• facebook
  • twitter
Sunday, 16 March, 2025

অপেক্ষা

—‘‘কে? মাসিমা না অদিতি?’’

কাল্পনিক চিত্র

সুপ্রিয় দেবরায়

সময়টা এই রোদ এই মেঘ-এর সময়। কয়েকদিন ধরে একটানা ঝরিয়ে সম্ভবত বৃষ্টিরও একঘেয়ে লাগছে, ক্লান্তি এসেছে তার শরীরেও। তেজ, দাপট সবই কমে এসেছে। তাও দুপুর থেকে এই রোদ তো এই ছায়া। বৃষ্টি ফুরনো মেঘ কখনও ঘোরে দুলকি চালে, আবার অনেকসময় থাকে তাড়াহুড়োয়। এক নিমেষে উধাও হয়ে দেখা দেয় নীল আকাশ। এই যেমন এইমাত্র পুত্রবধূ মল্লিকা তার পাঁচ বছরের কন্যা মিকুকে স্কুলের হোমওয়ার্ক করাতে করাতে এক ছুটে দৌড়ে যায় রান্নাঘরে। প্রেসার কুকারের তিনটে হুইস্‌ল্-এর আওয়াজ শুনে। দুপুরবেলায় খাওয়ার সময় বলেছিল, আজ বিকেলে ঘুগনি করবে। আমার পছন্দের। খুব সম্ভবত কুকারে মটর সিদ্ধ বসিয়েছে। দুপুর থেকে ঝিরিঝিরি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিটা যেটা ক্রমাগত হয়েই চলেছিল, এখন স্তিমিত। অদিতিকে জানাই, “বৃষ্টিটা ধরেছে মনে হচ্ছে। এই ফাঁকে একবার শিশিরের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”

—‘‘ছাতাটা নিয়ে যেও। সন্ধের মধ্যেই ফিরবে কিন্তু। বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মশগুল হয়ে আবার আমাদেরকে ভুলে যেও না যেন! বউমা তোমার জন্যই বিশেষ করে ঘুগনি বানাচ্ছে। শিশির আর পর্ণাকে সামনের রবিবারে আসতে বোলো। সকাল-সকাল। সারাদিন থেকে বিকেলে যাবে। ভুলবে না কিন্তু বলতে।’’

পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, নাতনি মন দিয়ে হোমওয়ার্ক করছে। ছাতা বগলে নিয়ে আস্তে করে যেই সদর দরজার ল্যাচ খুলেছি, বউমা রান্নাঘর থেকে একছুটে এসে বলে, “বাবা সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসবেন কিন্তু। আপনার ছেলেও অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে জানিয়েছে। একসঙ্গে সবাই মিলে ঘুগনি খাব।”

শিশির আমার কৈশোর-বন্ধু। সেই স্কটিশ চার্চ কলেজে যখন থেকে পড়ি। কিছুদিন আমরা একই ব্যাঙ্কে কাজ করেছি। তারপর সে ভালো চাকরির অফার পেয়ে চলে যায় দিল্লি। তবে আমাদের বন্ধুত্বে কোনোদিন ছেদ পড়েনি। দিল্লিতে বাড়ি কিনলেও এক-দু’বছর অন্তর সে ঘুরে যায় তার হাতিবাগানের পৈতৃক বাড়িতে। শিশিরের বিয়েও অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই হাতিবাগানের বাড়িতেই। পৈতৃক বাড়িটি এখন সংস্কার করে দ্বিতল, শিশিরের দু’ভাই তাদের পরিবার নিয়ে থাকে দোতলায়। শিশিরের জন্যও একটি ঘর নির্দিষ্ট। এক বোন, বিয়ে হয়ে গেলেও তার জন্য রাখা আছে একটি আলাদা ঘর। উৎসব-পার্বণে সবাই একসঙ্গে মিলিত হলে বাড়িটা হৈ-হট্টগোলে মুখরিত হয়ে ওঠে। আমি আর অদিতিও অনেকবার এদের এই পারিবারিক উৎসবে যোগদান করেছি। ফিরে পেয়েছি নিজের ছেলেবেলা, কৈশোর, যৌবনকে। একতলায় বসার ঘর, রান্নার ঘর ছাড়াও বিরাট করে বানানো একটি খাওয়ার জায়গা। সবাই একসাথে আজও সেই বিশাল ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করে। ভালো লাগে যে এখনও যৌথ পরিবারের ধারণা, বিশ্বাস সবার অনুভূতির থেকে বিলোপ
হয়ে যায়নি।

