• facebook
  • twitter
Monday, 17 March, 2025

বসন্তের দিন চলে যায়…

শান্তিনিকেতন

নিজস্ব গ্রাফিক্স চিত্র

সুমিতা ভট্টাচার্য

‘‘ওগো বসন্ত, হে ভুবনজয়ী,/ বাজে বাণী তব ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’,/বন্দীরা পেল ছাড়া।/ …জড়দৈত্যের সাথে অনিবার/ চিরসংগ্রাম ঘোষণা তোমার/ লিখিছ ধূলির পটে—’’ প্রকৃতির ছয় ঋতুর মধ্যে সর্বশেষ ঋতু বসন্ত; সে ঋতুরাজ। প্রতিটি ঋতুকেই শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আবাহন করা হয়। বসন্ত ঋতুকেও এভাবেই বন্দনা করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রকৃতি ও প্রকৃতি পাঠের মধ্য দিয়েই আশ্রমের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে। শুধু তাই নয়, এইসব উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই আশ্রমবাসীরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবেন। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে গভীর। বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ মহামিলনক্ষেত্র করে তুলতে চেয়েছিলেন। তার একটা প্রধান মাধ্যম ছিল উৎসব-অনুষ্ঠান। সব অনুষ্ঠানের শেষে গাওয়া হয়, ‘আমাদের শান্তিনিকেতন/ সে যে সব হতে আপন।’ এই শান্তিনিকেতনকে আপন করে নিতে সব রকম উৎসব-অনুষ্ঠান খুবই সহায়ক।

শান্তিনিকেতনে বসন্ত আসে রবীন্দ্রনাথের গানে গানে। আর এখানকার প্রকৃতিতে লাগে অপূর্ব রঙের ছোঁয়া। শীতকালে ঝরে পড়া পাতার শূন্য স্থান পূরণ করতে গাছে গাছে নতুন সবুজ পাতা ছেয়ে যায়। ‘নব বসন্তের দানের ডালি’ নিয়ে সেজে ওঠে শান্তিনিকেতন। পলাশ, শিমুল, শিরীষ, ফাগুন বউ তাদের ফুলের ডালি নিয়ে চারিদিক ভরে তোলে। শান্তিনিকেতনের বাতাসে মধুমালতী তার সুগন্ধ ছড়ায়। তারই সঙ্গে মেশে আমের মুকুলের সুমিষ্ট গন্ধ। শালবনের নতুন কচি পাতার মধ্য দিয়ে বসন্তের হাওয়া বয়ি যায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই তো অল্পদিন হইল, আমাদের আমলকী মউল ও শালের ডাল হইতে খস্ খস্ করিয়া কেবলই পাতা খসিয়া পড়িতেছিল— ফাল্গুন দূরাগত পথিকের মতো যেমনি দ্বারের কাছে আসিয়া একটা হাঁপ ছাড়িয়া বসিয়াছে মাত্র, অমনি আমাদের বনশ্রেণী পাতা-খসানোর কাজ বন্ধ করিয়া দিয়া একেবারে রাতারাতিই কিশলয় গজাইতে শুরু করিয়া দিয়াছে।’

শান্তিনিকেতনের আকাশে-বাতাসে বসন্তের আহ্বানে গান ভেসে বেড়ায়। ‘সব দিবি কে, সব দিবি পায়,/ আয় আয় আয়।/ ডাক পড়েছে ওই শোনা যায়,/ আয় আয় আয়।’ ছেলেমেয়েরা গানে নাচে মেতে ওঠে। তাদের গলায় শোনা যায়, ‘বাকি আমি রাখব না কিছুই। / তোমার চলার পথে পথে/ ছেয়ে দেব ভুঁই।’ শোনা যায় কবির কবিতার উচ্চারণ, ‘হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরণীর ধ্যান-ভরা ধন,/ বৎসরের শেষে/ শুধু একবার মর্তে মূর্তি ধর ভুবনমোহন/ নব বরবেশে।’ এভাবেই সবার মনে বেজে ওঠে বসন্ত প্রকৃতির সুর।

