নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়
দিনের শেষ ক্লাসটাতে কারুরই তেমন মন বসছে না। দিনগুলো আজকাল বেশ ছোট হয়ে আসছে, সন্ধে নামছে তাড়াতাড়ি, তারই জন্যে হয়তো! সেটা বুঝতে পেরেই যেন ইন্দ্রনীল স্যার পড়ানো মুলতুবি রেখে নানারকম গল্প করতে শুরু করলেন। তোমরা এখন বাড়ি ফিরে কে কী করবে থেকে শুরু করে, কার কী পড়তে ভালো লাগে, কবিতা, এডভেঞ্চারের গল্প না কি রূপকথা, কার লেখা কোন বই সবচেয়ে পছন্দের, এইসব কথাই হচ্ছিল। কথায় কথায় কীভাবে যেন ভূতের গল্পের প্রসঙ্গও এলো।
ভুত মানে সবসময়ে বানানো গল্প নয়, সত্যি ঘটনা, কৌশিক হাত পা নেড়ে, চোখ গোল গোল করে বলতে থাকলো, আমাদের এই হোস্টেলের কাছেই ভূত আছে। আমি ঠিক জানি! হেসে উঠলো ক্লাসের কেউ কেউ, অনেকেই মনে হল ঘটনাটা শুনতে চায়, ইন্দ্রনীল স্যারও উৎসুক। কৌশিক উত্তেজিতভাবে বলতে থাকে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে, তোরা বিশ্বাস না ও করতে পারিস, কিন্তু হোস্টেলে, স্কুল এরিয়ার মধ্যেই যে আমি কতো কী দেখেছি, সে তো তোরা জানিস না!
রাত্রিবেলা যদি হোস্টেলে থাকতিস, তবে বুঝতি—
—হোস্টেলে কী দেখেছ? স্যার জানতে চাইলেন।
—শুধু আমি না স্যার, কল্যাণ, চন্দন, ওরাও জানে, পূর্ণিমার কদিন পর, যেসব রাতে চাঁদ দেরিতে ওঠে, ঠিক সেইসব রাতে… চাঁদ ওঠার আগে… স্কুলে প্রাচীরের ধারে সারি সারি ওই যে আমগাছগুলো, ওর তলায় পরীরা খেলা করতে আসে। গান গায়, নাচে; সেই ঘুঙুরের শব্দ আমরা কতদিন স্পষ্ট শুনেছি!
সমস্ত ক্লাস অবাক হয়ে গেছে। স্যারও কৌতূহলী হয়ে কৌশিকের কথা শুনছেন। কে যেন একটু ইতস্তত করে বলল, শুধু তো শব্দ শুনেছিস। চোখে তো আর দেখিসনি! কৌশিক এবার আরও উত্তেজিত, দেখতে গেলেই ওরা উড়ে পালিয়ে যায় যে! ভাবছিস আমি বানিয়ে বলছি? কল্যাণ, চন্দন ওদের জিগ্যেস কর, হোস্টেলের সবকটা ছেলে সেই ঘুঙুরের শব্দ শুনেছে— কল্যাণ আর চন্দন সায় দিল কেউ কিছু জিগ্যেস করার আগেই।
স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজলো একটু পরেই। ক্লাসের গল্পসল্পের রেশ তখনও অনেকের মন থেকে যায়নি। বিশেষ করে তথাগত তো দারুণ মুগ্ধ। ভৌতিক গল্পের মনোযোগী পাঠক সে, কনান ডয়েল থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায়, লীলা মজুমদার, শীর্ষেন্দু, কতো লেখকেরই বই সে পড়ে ফেলেছে এরই মধ্যে! ওর খুব ভালো লাগে, ভূত আছে কি নেই তা নিয়ে খুব কৌতূহল হয় যে! স্কুলের মধ্যেই এত বড় একটা ব্যাপার, আমগাছের তলায় পরীরা নেমে আসে বিশেষ বিশেষ দিনে, এই রহস্যের সবটা না জেনে থাকা যায়? ক্লাসে সব কথা হল না। হোস্টেলের ছেলেদের মধ্যে কল্যাণ বেশ স্মার্ট, সাহসীও। ছুটির পর তথাগত ওকেই ধরে জানতে চাইলো, ব্যাপারটা কী রে? সত্যি না কি?
কল্যাণ রহস্যময় ভাবে হাসে। ধীরে ধীরে বলে, কৌশিক ছেলেটা রাত্তিরে বড্ড কাঁদে, জানিস। দাদাকে, দিদিকে, মা বাবাকে হয়তো মনে পড়ে! ক্লাস সেভেনে পড়ে, এত কান্না— অনেকেই ক্ষ্যাপায়, তা আমি এইসব গল্প-টল্প বলে ওকে ভুলিয়ে রাখি… আমাদেরই ক্লাসের ছেলে…। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি। অনেক কাঠবেড়ালি সত্যিই ওইসব গাছে কিররর কিচ্চচ্চ শব্দ করে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে ওদিকটায় যা অন্ধকার, সে শব্দ দূর থেকে শুনলে শুধু কৌশিক কেন, কত বাঘা বাঘা ছেলেরই গা ছমছম করবে! এসব কথা আবার যেন কাউকে বলে দিস না—