আমরা দু’জনেই কয়েক বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছি। শিশির দিন পনেরো আগে কলকাতায় এসেই খবর দিয়েছিল। এবার অনেকদিন পর এসেছে। প্রায় বছর ছয়েক। জানিয়েছিল এবার মাস দুয়েক থাকবে। তাই এই অবিরাম বর্ষণে গড়িমসি করছিলাম। ইচ্ছে থাকলেও অদিতি, বউমা আটকে দিচ্ছিল। অদিতিকে নিয়েই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। তবে এই আপাত মনে হওয়া বৃষ্টি ফুরনো মেঘকে বিশ্বাস নেই। কখন আবার আকাশ কালো করে ঝরঝরিয়ে নামে। কিছুদিন হলো অদিতি হাঁটুর ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। অস্টিওআর্থ্রাইটিসের প্রাথমিক অবস্থা। ফিজিওথেরাপি চলছে। অদিতি নিজেই যেতে রাজি হল না এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে।

গ্রিল দিয়ে ঘেরা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আমরা দুই বন্ধু। পর্ণা মাঝে মাঝে এসে যোগদান করছে। ঝিরিঝিরি আর্দ্র বাতাস বইছে। পর্ণার হাতে বানানো গরম গরম পেঁয়াজের পকোড়া এবং চায়ের আমেজে আর পুরনো স্মৃতির জাবর কাটার রেশে সময় যে অনেকটা বয়ে গেছে, বুঝতে পারি যখন দেখি একে একে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। এক লাফ দিয়ে উঠে বলি, “এখনই আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। আর শোন, আগামী রবিবার তুই আর পর্ণা আমাদের বাড়িতে আসবি। অদিতির হুকুম।”

—‘‘কিন্তু তুই কেন ফিরবি এখন! কতদিন পর দেখা হল আমাদের। কী সুন্দর ফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে। ঠাণ্ডা না হলেও, মনোরম। এইসময় একটু গ্লাস নিয়ে না বসলে হয়!’’
— ‘‘না রে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। রবিবারে তো আসছিস তোরা, সেইদিন হবে।’’
—‘‘এখনও কি তোর জন্য তোর বউমা অপেক্ষায় থাকবে? আগেরবারে তো তাই বলেছিলি।’’
কোনও উত্তর না দিয়ে, এক চিলতে রহস্যময় হাসি দিয়ে বেরিয়ে আসি।

কর্মসূত্রে বাবার পোস্টিং বনগাঁ অঞ্চলে। থাকতাম আমরা ভাশানপোতা গ্রামে। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে কিছুদিন ট্রেনেই যাতায়াত করতাম। বাবার উপদেশে ট্রেন জার্নির ধকল এড়াতে বিবেকানন্দ রোডে দাদু-ঠাম্মির বাড়িতে এসে থাকা শুরু করলাম। সেদিন ছিল আকাশজুড়ে সোনাঝরা রোদের উজ্জ্বল কণা। দিনটি ছিল আমার জন্মদিন। কলেজে বেরবার মুহূর্তে ঠাম্মি বললেন, ক্লাস শেষেই যেন বাড়ি ফিরে আসি। আমার জন্য পায়েস বানিয়ে রাখবেন। কলেজে এসে পৌঁছতেই শিশির বলে, কলেজ শেষে অনাদি কেবিনে মোগলাই পরোটা খাওয়াতে হবে। শিশিরকে আমি আগেই জানিয়েছিলাম আমার জন্মদিনের তারিখটি। আমি তখন বলি, “নারে, আজ হবে না। ঠাম্মি পায়েস বানিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।”

