• facebook
  • twitter
Sunday, 29 December, 2024

কারুকথা এই সময়

‘মীরা মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাস্কর্যে স্বতন্ত্র রূপের বিকাশে আদিমতা থেকে প্রকৃষ্টভাবে গ্রহণ করেছিলেন।... প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ অংশ তাঁদের ভাস্কর্যে ব্যবহার করে আসছেন বিশেষ এক রূপপদ্ধতি ও ঢালাই পদ্ধতি।... সেই প্রত্নতা থেকে গ্রহণ করেছিলেন মীরা মুখোপাধ্যায়।’

প্রচ্ছদ চিত্র

সৈয়দ হাসমত জালাল

কুড়ি বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে সুদর্শন সেনশর্মা সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কারুকথা এই সময়’। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে গত অক্টোবর মাসে। প্রথমেই রয়েছে একগুচ্ছ প্রবন্ধ। চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাস্কর্য, সাহিত্য, সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধের পাশাপাশি আছে অন্য স্বাদের প্রবন্ধও।

ভারত সরকারের জাতীয় বিজ্ঞান-প্রধান পার্থপ্রতিম মজুমদারের লেখা ‘ব্যক্তিগতকৃত ওষুধ’ অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক লেখা। এটি ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। ব্যক্তিগতকৃত বা পার্সোনালাইজড ওষুধ বৈজ্ঞানিক মহলে ইদানীং খুব চর্চিত বিষয়। একই ওষুধ একই অসুখে আক্রান্ত প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একই ভাবে কাজ না-ও করতে পারে। এর কারণ, আক্রান্ত সকলের দেহের চারিত্রিক গঠন এক নয়। এই ব্যক্তিগতকৃত ওষুধের জনক হিসেবে ধরা হয় কার্ল ল্যান্ডস্টাইনারকে। ল্যান্ডস্টাইনার ও তাঁর গবেষণা নিয়ে এই লেখাটি সাধারণ মানুষের কাছেও চিন্তার নতুন খোরাক জোগাবে।

চিকিৎস বিজ্ঞান বিষয়ক আর একটি প্রবন্ধ ভারতের জনস্বাস্থ্যের পথিকৃৎ
ডা. জেমস রানাল্ড মার্টিন ও তাঁর কাজকর্ম নিয়ে। ভারতের প্রথম মেডিক্যাল কলেজ ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৩৫ সালের ২৮ জানুয়ারি। সেখানে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রথম চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ১৮৩৮ সালের ৩০ অক্টোবর। সেই চূড়ান্ত পরীক্ষার অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন ডা. জেমস রানাল্ড মার্টিন। এরকম সব আকর্ষণীয় তথ্যপূর্ণ লেখাটি লিখেছেন ডা. শঙ্কর নাথ।
শিল্প-আলোচক এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে মৃণাল ঘোষ এক শ্রদ্ধেয় নাম। শিল্প বিষয়ক তাঁর আলোচনা এবং গ্রন্থগুলি শিল্পানুরাগী যে কোনও মানুষের কাছে বিশেষ প্রাপ্তি। ‘কারুকথা এই সময়’-এর আলোচ্য সংখ্যায় তিনি একটি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। প্রবন্ধটির নাম ‘ভারতের আধুনিক ভাস্কর্যের প্রেক্ষাপটে মীরা মুখোপাধ্যায়ের অবস্থান’। মৃণাল ঘোষ জানিয়েছেন, ‘মীরা মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাস্কর্যে স্বতন্ত্র রূপের বিকাশে আদিমতা থেকে প্রকৃষ্টভাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই আদিমতা অন্য এক প্রবাহের, যার সন্ধান তাঁর আগে অন্য কেউ পাননি।… প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ অংশ তাঁদের ভাস্কর্যে ব্যবহার করে আসছেন বিশেষ এক রূপপদ্ধতি ও ঢালাই পদ্ধতি।… সেই প্রত্নতা থেকে গ্রহণ করেছিলেন মীরা মুখোপাধ্যায়। একে উত্তীর্ণ করেছিলেন আধুনিক মূল্যবোধে। প্রত্নতা বা প্রিমিটিভিজম-এর একটি বিশেষ দিককে আবিষ্কারের প্রথম কৃতিত্ব তাঁরই।’

