শঙ্ক চক্রবর্তী
অনেক কাল আগে, এক রাজার রাজ্যে সুভদ্র বলে একজন লোক বাস করত। তার বাবা ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠী। তাঁর ছিল অগাধ ধন সম্পদ। আর সুভদ্র ছিল তার বাবার একমাত্র সন্তান। সে মানুষ হয়েছিল বড় আদরে। কিন্তু এই আদর তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বাবার ধন সম্পদের অহংকারে ছোট থেকেই সুভদ্র লেখাপড়া বা অন্য কোনো কাজকর্ম করতে চাইতো না। তার লক্ষ্য ছিল শুধু বাবার অর্থে আনন্দ ফুর্তি করে বেড়ানো। শ্রেষ্ঠী ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে ছিলেন। কিন্তু সে কথা শোনেনি। সুভদ্রর যে বন্ধুরা তার অত্যন্ত হিতাকাঙ্ক্ষী ছিল তারাও তাকে অনেক বুঝিয়ে ছিল। কিন্তু সে কারোর কথা শুনতে রাজি ছিল না। বাবার সম্পত্ত ধন সম্পদ শুধু ফুর্তি করে নষ্ট করাই ছিল তার কাজ।
সুভদ্রর মা মারা গিয়েছিলেন তার ছেলেবেলায়। এদিকে শ্রেষ্ঠীর নিজেরও বেশ বয়স হয়েছিল। ছেলের চিন্তায় তাঁর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। অবশেষে অসুস্থ হয়ে একদিন তিনি মারা গেলেন। বাবা বেঁচে থাকতে সুভদ্র যাও-বা একটু সংযমে থাকত, তিনি মারা যেতে সেটুকুরও বাঁধ ভেঙে গেল।
আয় নেই এক বিন্দু। অথচ খরচ আছে ঢের। খুব অল্প দিনেই সুভদ্র দেউলিয়া হয়ে পড়ল। বসত বাড়িটুকু ছাড়া তার আর কিছু রইল না। উপায়ান্তর না দেখে সুভদ্র এবার বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার-কর্জ করতে শুরু করল। এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তার মাথায় ধারের পাহাড় জমে গেল। পাওনাদারদের ভয়ে এবার সুভদ্রর রাতের ঘুম উড়ে গেল। পাওনাদাররাও তাকে এসে একদিন শাসিয়ে গেল। তারা বলে গেল, সাতদিনের মধ্যে টাকা ফেরত না পেলে তারা রাজার কাছে সুভদ্রর নামে নালিশ জানাবে। সুদে আসলে তাদের পাওনা বেড়ে অনেক হয়েছিল। সুভদ্রর তা শোধ করার ক্ষমতা ছিল না। তাই একদিন অন্ধকার থাকতেই সুভদ্র তার বাড়ি ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কখনো ছুটে, কখনো হেঁটে সুভদ্র বহুদূর চলে এল। এক জায়গায় এসে সে আর চলতে পারলো না। বাধ্য হয়ে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সে বসে পড়ল। খানিক বাদেই মিষ্টি বাতাসে তার শরীর জুড়িয়ে গেল। শরীর তার এমনিতেই ক্লান্ত ছিল। তাই একটু বাদেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
এইভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সুভদ্র বুঝতে পারেনি। হঠাৎ একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে সে এক ভীষণ দৃশ্য দেখল। প্রায় তারই বয়সী একটি ছেলে তার মাথার তলা থেকে, তার শেষ সম্বল ঝোলাটি নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই দেখে সুভদ্র গর্জে উঠল।
‘কে তুই আমার ঝোলায় হাত দিস?’
ওই ছেলেটি ছিল ওই অঞ্চলের বিখ্যাত ডাকাত। সে সুভদ্রর হুঙ্কারে ভয় পেল না। মৃদু হেসে বলল— ‘আমি এক ডাকাত। তোমার এই ঝোলা আমাকে দিয়ে দাও। নাহলে তোমার সমুহ বিপদ উপস্থিত।’
আর যাই হোক সুভদ্রর সাহস ছিল খুব। সে ডাকাতকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করল। কিন্তু ডাকাত ছিল খুবই শক্তিশালী। এবং মল্লযুদ্ধ পটু। তাছাড়া পথশ্রম আর ক্ষিধেয় সুভদ্র এমনিতেই কাতর ছিল। তাই কিছুক্ষণ লড়বার পর ডাকাতের প্রহারে সে বেদম হয়ে পড়ল। শেষে পুরো পরাজিত হল। ডাকাত ঝোলার সঙ্গে হাতে আর কোমরে দড়ি বেঁধে সুভদ্রকেও বন্দী করে নিয়ে গেল।
এরপর সুভদ্র ডাকাতের ঘরে বন্দী হয়ে রইল। ডাকাত তাকে দিয়ে নিজের ফাই ফরমাস খাটাতো। আর নিজের গা হাত পা টেপাতো। অপমানের জ্বালায় সুভদ্র মরমে মরতে লাগল।
ডাকাত সুভদ্রকে নিয়ে থাকত একটা জঙ্গলে। একদিন সেখানকার রাজার সেনা সেই ডাকাতের খোঁজে সেই জঙ্গলে হানা দিল। তাদের হাত থেকে বাঁচতে ডাকাত আরও গভীর জঙ্গলে গিয়ে লুকোলো। কিন্তু সুভদ্রকে সে নিয়ে যেতে পারলো না। সেই সুযোগে সুভদ্র সেখান থেকে পালালো।
জঙ্গল থেকে পালিয়ে প্রায় একদিন চলার পর, সুভদ্র একটি বড় শহরে পৌঁছালো। সেখানে এক শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে সে আশ্রয় পেল। তিনি ছিলেন বৃদ্ধ এবং অত্যন্ত দয়ালু। সুভদ্র তাঁকে সব বলল। তার মুখে সব শুনে শ্রেষ্ঠীর বড় মায়া হল। মুখে তিনি বললেন, ‘তাহলে দেখলে বাবার কথা না শুনলে, সঠিক শিক্ষা না নিলে, পরিশ্রম না করলে কী অবস্থা হয়।’
সুভদ্র সার বুঝেছিল। শ্রেষ্ঠীর কথায় সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্রেষ্ঠী কিন্তু সুভদ্রকে নিজের কাছে রেখে দিলেন। উপযুক্ত শিক্ষক রেখে তাকে লেখাপড়া, মল্লযুদ্ধ এবং অস্ত্র বিদ্যা শেখালেন। সুভদ্র দিনে শ্রেষ্ঠীকে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে সাহায্য করত। রাতে শিক্ষা লাভ করত।
ওদিকে ওই ডাকাতের অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। রাজার সেনা কিছুতেই তাকে ধরতে পারছিল না। একদিন সুভদ্র ছদ্মবেশে রাখাল সেজে জঙ্গলে হানা দিলে। রাখাল ভেবে ডাকাত এবার পালানোর কথা ভাবেনি। উল্টে সে সুভদ্রকে একা পেয়ে আক্রমণ করল। এবার কিন্তু যুদ্ধে সুভদ্র জয়ী হল। সে ডাকাতকে বন্দী করে রাজার হাতে তুলে দিল।
সুভদ্রর কাজে রাজা এবং শ্রেষ্ঠী দু’জনেই খুব খুশি হলেন। রাজা তাকে প্রচুর পুরস্কার দিলেন। আর শ্রেষ্ঠী সুভদ্রর সঙ্গে নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে রেখে দিলেন।