• facebook
  • twitter
Sunday, 16 March, 2025

বাড়িটি

নিখিল ভাসতে ভাসতে চলা এক মানুষ। যাদের তরী বেয়ে ভেসে চলা স্বভাব অথচ নির্দিষ্ট কোন ভিড়বার তীর বা বন্দর থাকে না। এ মফস্বলে ভেসে এসে ঠাঁই নিয়েছিল একদিন।

কাল্পনিক চিত্র

গৌতম বাড়ই

বাড়িটিকে নিয়ে এ পাড়ার বেশিরভাগ পুরােনো বাসিন্দাদের কৌতূহল আছে, সংশয় আছে, অজানা এক প্রতিশোধ স্পৃহা আছে, সম্মানহানি বোধ লুকিয়ে আছে তাদের মনের ভিতরে, প্রশ্ন আছে তাদের ভিতরে অনেক, কিন্তু বাড়িটি এখনও আছে এবং বহাল তবিয়তে আছে । বাড়িটি সেই থেকে আজ পর্যন্ত চল্লিশ বছর ধরে এই পাড়াতেই আছে। তফাত শুধু পুরােনো দিনের সেই জেল্লা কিছুটা ম্লান এখন, বেশ কয়েক বছর হল বাইরে রঙের পোঁচ পড়েনি। একতলা বাড়ি। বাড়ির সঙ্গে জমি আয়তনে একদম কমও নয়, কাঠা চারেকের মতন। গেটের দু-ধারে দুটো দেবদারু গাছ। পেছনে দুটো নারকেল আর একটি আমগাছ। আরও কিছু ছোট-বড় গাছ আছে। গাড়ি রাখবার গ্যারেজ আছে মূল ভবনের পাশে। ফাঁকা জমি কখনও প্রাকৃতিক নিয়মে ঝোপঝাড়ে ভরতি হয়ে আসে, কখনও নিয়ম করে তার সাফাইও হয়। এ বাড়ির মালিক কে এখন?

মালিক কেউ নয়, বর্তমানে একজন মালকিন— নাম তার পারমিতা বসু। যখন মফস্বল শহরের এ পাড়ায় তিনি বা তাদের পরিবার আসেন, তার বয়স ঠিক কুড়ির ওপরে ছিল। আজ ষাট পার করা, একাকিনী এক মহিলার বাস এই বাড়িতে। মহানগরী কলকাতার ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এ মফস্বল শহরেও এই চল্লিশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন এ পাড়ায় এখন হাতে গোনা দু-চারটি একতলা বাড়ি। রেল স্টেশনের প্রায় গা-ঘেঁষে পাড়াটি। আর স্টেশনের পূর্বদিকের রাস্তা ধরে হাঁটাপথে ঠিক তিনমিনিট গেলেই, ডানহাতে দয়াল সাহার বড় দোতলা বাড়ির পরেই এই বাড়িটি।


