুড়িটা ভারতের পতাকার নক্সাতেই তৈরি। স্বাধীনতা দিবসের কিছু ঘুড়ি রয়ে গিয়েছিল, সেগুলোও সামিল হয়েছিল আজ বিশ্বকর্মা পুজোর ঘুড়ি উৎসবে।
যে কথা কারুর মনে আসেনি, শত শিক্ষিত হয়েও, সে কথা মনসুফ তার মনের শিক্ষায় জীবনে আত্মস্থ করেছে। শুধু তাই নয়, কী সুন্দরভাবে সেই শিক্ষা দিয়ে গেল সে আজ সবাইকে! তুতুল এগিয়ে এসে মনসুফকেই সেই ঘুড়িটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘এটা তুমিই রাখো মনসুফ। এর প্রকৃত সম্মান, যত্ন তুমিই করতে পারবে।’
মনসুফ মুখ আলো করা হাসি ছড়িয়ে, ঘুড়িটাকে বুকে চেপে ধরে নিজের পথে পা বাড়াল; নিজের জীবন বাজি রেখে, নিজের দেশের সম্মানকে অক্ষুণ্ণ রাখার গর্ব তথা আনন্দকে বুকে নিয়ে।