• facebook
  • twitter
Monday, 24 March, 2025

রোববারের ছুটি

সাপ্তাহিক ছুটির মেয়াদ বাড়ে। সেই সময় সপ্তাহে একটা অর্ধেক দিন এবং একটা পুরো দিনের ছুটি স্বীকার করে সরকার এবং বিভিন্ন নিয়োগকারি সংস্থা।

নিজস্ব গ্রাফিক্স চিত্র

অমিয় আদক

রাই আর রাকা হাজির ঠাম্মার ঘরে। ঠাম্মা সেই জপ সেরে ওঠেন। দেখেন দুই নাতনি হাজির। তাঁর প্রশ্ন, ‘কী? দি’ভাইদের সক্কালেই কী খবর?’ রাই জানায়, ‘আজ রবিবার, তোমার চা এখুনি আসছে। আমাদের সকালের গল্পটা এখুনি বলে দাও। আমরা গিয়ে ড্রয়িং করতে বসবো।’ ঘরে ঢোকেন রাকার মা। শাশুড়ির চা বিস্কিট রাখেন টেবিলে। ঠাম্মি বলেন, ‘চা শেষ করেই গল্প শোনাবো। তোমাদের ড্রয়িং খাতা ইত্যাদি নিয়ে এসো। এ ঘরেই আজ ড্রয়িং করবে। গত রোববারে তোমরা ঝগড়া করে সময় নষ্ট করেছো।’

ঠাম্মির নির্দেশ। অমান্য করার সাহস নেই। তাহলে সারা সপ্তাহে অনেক পাওনা মার যাবে। দু’বোনে যায় ড্রয়িং খাতা আনতে। ঠাম্মির চা পান শেষ। দু’বোন হাজির। ঠাম্মি বলেন, ‘রোববার ছুটির দিন। সবার কাছেই মজার দিন। রোববার ছুটির দিন কবে থেকে? তা তোমরা জানো?’
রাকা বলে, ‘রবিবার ছুটি। এটাই জানি। কবে থেকে? তা কীকরে জানবো?’

সেই গল্পটাই শোনাই। এখন থেকে সতেরোশো তিন বছর আগের কথা। ঘটনাটা আমাদের দেশে ঘটেনি। ঘটে ইউরোপে। পুরানো রোম সাম্রাজ্যের এক শহরে। সেই শহরের নাম কনস্টান্টিনোপল। এই কনস্টান্টিনোপল শহরকে রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলেন সম্রাট কনস্টানটাইন। নিজের নাম জুড়ে শহরের নাম রাখেন।

খ্রিস্টধর্ম তখন জেরুজালেম থেকে ইতালি হয়ে ইউরোপের দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ পুরােনো মূর্তিপুজো ছেড়ে দিতে তৈরি। দলেদলে মানুষ খ্রিস্টধর্মকে আপন করছেন। রোমান সম্রাটও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। সম্রাট কনস্টানটাইন বেশ উঁচু মনের মানুষ। তিনি শ্রমিক নাগরিকদের কথাও ভাবেন। তখনকার সময়ে চাষের কাজের শ্রমিক, বিভিন্ন মিল বা কারখানার শ্রমিকরাও একটানা কাজ করতে বাধ্য। তাদের সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম অবশ্যই দরকার। একটানা কাজের জন্য অনেকেই প্রায় অসুস্থ হয়। সেইসব মানুষদের কথা ভেবে একদিন সাপ্তাহিক ছুটির কথা ভাবেন। গির্জার প্রার্থনা সমাবেশে ধর্মপ্রাণ মানুষরা রবিবারেই যান। ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দিতে শ্রমজীবী মানুষরাও যেতে পারেন না। একদিনের ছুটিতে তারা কাজের চাপ থেকে মুক্ত থাকবেন। গীর্জার প্রার্থনা সমাবেশেও অংশ নিতে পারবেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার হলে সবশ্রেণির নাগরিক সুবিধা পাবেন।

সম্রাট কনস্টানটাইনের বেশ কর্মময় জীবন। তিনি ইউরোপের অনেক এলাকা জয় করেন। সেগুলি তাঁর সাম্রাজ্যের মধ্যে আসে। তিনি তিনশো ছয় খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনশো সাঁইত্রিশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট ছিলেন। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তিনশো একুশ খ্রিস্টাব্দে তিনি রবিবারকে নাগরিক ছুটি ঘোষণা করেন। সেটা আজও চলে আসছে। সেই ছুটির দাবি সারা ইউরোপে ছড়ায়। পরপর বিভিন্ন দেশ রবিবারকে নাগরিক ছুটির মান্যতা দেয়।