সেই বাড়িটির সামনে আজ স্থানীয় থানার বড়বাবু অর্চিষ্মান সেনগুপ্ত এসে দাঁড়ালেন। নাম ধরেই ডাকলেন— ‘পারমিতা ম্যাডাম বাড়িতে আছেন? পারমিতা ম্যাডাম!’ বার তিনেক ডাকতেই বাড়ির বড় দরজা খুলে গ্রিলে ঘেরা বারান্দায় এক মহিলা এসে দাঁড়ালেন। পুলিশ অফিসারের চোখ সেদিকে তাকিয়ে প্রথম দেখাতেই একটু কুঁচকে গেল যেন। মাথা ভর্তি বলতে গেলে উজ্জ্বল সাদাচুল। মুখ এখনও অনেক আলোকদীপ্ত, ঔজ্জ্বল্য মাখা। চোখ দুটোও শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত, বড় ফ্রেমের চশমা পরে থাকলেও তা বোঝা যাচ্ছে। শরীরের বাঁধন অটুট, আঁটোসাঁটো না হলেও, খুব প্রবীণা বলে মালুম হবে না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে চেহারায় এক আলাদা আভিজাত্য রয়েছে। সুশ্রী চেহারা, প্রথম নজরেই আলাদা করা যায়। বাইরের লোহার গেটের কব্জা নিজের হাতে খুলে এগিয়ে গেলেন অর্চিষ্মান বাবু গ্রিলের বারান্দার দিকে। সামনে তাকিয়ে বললেন— ‘আপনি তো পারমিতা দেবী?’ পারমিতা বললেন— ‘হ্যাঁ। তবে আপনারা? কী জন্যে?’ অর্চিষ্মান তার পাশে দাঁড়ানো এএসআই সৈকত ভদ্রকে এক নজর দেখে নিয়ে পারমিতা দেবীকে বললেন— ‘আপনার সঙ্গে আমাদের একান্তে কিছু কথা আছে। তা বাড়ির ভেতরে নিভৃতে করতে চাই। বাড়িতে অন্য কোনও লোক থাকলে তাকেও ডাকতে পারেন। আপত্তি নেই তো?’ পারমিতা পাল ঘরের ভেতর থেকে চাবির গোছা হাতে নিয়ে এবার কিছুক্ষণ থানার বড়বাবু অর্চিষ্মান আর সৈকত ভদ্রকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। বললেন— ‘আপনাদের তো দেখে সত্যিকারের পুলিশই মনে হচ্ছে। তবে আজকাল যা শোনা যায় আকছার, একলা বৃদ্ধাকে বাড়িতে পেয়ে— খুন জখম রাহাজানি! —এ তো লেগেই আছে।’ তালা খুলে বললেন— ‘আসুন ভেতরে। কিন্তু পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকেছে।’


পুলিশ অফিসারেরা ঘরের ভেতরে এসে জানলেন, পারমিতা বসু এই মুহূর্তে একা আছেন। তবে আরও একজন মানুষ তাঁর সঙ্গে এ বাড়িতে থাকেন, তার নাম নিখিল। বাড়ির বাইরেটা দেখে রঙচটা বিবর্ণ মনে হলেও, ঘরের ভেতরটা ততটা অনুজ্জ্বল নয়। ড্রইংরুমে তাদের বড় সোফাটার উপর বসতে বললেন পারমিতা। পুলিশেরা দেখলেন সারাঘরটি দামী আসবাব আর দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী, বহুমূল্যের দামী পেইন্টিংয়ে সাজানো। ভদ্রমহিলার রুচির তারিফ করতেই হয়। অর্চিষ্মান এবার সরাসরি পারমিতা দেবীকে তাদের এখানে আসবার কারণটি বলেই ফেললেন— ‘আপনার নামে একটি গুরুতর অভিযোগ করেছেন এ পাড়ার দুজন বাসিন্দা, আমরা তা খতিয়ে দেখবার জন্য আপনার কাছে এসেছি।’ পুলিশ অফিসারদের বসতে দিয়ে, ওঁদের মুখোমুখি একটি বড় কাঠের চেয়ারে বসলেন তিনি। সচরাচর এ ধরনের চেয়ার সাধারণের ঘরে দেখা যায় না। বার্মাটিকের এ চেয়ারের বয়স যে পারমিতা দেবীর থেকে বেশি, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। পারমিতা দেবী অর্চিষ্মান বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘নির্দ্বিধায় ওই গুরুতর অভিযোগটি বলতে শুরু করুন। আমার বা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা বৈরিতা নতুন কিছু নয়। যবে থেকে আমরা এ পাড়ায় বাড়ি করে এসেছি, আর এসেই দুর্গাপুজোর জন্য এক বিরাট অঙ্কের চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছি, সেদিন থেকেই প্রতিবেশীদের মুখ থেকে আমরা সরাসরি শুনতে পাই, আমরা খুব খারাপ মানুষ। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি না। আমরা দেমাকি, অহংকারী। অথচ কারোর কোনও অসুবিধা আজ পর্যন্ত করিনি, না কারো কোনওদিন ক্ষতি করেছি, এ পৃথিবীতে একলা-একলা বাঁচবার অধিকার কি কারোর নেই? মানুষের যাবতীয় কৌতূহলের আর বিষোদ্গারের রসায়নে যৌনতা আর ব্যক্তি-যোগাযোগ। যাক গে, বলুন? আপনারা কী বলবেন।’ অর্চিষ্মান বাবু পারমিতা দেবীর শুধু চেহারা নয়, কথা বলবার ধরনে, ব্যক্তিত্বেও খুব মুগ্ধ হলেন। তাঁর মুখে সব শুনে বরং অভিযোগকারীদের প্রতিই তাঁর ভিতরে ভিতরে সন্দেহ সৃষ্টি হল। তাদের অভিযোগ ছিল, পারমিতা দেবী বাড়ির মধ্যে মধুচক্র চালাচ্ছেন। তিনি একজন অসামাজিক আর একগুঁয়ে জেদি মহিলা। পাড়ার কারোর সঙ্গে তার সদ্ভাব নেই। বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের তাঁর বাড়িতে প্রতিনিয়ত দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে। পাড়াটিকে নষ্ট করছেন তিনি। পারমিতা দেবী সব শুনে বললেন— ‘আমায় দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে অর্চিষ্মান বাবু? আর একজন বয়স্ক মহিলার বাড়িতে যদি কোনও পুরুষ মানুষ আসেই, তার কি সেই স্বাধীনতা নেই পরিচিত পুরুষ মানুষের সঙ্গে গল্প-গুজব-আড্ডা মারবার? আমার তো মনে হয় অভিযোগকারীদের অন্য কোনরকম বদ উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে। ইতিমধ্যেই এ পাড়ায় প্রমোটররাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়ির জমির পরিমাণটাও কম নয় কিন্তু! এসব ভেবে দেখবেন।’ পুলিস অফিসার অর্চিষ্মান বললেন— ‘আপনি, অরিন্দম পাল আর কুমুদ ভঞ্জকে চেনেন?’ পারমিতা খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন— ‘এরা যদি এ পাড়ার পুরানো বাসিন্দা হয়, নামে না চিনলেও, এদের মুখ দেখে ঠিক চিনতে পারব। তবে কুমুদ ভঞ্জ নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে না পারলেও, খুবই শোনা বলে মনে হচ্ছে। এরাই কি তাহলে সেই দুই অভিযোগকারী?’ বলেই, পারমিতা সামনে বসা দুই পুলিশ অফিসারের দিকে তাকালেন। অর্চিষ্মানের মুখে সামান্য হাসির ঝিলিক দেখা গেল।