—‘‘ঠিক আছে। লাস্ট দু’টো ক্লাস বাঙ্ক মেরে দে।’’
আমতা আমতা করে বলি, “আমি চাই না কেবি’র ক্লাস মিস করতে। আজ ছেড়ে দে।”
—‘‘ঝামেলায় ফেললি তো তুই! ভাবলাম আজ কসা মাংস দিয়ে মোগলাই খাব। সব ভেস্তে দিলি!’’
একটু বিমর্ষ মনেই শিশির ওর ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একমুখ হাসি নিয়ে বলে, “তোর ঠাম্মির হাতে বানানো পায়েসই আমার ভাগ্যে আজ লেখা আছে।”

আমি আর শিশির বিকেলে বাড়ির উঠোনে পৌঁছে দেখি ঠাম্মি বারান্দায় মেঝেতে বসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমোচ্ছেন, সামনে দুই পা মেলে দিয়ে। শুধু পায়েস নয়, তার সাথে মুড়ি আর নারকেলের নাড়ু। শিশির সেদিন যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, “ভাগ্যিস আমরা অনাদি কেবিন যাইনি। এতো সুস্বাদু পায়েস আর নারকেলের নাড়ু এর আগে কোনওদিন খাইনি। ঠাম্মি যেন রোজ তোর জন্য অপেক্ষা করেন, কিছু না কিছু বানিয়ে।”

দেখতে দেখতে বছর দেড়েক কেটে যায়। শিশিরের সঙ্গে বন্ধুত্বটা আরও নিবিড় হয়েছে। অনেকবার এরমধ্যে শিশিরের বাড়ি আমি গেলেও, শিশিরের আর আমার দাদু-ঠাম্মির বাড়ি আসা হয়ে ওঠেনি। কারণ কিছুটা আমার কলেজ শেষেই বাড়ি চলে আসা। আর শিশির তখন আড্ডা দিতে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিংবা সিনেমা দেখতে যেত। একদিন কলেজ থেকে একটু আগে বেরিয়ে শিশির আমাকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে নিয়ে আসে। চিকেন কাটলেট আর চায়ের অর্ডার দিয়েছি। হঠাৎ হাসির কলকলানিতে তাকিয়ে দেখি তিন সুন্দর প্রজাপতির প্রবেশ। মুখোমুখি বসে আমরা। শিশিরের চোখে পড়েনি। একজন এগিয়ে এসে শিশিরের পিঠে আলতো করে চাটি মেরে বলে, “কলেজ পালিয়ে এখানে আড্ডা মারা হচ্ছে!” শিশির নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে বলে, “আরে, পর্ণা তোমরা! তোমরাও তো ক্লাস ডুব মেরে এসেছ!”

—‘‘না মশাই, আমরা ক্লাস করেই এসেছি। তোমাদের মতো এক ঘন্টা আগে আসিনি। আমরা এখানে বসতে পারি?’’
বুঝতে পারলাম, শিশিরের সঙ্গে আগেই এদের পরিচয় আছে। কথোপকথনে জানতে পারলাম পর্ণা, অদিতি আর সঙ্গিতা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে। আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। আমাকে বারবার রিষ্টওয়াচের দিকে তাকাতে দেখে শিশির জিজ্ঞেস করে, “বাড়ি ফিরতে হবে? ঠাম্মি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন।”