আমাদের দেশের রাজারা এমন কোনও নিয়মকে মান্যতা দেননি। আমাদের দেশের ইতিহাসে এমন কথা খুঁজে মেলে না। তোমরা ভাবছো, তাহলে কি আমাদের দেশে সাপ্তাহিক ছুটি কোনোকালেই থাকেনি? সাপ্তাহিক ছুটি না থাকলেও শ্রমিকরা ছুটি পেতেন। সেগুলো ধর্মীয় উৎসবে আনন্দ করার ছুটি। আমাদের দেশে অতীতে ধর্মীয় উৎসব সংখ্যা অনেক বেশি। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দরকার পড়েনি।

যারা কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের ছুটির খবর পেয়েছো। যারা পড়ুয়া, তাদের ছুটির কথা পাওনি। প্রাচীন ভারতের আশ্রম বিদ্যালয়। লোকালয় থেকে দূরে। বনের মধ্যে। সেখানে কেবল লেখাপড়ার চর্চা, এমনটা নয়। সেখানে যুদ্ধবিদ্যা, সামাজিক শিক্ষা, চাষবাসের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ছাত্ররা আশ্রমের সব কাজই করে। নির্দিষ্ট দিন বা বার মেনে ছুটি থাকে না। তবুও তাদের অবসর যাপনের সুযোগ থাকে। তাদের আলাদা সাপ্তাহিক ছুটির দরকার পড়েনি।
পরবর্তি সময়ে আশ্রমিক বিদ্যালয় পালটায়। আসে টোল, চতুষ্পাঠী, পাঠশালা ইত্যাদি। সেখানের শিক্ষকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ পরিবারের। তাঁদের বৃহস্পতিবারে পুজোর দায়িত্ব পড়ে। তাই পাঠশালা, টোল ইত্যাদিতে ছুটির দিন বৃহস্পতিবার। এবার ভাবছো, তোমাদের স্কুলে রোববারে ছুটি। সেটা এলো কী করে?

আমাদের দেশে রবিবারের ছুটি এসেছে ইংরেজ আমলে। অনেক আন্দোলন করে। এই দাবি আদায়ের আন্দোলনের নেতার নাম নারায়ণ মেঘাজি লোখাণ্ডে। তিনি জন্মান মহারাষ্ট্রের থানে শহরে। আঠেরোশো আটচল্লিশ সালে। শ্রমিক নেতা হিসাবেই তিনি পরিচিত। শ্রমিকদের জন্য তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম। আন্দোলনের নাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। মহারাষ্ট্রে শিক্ষা আন্দোলনের প্রধান নেতা জ্যোতিরাও ফুলে। তাঁর কথা তোমরা জানো। জ্যোতিরাও ফুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নারায়ণ মেঘাজি লোখাণ্ডে। তিনিই ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম নেতা।

শ্রমিকদের একটানা কাজ। একঘেয়েমি আসে। শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তাদের সাপ্তাহিক ছুটির একান্ত দরকার। আঠারোশো তিরাশি সাল থেকে আন্দোলন শুরু। ইংরেজ সরকার তাঁর আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয় না। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। অবশেষে আঠারোশো নব্বই সালের দশই জুন, ইংরেজ সরকার সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার ঘোষণা করে। সেই থেকে আমাদের দেশে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি।

পরে সাপ্তাহিক ছুটির মেয়াদ বাড়ে। সেই সময় সপ্তাহে একটা অর্ধেক দিন এবং একটা পুরো দিনের ছুটি স্বীকার করে সরকার এবং বিভিন্ন নিয়োগকারি সংস্থা। ফলে সপ্তাহে, শনিবার দুপুরের পরেই ছুটি, রবিবারের সারাদিনের ছুটি আজও চলে আসছে। এখন আবার কিছু ক্ষেত্রে সোম থেকে শুক্রবারের মধ্যে দৈনিক কাজের সময় বাড়িয়ে সপ্তাহে পুরো দু’দিনের ছুটিও অনেক দেশি বিদেশি কোম্পানি শুরু করেছে। সেই ক্ষেত্রে সপ্তাহে শনিবার এবং রবিবার পুরো ছুটি। রোববারের ছুটির কথা ফুরোলো। গল্পের নটেগাছ মুড়োলো।

নাও এখানেই ড্রয়িং করো দু’জনে। যেন ঝগড়ার ‘ঝ’-ও না শুনি। দুই দুষ্টুমিষ্টি মেয়ে, নিজেদের খেয়ালে ছবি আঁকতে থাকে।