পুলিশ অফিসারেরা আরও কিছুক্ষণ বসে পারমিতা বসুর সঙ্গে কথাবার্তা গল্পগুজব করে বেরিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। পারমিতা দেবী এর মধ্যে ওঁদের চা করে দিয়েছেন। অভিযোগের তদন্তে এসে তাঁরা শেষে এক সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করলেন, পুলিশদেরও মনে হচ্ছিল তাই। বারান্দা পর্যন্ত পুলিশ অফিসারদের এগিয়ে দিতে গিয়ে বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ি ঘিরে কৌতূহলী মানুষদের ভিড় বা জটলা লক্ষ্য করলেন তিনি। গাড়ির ড্রাইভার আর জনাদুয়েক কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই জটলা থেকে একটু আলাদা করে অত্যন্ত ভোঁতামুখের হালকা ক্যাবলা হাসি মেখে দু’জন লোক পারমিতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এই দুটো ভোঁতা আর বোকামুখকে পারমিতা বসু বাজারে প্রায়ই দেখেন। এদের একজন তো কুমুদ ভঞ্জ হবেন, আর একজন নিশ্চয় অরিন্দম পাল। কুমুদ ভঞ্জের মতন বড় প্রতারক এ অঞ্চলে আর কেউ নেই। মানুষের বোকামুখেও কত শয়তানি লুকিয়ে থাকে! পুলিশ অফিসারেরা ভিড়ে একবার চোখ বুলিয়ে, বেশ গম্ভীর হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন।