—‘‘ঠাম্মি ছয় মাস আগে মারা গেছেন। দাদু ভীষণ একা হয়ে গেছেন। তাই মা এখন গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন। মা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।’’
—‘‘খারাপ লাগছে ঠাম্মির কথা শুনে। তবে শোন, একদিন দেরি হলে কিছু হবে না। এই রকম মনোরম পরিবেশ, আড্ডা ছেড়ে চলে যাবি! আর একটু থেকে যা।’’
—‘‘না রে, মা ঠাম্মির মতোই বারান্দায় বসে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
এইসময় দেখতে পাই অদিতির দু’চোখের তারায় দুষ্টুমি হাসির ঝিলিক। “ও-মা, দেখেছিস তোরা! এর যে এখনও দুধের দাঁত পড়েনি রে! মায়ের আঁচল ধরা শিশু।” তারপর আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে, “বিয়ে করে তাহলে কী করবেন? পাড়ায় পাড়ায় সেই যে তারের ওপর বারের খেলা দেখায়, শূন্যে বাঁধা দড়ির ওপর হাতে একটি বাঁশ নিয়ে ব্যালান্স দেখাতে দেখাতে ক্রমশ হেঁটে যাওয়া— দেখেছেন নিশ্চয়ই! আপনিও কি সেই ব্যালান্স খেলা খেলবেন?”

দু’কান দিয়ে তখন গরম হাওয়ার হলকা বেরচ্ছে। নাকের পাটা ফুলে গেছে। বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তার উপরে, বেশ বুঝতে পারছি। বড্ড ডেঁপো মেয়ে তো! তার মধ্যে পর্ণা আবার সূচ ফোটায়, কাঁটা ঘায়ে নুন ছিটানোর মতো, “যদি দুই চুম্বক আবার সমমেরুর হয়, ফলস্বরুপ
চিঁড়ে-চ্যাপটা হয়ে যাবেন অথবা বিকর্ষণে ছিটকে পড়বেন।” তার সঙ্গে তুমুল হাসির রোল। এমতাবস্থায় শিশিরের হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাঝেই কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আসি।

অবশ্য শিশিরের কেরামতিতেই আমাকে আর অদিতিকে এরপর দেখা যায় কলেজ পালিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটে, নৌকাবিহারে কিংবা সিনেমা হলে।

মাস্টার্স করার পরে, ভাগ্যচক্রে আমার আর শিশিরের শুধু একই ব্যাঙ্ক নয় একই ব্রাঞ্চে চাকরি হয়। এর মধ্যে দাদু গত হয়েছেন। দাদু-ঠাম্মির বাড়িটি পুরনো হয়ে গিয়েছিল। সংস্কারের জন্য অনেকটাই টাকার দরকার। বাবা সেরকম বড় কোনও চাকরি করতেন না। সঞ্চয় নামমাত্র ছিল। বাবা অবসর গ্রহণ করার পর ওই বাড়ি বিক্রি করে ফুলবাগানে একটি একতলার বাড়ি কেনেন। এর মধ্যে অদিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। বাবা-মায়েরও পছন্দ। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ঠিক সেইসময় শিশির এসে জানায়, ও দিল্লি চলে যাচ্ছে। একটা ভালো চাকরির অফার পেয়েছে। এতদিনের বন্ধুত্ব— মনটা একটু খারাপ হলেও, বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠি শিশিরের জন্য। মাইনে প্রায় দ্বিগুণ। কিছুটা শিশিরের জন্যই, এক মাসের মধ্যেই বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলা হয়। শিশির একবার দিল্লি গেলে, সহজে ছুটি নিয়ে আসতে পারবে না। বৌভাতের দিন অদিতির কানে ফিসফিস করে বলে, “এবার থেকে খোকাকে সামলানোর পালা তোমার।” অদিতি প্রথমে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেও, একটু পরেই চোখের দুই ভুরু উপরে তুলে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে।

প্রায় এক বছর পর এক বিকেলে শিশির আমার ব্যাঙ্কে এসে উপস্থিত। গতকাল নাকি দিল্লি থেকে দু’মাসের ছুটিতে এসেছে। কিছুদিন আগে জানিয়েছিল, পর্ণার সঙ্গে বিয়েটা এবার সেরে ফেলতে হবে। সেই জন্যই বোধহয় এসেছে। ব্যাঙ্কে এসেই বলে, “চল পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে কোথাও বসি।” আমি বলি, “না রে, সাতটার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে যাবে।”