মীরা মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন অসাধারণ ভাস্কর আজ তেমন আলোচিত নন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। ১৯৯৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন মীরা মুখোপাধ্যায়। তাঁর চিত্র ও ভাস্কর্য নিয়ে মৃণাল ঘোষের এই প্রবন্ধটি আলোচ্য পত্রিকার মর্যাদা বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে।

কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর সাহিত্য নিয়ে প্রচুর গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে। আজও হয়ে চলেছে। তারাশঙ্করের জন্ম ঔপনিবেশিক ভারতে। তিনি জীবনের প্রথম দিক থেকেই ছিলেন রাজনীতি-সচেতন মানুষ। ১৯২১ সালে গান্ধীজির অহিংস আন্দোলন তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিক কর্মী এবং তার জন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ‘সাহিত্যের পথে দেশসেবা’ এই ব্রত নিয়ে সর্বক্ষণের সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন। তারাশঙ্করের জীবন ও সাহিত্যের এই দিক নিয়ে সৈয়দ কওসর জামাল লিখেছেন প্রবন্ধ ‘তারাশঙ্করের উপন্যাসে রাজনীতি, স্বদেশ ও স্বাধীনতা আন্দোলন’।
এই প্রবন্ধ সাহিত্যপ্রেমীদের তারাশঙ্করের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে কিছুটা ভিন্নভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।

রাজেন্দ্রলাল মিত্র উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রথম পর্বের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ভারততত্ত্ববিদ। পুরাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞান। ভারতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এশিয়াটিক সোসাইটির তিনি ছিলেন প্রথম সভাপতি। ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন বহু প্রবন্ধ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই রাজেন্দ্রলালকে নিয়ে এই পত্রিকায় ‘রাজেন্দ্রলাল এবং তাঁর বাংলা গদ্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখেছেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে অত্যন্ত সমাদৃত ও শ্রদ্ধেয় একটি নাম জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুবতারা এই শিল্পীকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ ‘জ্ঞানবিভাসিত সঙ্গীতচেতনা’ লিখেছেন শুভময় দত্ত। সঙ্গীত শিক্ষার আগে তাঁর বিদ্যায়তনিক শিক্ষার বুনিয়াদটি খুব মজবুত গড়ে উঠেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি সাহিত্যে স্নাতকোত্তরে প্রথম হয়েছিলেন। এরকম এক সুচর্চিত মননের অধিকারী ছিলেন তিনি। লেখক জানিয়েছেন, কোনো সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতা তাঁর আধুনিক মননকে স্পর্শ করতে পারেনি। সঙ্গীত আর আধ্যাত্মিকতা জড়ানো যে ভাবালুতা চিরকাল গুণীমহলে প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে, জ্ঞানপ্রকাশ তা থেকে লক্ষণীয়রূপে মুক্ত ছিলেন। বিজ্ঞানসম্মত সঙ্গীতচিন্তার প্রচারে তিনি সবসময়ই ছিলেন তৎপর। প্রবন্ধটি থেকে এই কিংবদন্তী শিল্পী ও তাঁর চিন্তা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা গেল।

এখানে গল্প ও কবিতার বিভাগও কম সমৃদ্ধ নয়। গল্প লিখেছেন অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, আশিস ঘোষ, গৌর বৈরাগী, জয়া মিত্র, সুদর্শন সেনশর্মা, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, নলিনী বেরার মতো উল্লেখযোগ্য লেখকেরা। এছাড়াও আরও যাঁদের গল্প রয়েছে, তাঁরাও যথেষ্ট পরিচিত নাম। গল্পগুলিও উল্লেখ করার মতো। কবিতা লিখেছেন অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, কালীকৃষ্ণ গুহ, ধীমান চক্রবর্তী, অরণি বসু, রাহুল পুরকায়স্থ, সৈয়দ হাসমত জালাল, অঞ্জন সেনের মতো কবিরা।

বই নিয়ে আলোচনার বিভাগ ‘বইকথা’। বিভিন্ন বই নিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় আলোচনা। আলোচনা করেছেন অভিজিৎ তরফদার, কাঁকন প্রামাণিক, নন্দন দাশগুপ্ত, সুদর্শন সেনশর্মা ও বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য।

প্রচ্ছদ করেছেন পারমিতা ভৌমিক, পার্থসারথি দত্ত ও দেবাশিস সাহা। প্রচ্ছদের ছবিটি আঁকা হয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের নির্যাতিতার অনুষঙ্গে।
কারুকথা এই সময়
সম্পাদক: সুদর্শন সেনশর্মা।
মূল্য: ৪০০ টাকা।