পারমিতারা যে এ পাড়া ছেড়ে চলে যাননি, তার একমাত্র কারণ তাঁদের প্রতিবেশী দয়াল সাহা। দয়ালকাকা বলে ডাকেন তাঁকে। প্রাণতোষ বসু ছিলেন কলেজের প্রফেসর। তখন এ মফস্বল শহরটি ছিল বেশ মনোরম, ফাঁকা-ফাঁকা, গ্রামবাংলার পরিবেশ। স্টেশন ছাড়িয়ে কিলোমিটার খানেক গেলেই জল, মাটি, পুকুর, চাষের জমি, গাছপালা, সবুজ আর সবুজে ভরা। চোর, জোচ্চোর আর বদমাশরা এই বাড়ির পাড়ার কাছে অসামাজিক কিন্তু আপাদমস্তক নিরীহ তিনজন ভদ্রমানুষদের কোনও ক্ষতি করতে পারতেন না, একমাত্র দয়াল সাহার ভয়ে। এখনও একবার, সারাদিন সময় না পেলে, অন্তত রাতে তিনি ফোন করে খোঁজ নেন পারমিতার। বৃষ্টি বাদলের রাতে দয়ালকাকার পাহারাদাররা আলো ফেলে এ বাড়িতেও যতটা সম্ভব সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। পারমিতা দেবী আজ চল্লিশ বছর ধরে বুঝেই উঠতে পারলেন না, কেন এই অঞ্চলের লোকেরা তাঁদের বাড়িটিকে আর তাঁদের ঘিরে এতটা কৌতূহলী আর শত্রুর মতন আচরণ করে? এই যেমন কোভিড অতিমারি সময়ে কারা যেন রটিয়ে দিয়েছিল, পারমিতার কোভিড হয়েছে। তারপর মিউনিসিপ্যালিটির থেকে মাস্ক পরা লোকজন, স্বাস্থ্য দপ্তরের লোকেরা পুলিশ নিয়ে বাড়ি এসে তাঁর কোভিড পরীক্ষা করা, এইসব ঝুট ঝামেলায় কয়েকদিন অযথা হয়রানি করিয়েছিলেন। দশ বছর আগে মাত্র এক বছরের ব্যাবধানে বাবা প্রাণতোষ বসু আর মা রমলা বসু মারা যেতেই, সারা পাড়ায় রটে গিয়েছিল পারমিতাদের বাড়িটি আসলে ভূতের বাড়ি, প্রেতাত্মা বাস করে ওখানে। মেয়েটিকে অপদেবতা ভর করেছে। পারমিতা দেবী কাঁদবেন না হাসবেন ভেবেই উঠতে পারতেন না। এ কোন অন্ধকার সমাজে বাস করছেন তাঁরা? দয়ালকাকা একমাত্র বুক চিতিয়ে তখন রক্ষা করেছেন তাঁকে। আজ বিকেল হতে না হতেই সারা পাড়ায় রটে গিয়েছে এই বাড়িতে পুলিশ আসবার কথা। বিকেলের আলোতে বারান্দায় বসে ছিল নিখিলকে নিয়ে, আর খেয়াল করছিল রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করা লোকেদের অনেকদিন পর কৌতূহলী চাউনি। এই আলোতে বসে থাকতে থাকতেই পারমিতা দেবী অন্যরকম এক সিদ্ধান্ত নিলেন।


এই অঞ্চলের কেউ জানে না আসলে পারমিতা বসুর আড়ালে দেবস্মিতা সূত্রধর বলে একজন নামজাদা মহিলা লুকিয়ে আছেন। পারমিতা আত্মগোপন করে থাকতে ভালোবাসেন। এ তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া জেনেটিক্যালি গভীর স্রোতধারা। তবে ষাটোর্ধ্ব জীবনে এসে এবার ঘটনার অভিঘাতে নির্জনে আত্মগোপনের বেড়াটি ভেঙে ফেলতে চান তিনি। তার আগে ফোনে কিছু দরকারি যোগাযোগ সেরে ফেলতে হবে তাঁর। আজ দয়ালকাকা পুলিশ আসবার খবর শুনে বাড়িতে এসে সবিস্তারে পুরো ঘটনাটি জেনেছেন পারমিতার কাছ থেকে। তখন তিনি তাঁর বাড়িতে ছিলেন না। পারমিতা কারো নাম উল্লেখ করেননি তাঁর কাছে। তবে দয়ালকাকা জানিয়েছেন— ‘আমি যদি ওই দুজনের পরিচয় জানতে পারি, তোর পা ধরে ক্ষমা চাওয়াব ওদের।’ দয়াল সাহা এই অঞ্চলের বড় ব্যবসায়ী। বাড়ি লোকজনে জমজমাট থাকে সারাদিন। তাঁর বড় ছেলে আর তাঁর বৌমাটি পারমিতাকে দিদি বলে ডাকেন এবং সম্মানও করেন, ভালোবাসেন। মধুচক্রের এ চরম অপবাদ যেমন পারমিতার বুকের ভেতরে গিয়ে নাড়া দিয়েছে, দয়াল সাহাও এরকম কটু কথার অপবাদে ক্ষেপে গিয়েছেন। তিনি তো পারমিতাকে মেয়ের মতন স্নেহ করেন, হয়ত নিজের কন্যাসন্তানের আক্ষেপ পূরণ করেন। দেবস্মিতা সূত্রধর হলেন গতবছরের সাহিত্য জগতের অন্যতম মহা-মূল্যবান আনন্দভারতী পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক। পারমিতা বসু নিজে যাননি। হঠাৎ শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে, তাঁর হয়ে অন্যকাউকে পাঠিয়েছিলেন পুরস্কারের মানপত্র, সনদ ইত্যাদি নিয়ে আসতে।


