• facebook
  • twitter
Saturday, 5 April, 2025

শাগিরের শৈশব

—আজই ওরা স্কুলে মেল করে জানিয়েছে। অজয়বাবু বলেন— আমি তখনই জানতাম, ও ছেলের অঙ্ক হবে না তবে আঁক মানে আঁকা হবে।

কাল্পনিক চিত্র

সুব্রত দেব

ক্লাসের সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটির নাম শাগির। শাগির আহমেদ। সবসময় কিছু না কিছু দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় খেলছে। ওর কার্যকলাপে মাস্টাররা তটস্থ। পড়াশুনো ছাড়া অন্য সব কাজে ওর বিপুল উৎসাহ। অঙ্কের ক্লাস ওর কাছে বিভীষিকা। অঙ্ক পারে না বলে ওর কোনো হেলদোল নেই, ও যমের মত ভয় করে অঙ্কের শিক্ষক অজয়বাবুকে। অজয় রক্ষিত। খুবই কড়া ধাতের শিক্ষক। অজয়বাবু ক্লাস সেভেন সি-র ক্লাস টিচার। প্রথম পিরিয়ডে অঙ্ক।

শাগির শেষ বেঞ্চে জড়সড় হয়ে বসে থাকে। রোল কলের পর অজয়বাবু বললেন— তোমাদের আজকে জ্যামিতি করাব,তার আগে দেখি আগের ক্লাসের পড়া কাদের মনে আছে।
এই বলে পেছনের বেঞ্চ থেকে দু’জনকে ডাকলেন।
—এই তোমরা উঠে এসো। ছেলে দুটি এগিয়ে এলে

একজনের হাতে চক ধরিয়ে দিয়ে বললেন বোর্ডে বৃত্ত, আয়তক্ষেত্র, ত্রিভুজের ছবি ও সংজ্ঞা লেখো।
ছেলেটি স্কেল কম্পাস ছাড়া চেষ্টা করতেই স্যার ওকে থামিয়ে দিলেন, পাশের ছেলেটিকে বললেন— তুমি পারবে? ছেলেটি বলল— না।
স্যার বললেন আজ স্কেল, কম্পাস ব্যাবহার করে কীভাবে জ্যামিতিক ছবি আঁকতে হয়, শিখিয়ে দিচ্ছি। ভালো করে শিখে নে। আগামীকাল বোর্ডে আঁকতে দেব।
স্যার সুন্দর করে জ্যামিতিক চিত্র ও তার সংজ্ঞা বোর্ডে লিখে ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন— তোরা সব এঁকে, লিখে নে। আগামীকাল প্রত্যেকে পড়া তৈরি করে আসবি।

শেষ বেঞ্চের পল্টু হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।
—স্যার, শাগির বোর্ডের একটাও ছবি আঁকেনি। ও অন্য কী সব আঁকছে।
—তাই? শাগির তোর খাতাটা নিয়ে উঠে আয় তো।
—স্যার, আর অন্য কিছু আঁকব না।
—উঠে আয় বলছি।

শাগির ভয়ে ভয়ে খাতা নিয়ে এগিয়ে আসে। অজয়বাবু খাতাটা হাতে নিয়ে একবার তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। মাথা ভর্তি চুল, মোটা গোঁফ, চোখে চশমা। ছবির মানুষটা তো হুবহু তিনি!
—শাগির এটা কার ছবি আঁকছিলিস?
শাগির ঝুপ করে নিচু হয়ে স্যারের পা জড়িয়ে ধরে।

—স্যার আর কখনো আঁকব না। বলার সঙ্গে সঙ্গে অজয়বাবুর হাতের কাঁচা কঞ্চি শাগিরের পিঠে নেমে আসে। —জ্যামিতিক চিত্র না এঁকে স্যারকে আঁকছে! —রাস্কেল। দু’তিন ঘা দেওয়ার পর কঞ্চি ফেলে অজয়বাবু রাগতস্বরে বলেন— যা গিয়ে বসগে যা। আর কাল আমি তোকেই আগে বোর্ডে ডাকব। আমার ছবি, সংজ্ঞা দুইই চাই।
পরের দিন যথারীতি শাগিরের ডাক পড়ে।
—শাগির, বোর্ডে বৃত্ত, আয়তক্ষেত্র ও ত্রিভুজের চিত্র ও সংজ্ঞা লেখ।