—‘‘কে? মাসিমা না অদিতি?’’
আমি চুপ করে থাকি। শিশির বলে ওঠে, “আমি জানি, অদিতি সেরকম মেয়ে নয়। তুই একবার ফোন করে বল, আমি এসেছি। আমরা দুই বন্ধু কিছুটা সময় একান্তে কাটাবো। নইলে তো তোদের বাড়িই চলে যেতে পারতাম। কত কথা জমে আছে। চিঠিতে কি সব লেখা যায়!”

—‘‘জানিস শিশির, অদিতি বলে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের মাঝে একটা করিডোর দরকার। আধিপত্যবোধ বা অহংবোধ কিংবা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোনওভাবেই কাম্য নয়। তাই আজ ও মানা করবে না। তবে আমি অফিসে বেরবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে যখন পিছনে তাকাই, দেখতে পাই অদিতিকে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে। মনে হয় সে দাঁড়িয়ে থাকে আমার ছায়াটা যতক্ষণ পর্যন্ত মুছে না যায় তার মনের গহিন থেকে। অফিস থেকে ফেরার সময়ও দেখতে পাই অদিতিকে সেই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। মাঝে মাঝে ভাবি, সকাল থেকেই কি অদিতি ওখানে অপেক্ষা করছে!”

আজ থেকে বছর ছয়েক আগে যখন শিশির দিল্লি থেকে ছুটিতে এসেছিল, গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। সন্ধে হলেই যেই উঠব উঠব করছি, এবার পর্ণা বলে ওঠে, “কতো গভীর প্রেম তোমাদের। অদিতির জন্য এখনও মন তোমার উতলা। দরজার কপাট ধরে কিংবা জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে তোমার অপেক্ষায় সে কষ্ট করে বারবার ঘড়ির দিকে দেখবে।”

—‘‘না পর্ণা। এবার পুত্রবধূ মল্লিকা। বেরবার সময়ে রোজ বলে দেয়, রাতে সবাই একসঙ্গে খাবে। যদি কোনওদিন যেমন বছর শেষে অফিসের কাজে একটু দেরি হয়, শাশুড়ি-মাকে খাইয়ে দেয়। ছেলের ইচ্ছে হলে খেয়ে নেয়। কিন্তু বউমা আমার জন্য বসে থাকে। খায় না।’’

শিশিরের বাড়ি থেকে একটা ক্যাব ধরেছি, তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য। বৃষ্টির জন্য বিগত কয়েকদিন ধরে বিকেলে নাতনি অপেক্ষা-কে নিয়ে পাড়ার পার্কে আর যাওয়া হয়ে উঠছে না। ঘরে অবশ্য সবাই অপেক্ষা-কে আদর করে মিকু বলে ডাকে। হোমওয়ার্ক করেই রোজ নাতনি আমার আঙুল ধরে বলে, “দাদাই চলো এবার পার্কে।” এখন বিগত কয়েকদিন ধরে নাতনিকে নিয়ে লুডো খেলছি। নাতনি আমার সঙ্গেই শুধু লুডো খেলে, আর কারুর সঙ্গে নয়। আমার সঙ্গে খেললে যে সে জিততে পারে। কোনওদিন যদি প্রায় জেতার মুখে এসে পড়লেও, পাকা গুটিটাকে আবার কাঁচা করে দিই। লোহার গেটটা খুলে বাগানে প্রবেশ করতেই দেখতে পাই ছোট ছোট মুঠিতে জানলার গ্রিল ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আমার নাতনি, অপেক্ষা। গাল বেয়ে অশ্রুধারা শুকিয়ে আছে। স্পষ্ট শুনতে পাই কানে, “এতো দেরি করলে, দাদাই— তুমি খুব দুষ্টু। আমি আর কথা বলবো না তোমার সঙ্গে।”