নিখিল ভাসতে ভাসতে চলা এক মানুষ। যাদের তরী বেয়ে ভেসে চলা স্বভাব অথচ নির্দিষ্ট কোন ভিড়বার তীর বা বন্দর থাকে না। এ মফস্বলে ভেসে এসে ঠাঁই নিয়েছিল একদিন। লোকের ফাইফরমাস খাটা ছিল তার স্বভাব। কীভাবে যেন পারমিতার বাড়ি তার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গিয়েছে এই সামান্য ক’বছরে। পারমিতা ভিনদেশী নিখিলকে তাঁর বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টা থাকতে দিয়ে শুধু বলেছিলেন— ‘হয়ত একদিন তুই আমাকে, এই বৃদ্ধাকে একলা অসহায়া পেয়ে খুন করবি, সেদিন অন্তত বলে খুন করিস, পেছন থেকে হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করিস না, ধারালো অস্ত্রে নয়, বন্দুকের গুলিতে খুন করিস সরাসরি।’ পারমিতা আজকের এই ঘটনার কিছুদিন পর, নিখিলকে তাঁর ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে জিগ্গেস করলেন— ‘নিখিল তোকে আমি চিরদিনের মতন আমার জীবনে বেঁধে রাখব সম্পর্ক স্থাপনে। রাজি তো? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিবি।’ পারমিতা দেবীর থেকে নিখিল অন্তত পঁচিশ বছরের ছোট। এরপর পারমিতা বললেন— ‘আমাদের বাড়ি আর আমাদের জীবনের প্রতি এই ছোট্ট শহরের অগাধ কৌতূহলে আমি আরও বিস্ময় জাগাতে চাই। একজন মহিলার একাকিনী দাপটের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করা এখনও বিস্ময় বই কি!’

নামকরা প্রতিটি বাংলা দৈনিকে তারপর একদিন খবরটি প্রকাশিত হল, প্রায় একইরকম ভাষাতে— স্বনামধন্য সাহিত্যিক দেবস্মিতা সূত্রধর বা পারমিতা বসু তাঁর বাষট্টিতম বয়সে বিয়ে করলেন তাঁর চেয়ে অন্তত বছর বিশেকের ছোট এক তরুণের সঙ্গে। সঙ্গে ফটো। সেই ফটোতে পারমিতার প্রতিবেশী দয়াল সাহার বাড়ির লোকেরা আর স্থানীয় থানার বড়বাবু অর্চিষ্মান সেনগুপ্ত আছেন।

পারমিতা নিখিলকে ফটো দেখিয়ে বললেন— ‘এইভাবে আজ নিজেকে প্রথম সবার কাছে মেলে ধরলাম। শুধুমাত্র বয়স্ক পুরুষরা বিয়ে করতে পারে? আটাত্তর বছরের নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ, ষাটোর্ধ্ব রাজনৈতিক ভাবে সন্ন্যাস নেওয়া নেতার পরকীয়া-প্রেম-বিয়ে, তারপর আরও আছে প্রবীণ খেলোয়াড়, অভিনেতা কেউ বাদ নেই, ঘটা করা তাদের বিয়ের ফটো ছাপা হয় দৈনিকে। এবারে দেখুক একজন প্রবীণা সাহিত্যিকও কম যান না এই ব্যাপারে। নিখিল পাশ থেকে বললে— ‘কে বলল তুমি প্রবীণা!’