আমার ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতা শহরে। আমি ছোটবেলায় কলকাতায় থাকার সময় শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের কথা শুনেছি। দেখার খুব ইচ্ছে হতো। সেই ইচ্ছে পূর্ণ হলো ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে। আমার বাবা তখন বিশ্বভারতীর ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হয়ে এসেছেন। বাবা-মা ও ছোট্ট বোনের সঙ্গে দেখলাম বসন্তোৎসব। কী আনন্দ— অপূর্ব অনুভূতিতে কিশোরী মন ভরে উঠল। সকালে ‘ওরে গৃহবাসী’ গানের সঙ্গে শোভাযাত্রায় নাচতে নাচতে চলেছে বিশ্বভারতীর ছোটো থেকে বড়ো পড়ুয়ার দল, প্রাক্তনী, আশ্রমিক, মাস্টারমশাইরা। ছোটোদের কেউ তালি দিয়ে, কেউ কাঠি নিয়ে, কেউ হাতের মুদ্রায় নাচ করছে। বড়োদের মধ্যেও কেউ হাতের, কেউ কাঠির নাচ করছে, কেউ বা মন্দিরা হাতে নাচছে। ছোটো থেকে বড়ো সকলে নাচের মাধ্যমে শোভাযাত্রা করে আশ্রম পরিক্রমা করে আম্রকুঞ্জে সমবেত হলো।

শোভাযাত্রার মাঝে মাঝে শিক্ষক-শিক্ষিকারা ঢোল ও মন্দিরা বাজাতে বাজাতে চলেছেন। মেয়েদের পরনে হলুদ শাড়ি ও পলাশের মালা, ছেলেদের পরনে হলুদ পাঞ্জাবি-ধুতি, কোমরে বাটিক কিংবা নানা রঙের উত্তরীয়— অপূর্ব শোভা তার। এরপর আম্রকুঞ্জের বেদিতে বসন্তের গান-নাচ-কবিতায় বসন্তকে আবাহন করা হলো। এতে প্রত্যেক ভবনের ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ শুনতে শুনতে মনে পুলক জেগে উঠল। ‘এনেছ ওই শিরীষ বকুল আমের মুকুল’ যেন চোখের সামনে ছবি এঁকে দেয়। ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি—’ গানের সঙ্গে নাচের মেলবন্ধনে এক নাটকীয়তা সৃষ্টি করে। ‘আজি দখিন-দুয়ার খোলা’, ‘ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া,’ ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ , ‘বসন্তে ফুল গাঁথল’, ‘ওরে আয় রে তবে, মাত্ রে সবে আনন্দে’, ‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান—’ প্রভৃতি গান ও নাচে অপূর্ব আবেশ তৈরি হয়েছিল। শেষ দুটি গান ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও’ ও ‘যা ছিল কালো-ধলো তোমার রঙে রঙে রাঙা হল’-র পরেই শুরু হতো আবির খেলা। থালাতে আবির রাখা থাকে। সেই আবির নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে আবির মাখায়। শান্তিনিকেতনের দোলের বিশেষত্ব হলো জলে গোলা পিচকারির রঙ নয়, বিভিন্ন রঙের আবিরের ব্যবহার। তাও পরিচিতের মধ্যে আবির খেলা হতো, অপরিচিতের মধ্যে নয়। এই সুন্দর শোভন রীতি শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। আমি তো কলকাতা থেকে এসে এই রীতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ছোটোরা বড়োদের পায়ে আবির ছুঁইয়ে প্রণাম করে আর ছোটো ও সমবয়সীদের কপালে আবির লাগিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
আগে বসন্তোৎসব দোলপূর্ণিমার দিন শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত হতো। অবাঞ্ছিত ভিড়ের কারণে এখন অন্য দিন পালন করা হচ্ছে।

বসন্তোৎসবের আগের রাতে বৈতালিকে বসন্তের গানে তাকে আবাহন করা হয়। দল বেঁধে ছাত্রছাত্রী অধ্যাপক আশ্রমিকরা আশ্রম পরিক্রমা করেন গানে গানে। আগে আম্রকুঞ্জে বসন্তোৎসব হতো। পরে আশ্রমের খেলার মাঠে কিংবা গৌরপ্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান হয়। বসন্ত পূর্ণিমার সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গণের মঞ্চে প্রতি বছরে রবীন্দ্রনাথের ভিন্ন ভিন্ন নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। সংগীত ভবন এই অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। রাতে শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করেন আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পীরা।

