চণ্ডীচরণ দাস
কিছুই ভাল লাগছে না পিকলুর৷ দৌড়ে দৌড়ে স্কুল যাওয়া নেই, ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গে কান-চুল ধরে টানাটানি নেই, টিফিন চুরি করে খাওয়া নেই, স্যারের ধমকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কান ধরে ‘স্ট্যাণ্ড আপন দি বেঞ্চ’ হওয়া নেই, স্কুলের পাশে কান্তদার দোকান থেকে চানাচুর লজেন্স কিনে বন্ধুদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি নেই, স্কুল থেকে ফেরার পথে ধাড়ার বেড়ে গাছে ঢিল মেরে আম পাড়া নেই, বিকেলে পোড়োর মাঠে বল পিটিয়ে কাদামাখা প্যান্টে ঘরে এসে মায়ের কঞ্চি নিয়ে খেদানো নেই— কোনো কিছুই নেই৷ দিনগুলো বড্ড জোলো একঘেয়ে হয়ে গেছে, কিচ্ছু ভাল লাগে না পিকলুর৷
কাঁহাতক আর ঘরের মধ্যে শুকনো বইগুলো খুলে বসে থাকা যায়? সেদিন পড়ে উঠে গামছায় মুড়ি আর একটা পেঁয়াজ নিয়ে পিকলু বেরিয়ে পড়ল৷ পুকুরপাড়ে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল গাছের ডালে দু’টো ঘুঘু পাখি পাশাপাশি বসে পরস্পরের দিকে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে হুম হুম করে তালে তালে ডেকে চলেছে৷ কাটা অর্জুন গাছটার গোড়াটায় ঠ্যাঙ ছড়িয়ে বসে পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে পিকলু ঘুঘু দুটোর খেলা দেখতে লাগল৷
হঠাৎ খড়গাদাটার পিছন থেকে ‘কুঁইকুঁই’ শব্দ শুনে পিকলু উঠে গিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল, কিন্তু কিছুই নজরে এল না৷ কিছুক্ষণ পরে আবার আওয়াজটা কানে আসতে গাদার নীচে নুয়ে দেখে একটা কুকুরের মত জন্তু, শুয়ে শুয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে৷ কিন্তু কুকুর তো ফাঁকা জায়গায় থাকে৷ গাদার নীচে অন্ধকার ওই ঘুপসি গর্তে কেন? মুখ বাড়িয়ে ভাল করে দেখতে যেতেই জন্তুটা বেরিয়ে এসে পাশের জঙ্গলটার দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল৷ পিকলু দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল— কোথায় কুকুর? এ তো শিয়াল! মা-টা চলে যেতেই গাদার নীচে গর্তে বাচ্চাগুলো আবার ‘কুঁইকুঁই’ করে মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল৷ বোধহয় পেট ভরেনি৷ পিকলু গামছার ঝুলি থেকে দুটো মুড়ি বের করে ছুঁড়ে দিতে বাচ্চাগুলো মুখ ঘসে ঘসে খেতে লাগল৷ পিকলু দেখল কী সুন্দর দেখতে বাচ্চাগুলো, ঠিক কুকুরছানার মত, খালি মুখটা একটু সরু আর কালচে ধরনের৷ মুড়ি খাইয়ে পিকলু চলে গেল ঘাটে, একটা ভাঙা খোলায় একটু জল এনে দিতে বাচ্চাগুলো জলে মুখ দিয়ে দেখতে লাগল৷ খানিকক্ষণ তাদের রকমসকম দেখে পিকলু চলে গেল ঘরে৷
বিকেলবেলা আবার দুটো বিস্কুট জলে ভিজিয়ে নিয়ে পিকলু চলে গেল পুকুরধারে খড় গাদাটার কাছে৷ মুখ বাড়িয়ে দেখল শিয়ালটা নেই৷ মুখে চুকচুক আওয়াজ করতেই বাচাগুলো নড়েচড়ে উঠল। বিস্কুট মুখের কাছে বাড়িয়ে দিতে খেতে লাগল৷ পিকলু মনের আনন্দে দেখতে লাগল তাদের খাওয়া।
এইভাবে কাটল কয়েকটা দিন৷ পিকলুবাবু এখন খুব ব্যস্ত৷ ঘুম থেকে উঠেই দাঁত মাজতে মাজতে একবার দৌড়ে চলে যায় গাদাটার পিছনে, আবার বেলা হলে পড়ে উঠেই মাকে লুকিয়ে কখনো একটু মুড়ি, কখনো বা দুটো বিস্কুট নিয়ে বাচ্চাগুলোকে দিয়ে আসে৷ বসে বসে দেখে তাদের খাওয়া, দেখে তারা কত বড় হল৷ বাচ্চাগুলোও পিকলুকে বেশ চিনে গেছে৷ তাকে দেখতে পেলেই ‘কুঁইকুঁই’ করতে করতে এগিয়ে আসে৷
ওদিকে মা তাকে যখন-তখন পুকুরপাড়ে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখে আশ্চর্য হয়৷ বকাবকি করে— পড়াশোনা নেই, কাজকম্ম নেই, খালি বাঙবেল্যার মত বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো! কখনো বা চান করার জন্যে ডেকে ডেকে শেষে দুষ্টুটাকে পুকুরপাড়ে ঘুরতে দেখে কঞ্চি নিয়ে তেড়ে যায়৷ পিকলু এক ছুটে পালিয়ে যায়, কিন্তু তার পুকুরধারে গাদার কাছে যাওয়া বন্ধ হয় না৷