উত্তর-শিক্ষাসদনে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবার সুবাদে বিশ্বভারতীর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগ তৈরি হয়। আশ্রমের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার সুযোগ হওয়াতে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে এক গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হলো। প্রকৃতির নিকট সান্নিধ্যে ক্লাস করার কারণে অন্যরকম আনন্দ ও ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিটি ঋতুকেই নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারলাম। শীতের তীব্রতায় চারিদিক যখন কম্পিত, আমরা তারই মধ্যে তখন ক্লাস করতাম। এরই মধ্যে নানা ধরনের ফুলের সম্ভার আশ্রম এলাকা ও প্রতি বাড়ির সংলগ্ন বাগানকে আলোকিত করে রাখতো। শীতের শেষে গাছের পাতা ঝরে চারিদিকে পাতার স্তূপ জমা হতো। আমরা এই পাতার স্তূপে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম। সকালে যখন ক্লাস শুরু হতো তখন চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকতো। ধীরে ধীরে শীতের তীব্রতা কমে আসে। কুয়াশার আস্তরণ সরে গিয়ে রোদ ঝলমল করে ওঠে। বসন্তে প্রকৃতি মনে রঙ লাগায়। এই রঙে চারিদিক সেজে ওঠে। শীতের প্রাবল্যে মানুষের জবুথবু অবস্থা বসন্তের আগমনে দূর হয়ে যায়। তাই চারিদিকে উৎসব।

বসন্তের আগমনে শান্তিনিকেতনের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। কলকাতা শহরের ইঁট-কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গলে প্রকৃতির পরিবর্তন বিশেষ অনুভব করা যেতো না। শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির বৈচিত্র্য প্রতি মুহূর্তেই উপলব্ধি হতো। পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রীরা শিশুবয়স থেকে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠায় তারা জীবনের প্রতি মুহূর্তেই তার বৈচিত্র্যকে অনুভব করে। গাছের নিচে খোলা আকাশের তলায় ক্লাস করার ফলে এরা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে। তাদের চলায় বলায় গান-নাচ-কবিতা মিশে থাকে। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে যাবার সময় গলায় গান, চলায় নাচ। আমি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর এই ধরনটা কিছুটা গ্রহণ করেছিলাম। আমরা কিছু ক্লাস গাছের তলায় করতাম। তখন প্রকৃতির এই রূপ পরিবর্তন অনুভব করতাম। বসন্তের আগমনের খবর আমার মনেও রঙ লাগাতো। চারিদিকে কত রঙ, কত গান। কী যে ভালো লাগতো। বসন্তের আগমনে মনে গান জাগতো, ‘যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে।’ আমরা গান গাইতে গাইতে নাচের ছন্দে হেঁটে যেতাম। আমরা দল বেঁধে পথে পথে বিভিন্ন ফুলের গন্ধ-রঙ অনুভব করতে করতে হেঁটে বেড়াতাম। কখনও উত্তরায়ণের বাগানে চলে যেতাম বিভিন্ন ফুলের সম্ভার দেখতে। আবার কখনও ক্লাসের ফাঁকে সংগীত ভবনে চলে যেতাম সুর-তাল-ছন্দের টানে। শুধু গান-নাচ নয়, সেতার-এসরাজের সুরে মনে মূর্ছনা জাগতো, তবলার তালে মনে ঝংকার তুলতো। মনে হতো স্বর্গের সুরপুরীতে পৌঁছে গিয়েছি।

বসন্তোৎসবের শোভাযাত্রার নাচে ও মঞ্চে গানে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের মহড়া হতো সংগীত ভবনের প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে থেকেই এই মহড়া শুরু হতো। আমাদের মধ্যে একটা উত্তেজনার সঞ্চার হতো। এই বসন্তোৎসব দেখতে বহু লোকের সমাগম হয়। তাদের সামনে নাচ ও গান পরিবেশনের সে কী আনন্দ! আমরা নির্দিষ্ট দিনে হলুদ শাড়ি পরে, পলাশের মালা গলায় হাতে মাথায় পরে সমবেত হতাম। অনুষ্ঠানের শেষে আবির খেলা চলতো। এরপর ছোট ছোট জমায়েত করে গান-নাচ হোতো। তখন আমরা দেখেছি, এই সব আসরে প্রখ্যাত মানুষেরা, কবি-সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সুচিত্রা মিত্র, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের মতো শিল্পীরা যোগ দিতেন। বিভিন্ন জনের বাড়িতেও সারা দিন ধরে নানা অনুষ্ঠান চলতো। এরপর মাস্টারমশাই প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতাম আবির দিতে। সেখানে আবার বসন্তের গান-নাচ হতো খুব আনন্দের সঙ্গে। শেষে মধুরেন সমাপয়েৎ। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেন, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অধ্যাপক অধ্যাপিকারা সন্ধের নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করতেন। সন্ধেবেলা নৃত্যনাট্য দেখায় আমাদের কী উৎসাহ! পুরো বসন্তকাল জুড়ে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চলতো আমাদের গান-নাচের আসর।