একদিন সকালবেলা হঠাৎ পুকুরপাড়ের দিক থেকে কুকুরের চেঁচামেচি শুনে পিকলু দৌড়ে গিয়ে দেখে পাড়ার দুটো কুকুর খড়-গাদাটার তলায় ঝুঁকে ঝুঁকে তেড়ে যাচ্ছে আর ঘেউঘেউ করে ডেকে চলেছে৷ পিকলুর বুকটা ধক্ করে উঠল৷ এক্ষুনি না কুকুর দুটো বাচ্চাগুলোকে কামড়ে মেরে ফেলে৷ সামনে শুকনো জ্বালানি ডালের কাঁড় থেকে একটা বাঁশের ডগালি তুলে নিয়ে তাড়া করল কুকুরগুলোকে৷ পালিয়ে যেতে পিকলু গাদার নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখল বাচ্চা তিনটে বড়বড় চোখ তুলে তাকে দেখছে আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে৷ বড় মায়া হল তার৷ দৌড়ে ঘরে গিয়ে দুটো বিস্কুট আর জল নিয়ে এসে তাদেরকে খেতে দিল৷
‘কী নিয়ে যাচ্ছিস রে ঘর থেকে? দেখা, দেখা আমাকে!’ মায়ের আওয়াজ শুনে পিকলু চমকে উঠল৷ দেখালেই এক্ষুনি জুটবে পিঠে মায়ের কিল৷ ‘কিছু না’ বলে এক ছুটে পালিয়ে গেল মায়ের নাগালের বাইরে৷ গাদার কাছে এসে বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে ভাবতে লাগল— কুকুরগুলো সন্ধান পেয়ে গেছে, আবার আসবে, বাচ্চাগুলোকে কামড়ে মেরে ফেলবে৷ সে আর কতক্ষণ নজরে রাখবে? তাহলে এখন কী করা যায়? কীভাবে ওদেরকে বাঁচানো যায়?
ভাবতে ভাবতে পিকলুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল৷ বিকেলবেলা মা যখন খেয়েদেয়ে একটু ঘুমিয়েছে, আস্তে আস্তে উঠে দুটো বিস্কুট, একটা ব্যাগ, আর গোচালা থেকে একটা বড় ঝুড়ি নিয়ে হাজির হল গাদার পিছনে৷ বিস্কুট দেখিয়ে ডাকতে বাচ্চাগুলো কাছে এগিয়ে এল৷ অমনি এক-এক করে বাচ্চা তিনটেকে ব্যাগে ভরে ঝুড়িটা নিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে৷ একটু ভিতরে গিয়ে একটা ঝোপের পাশে বাচ্চাগুলোকে বের করে ঝুড়িটা উপুড় করে চাপা দিয়ে রাখল৷ তারপর ‘আঃ, আঃ’ বলে মা-শিয়ালটাকে ডাকতে লাগল৷ কিন্তু অনেকক্ষণ ডেকেও শিয়ালটা এল না৷ এদিকে বাচ্চাগুলো ভয়ে ‘কুঁইকুঁই’ করে কেঁদেই চলেছে৷ পিকলু ভাবতে লাগল কী করা যায়? বোধহয় সে আছে বলে ভয়ে শিয়ালটা আসছে না৷ অমনি সে একটু দূরে গিয়ে একটা গাছে উঠে লক্ষ্য রাখতে লাগল৷
খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ পিকলু দেখে মা-শিয়ালটা আস্তে আস্তে বন থেকে বেরিয়ে এসে ঝুড়িটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে৷ পিকলুর মনটা খুশিতে নেচে উঠল৷ যাক আর বাচ্চাগুলোর বিপদ নেই, এবার মায়ের সঙ্গে চলে যাবে৷ নীচে নেমে এসে ঝুড়িটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল৷ পিছন ফিরে দেখল মা-শিয়ালটা আবার ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ বাচ্চাগুলো তারপর মায়ের সঙ্গে লাফাতে লাফাতে বনে ঢুকে গেল৷
মাথায় ঝুড়ি আর হাতে খালি ব্যাগটা নিয়ে মনের আনন্দে লাফাতে লাফাতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পুকুরধারে এসে পিকলুর হঠাৎ কী মনে হল কে জানে, খড়গাদাটার কাছে এগিয়ে গেল৷ নুয়ে পড়ে গাদার তলায় শিয়ালের খালি গর্তটার দিকে তাকিয়ে দেখছে, হঠাৎ পিঠে পড়ল কঞ্চির বাড়ি৷ চমকে উঠে পিছন ফিরে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ যমদূত৷ মা চেঁচিয়ে চলেছে, ‘ঝুড়ি ব্যাগ নিয়ে বনের মধ্যে কী করছিলি, অ্যাঁ? আমি এদিকে গরুকে ছানি দেব বলে ঝুড়ি খুঁজে খুঁজে পাই না৷ বাউণ্ডুলে ছেলে, দিন নেই রাত নেই সবসময় খালি বনেবাদাড়ে টো-টো করে ঘোরা হচ্ছে?’ বলে আবার কঞ্চি তুলতেই ঝুড়ি ব্যাগ ফেলে পিকলু দিল চোঁচা দৌড়৷
একেবারে কালাবাড়ির ধারে বাবলা গাছটার তলায় এসে দম নিল পিকলু৷ পিঠটা ভীষণ জ্বালা করছে, হাত দিয়ে ঘসতে লাগল৷ কিন্তু শিয়াল বাচ্চাগুলোর কথা মনে হতেই ভুলে গেল সব জ্বালা, পরম তৃপ্তি আর অনাবিল হাসিতে মুখটা ভরে উঠল৷