বাংলা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পঠনপাঠন শেষে গবেষণার অন্তিম ভাগে পাঠভবনে বাংলার শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিই। তখন আমার একটি নির্দিষ্ট গাছের তলায় বেদিতে ক্লাসের ব্যবস্থা হলো। গাছটার নাম শুনেছিলাম চিরঞ্জি। প্রতি পর্বে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করতে আসতো। পাঠভবনের সাত বছরে প্রতিটি ঋতুকে খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করেছিলাম। শীতের শেষে শালবীথিতে ঝরা পাতার ওপর দিয়ে ছেলেমেয়েদের আসা-যাওয়ার শব্দে বুঝতাম, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’ তারা কখনও আপন মনে কখনও বা সমবেত কণ্ঠে বসন্তের গান গাইতে গাইতে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে যেতো। প্রতি ঋতুকেই তারা তাদের গানে-নাচে বরণ করে নিতো। তাদের লেখা রচনা-কবিতায়, আঁকা ছবিতে প্রতিটি ঋতুর বৈশিষ্ট্য-বৈচিত্র্য ফুটে উঠতো। ক্লাস না থাকলে তারা নিজেদের মতো গান-নাচ ছবি আঁকায় মেতে থাকতো। অনেক দিন পর্যন্ত আশ্রমের প্রতিটি স্থান সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই টুরিস্টদের আসা-যাওয়ায় কোনো বাধা ছিল না।

এর পর যোগ দিলাম বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে। গৌরপ্রাঙ্গণের দক্ষিণ দিকে শিমুলতলার নিচে তখনকার বাংলা বিভাগ। ছাত্রজীবনে ও অধ্যাপকজীবনে অনেক সময়েই ছাতার নিচে গাছের তলায় ক্লাস করতাম। কখনও ক্লাস করতে চলে যেতাম উত্তরায়ণের খোলা চত্বরে। পরবর্তী কালে সেখানেই অধ্যাপনার সময়েও বসন্তোৎসবের নাচের শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছি। অনুষ্ঠান শেষ হলে ছোটো ছোটো দল আশ্রমের বিভিন্ন প্রান্তে আসর বসাতো। এর পর ছাত্রছাত্রীর দল বাড়িতে আসতো আবির দিতে। তখনও গান-নাচের আসর বসতো।

কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সালে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ঋতু-উৎসব সূচনা করেন। দিনটি ছিল ১৮ জানুয়ারি। পরবর্তী সময়ে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব উদযাপন হয়েছে। প্রকৃতি সেজে উঠলেই আশ্রমিকদের মনের মধ্যে বসন্ত গুনগুনিয়ে উঠতো। ১৯২৬ সালে বসন্তোৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৩৩২ এর ৪ চৈত্র দোলপূর্ণিমার দিনে। সম্ভবত ১৯৩২ থেকে ‘ওরে গৃহবাসী’ গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৩৪ সালে তার সঙ্গে নাচের যোগ হয়। এই শোভাযাত্রা শেষ হতো আম্রকুঞ্জে। সেখানে সাজানো বেদিতে অনুষ্ঠান হতো। ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ শেষবার সক্রিয়ভাবে বসন্তোৎসবে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে অসুস্থতার মধ্যেও যাতে নিখুঁতভাবে বসন্তোৎসব সম্পন্ন হয় তার জন্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও শান্তিদেব ঘোষকে কবি দায়িত্ব দেন। এই শেষ বসন্তোৎসব উপলক্ষে কবি লেখেন ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থের ৪ সংখ্যক কবিতাটি। ‘আর বার ফিরে এল উৎসবের দিন। /এ বৎসরে বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ।’