শাগির স্কেল কম্পাস কোনো কিছুর সাহায্য না নিয়ে কেবল চক দিয়ে একটা নিখুঁত বৃত্ত, আয়তক্ষেত্র ও ত্রিভুজের ছবি মুহূর্তে এঁকে দেয়, এমনকি বৃত্তের কেন্দ্রও যথাস্থানে চিহ্নিত করে। অজয়বাবু অবাক হয়ে বলেন— বাঃ! এবার সংজ্ঞা লেখ।
শাগির মাথা চুলকে বলে— স্যার মুখস্থ হয়নি।
—তাহলে ছবি মনে রাখলি কীকরে।
—স্যার ত্রিভুজ হল কুঁড়েঘরের তেকোণা চাল, আয়তক্ষেত্র হল ঘরের দেওয়াল আর বৃত্ত হল মানুষের মাথা। কথা শেষ হতে না হতেই অজয়বাবু শাগিরের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকেন— আর এই হল তোর মাথা।

শেষে চুল ছেড়ে দিয়ে বলেন— না, তোকে দিয়ে অঙ্ক হবে না। আর ধৈর্য রাখতে পারেন না, খাতা নিয়ে ক্রুদ্ধ অজয়বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন— তুই অ্যানুয়ালে অঙ্কে শূন্য পাবি।
—না, স্যার পাশ করব। শাগির ধীরে ধীরে বলে।
অজয়বাবুর কথাটা কানে যেতেই দরজা থেকে ঘুরে আসেন। —কী বললি, পাশ করবি?
—হ্যাঁ, স্যার পঞ্চাশ পাব।
—এই তোরা শাগিরের কথা শুনেছিস তো।
ছাত্ররা চেঁচিয়ে বলে— হ্যাঁ।
—এবার আমার কথা শোন, ও অঙ্কে পঞ্চাশ নয়, যদি পাশ করে তবে ওকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা খাওয়াব।

কথাকটা বলে অজয়বাবু গটগট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান। ইতিমধ্যে কথাটা কানে যায় হেড মাস্টার নলিনীবাবুর। তিনি সেদিনই শাগিরকে ডেকে আলাদাভাবে কথা বলেন। দিন যায়। শাগির আগের মতই। অজয়বাবু ওকে আর কিছু বলেন না, শুধু মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেন— অঙ্কে পাস করলেই এক হাঁড়ি রসগোল্লা। দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে যায়।
শাগির অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে হাসতে হাসতে বেরোয়। বেরিয়ে অজয়বাবুকে দেখেই পাস কাটিয়ে দ্রুত চলে যায়। পরীক্ষার সময় পাশের ছেলেরাও দেখেছে— শাগির একমনে খাতায় অঙ্ক করেছে।

এরপর পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল শাগির অঙ্কে পেয়েছে পাঁচ। এইট পর্যন্ত পাশ ফেল নেই— তাই অঙ্কে ফেল করে বিবেচনায় শাগির সেভেন থেকে এইটে উঠেছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে এইট সি-তে প্রথম ক্লাস নিতে শাগিরের ঘরে হাজির অজয়বাবু। শাগির তো অবাক।
ক্লাসের ফার্স্ট বয় উঠে দাঁড়িয়ে বলে— স্যার, এটা তো বিজয়বাবুর ক্লাস।
—জানি। আমি আজকের জন্য বদলে নিয়েছি। শাগির তুই অঙ্কে কত পেয়েছিস।
—পাঁচ।
—তাহলে রসগোল্লা হল না।
—স্যার, শূন্যের তো দাম নেই, পাঁচের পরে বসিয়ে দিলেই পঞ্চাশ, আর রসগোল্লা। শাগিরের কথা শেষ হতে না হতেই হেড মাস্টার ঘরে ঢোকেন— স্যার আসছি। —হ্যাঁ আজ শাগিরকে আমি রসগোল্লা খাওয়াব।
কী ব্যাপার!
শাগির শঙ্কর ইন্টার ন্যাশানাল চিল্ড্রেন আর্ট কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছে। ও আজ আমাদের এই ছোট স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছে।
অজয়বাবু অবাক হয়ে বলেন— এসব কবে ঘটল!

নলিনীবাবু বলেন— শাগিরের আঁকা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই, তখনই ঠিক করি ওর আঁকা শঙ্কর চিল্ড্রেন আর্ট কম্পিটিশনে পাঠাব। ওকে প্রথমিক একটা ধারণা দিয়ে বাড়ি থেকে এঁকে আনতে বলি, তারপর সেই আঁকা পাঠিয়ে দিই।
—আজই ওরা স্কুলে মেল করে জানিয়েছে।
অজয়বাবু বলেন— আমি তখনই জানতাম, ও ছেলের অঙ্ক হবে না তবে আঁক মানে আঁকা হবে।

—তা ওর আঁকাটা কি আছে স্যার?
—আসলটা তো পাঠিয়ে দিয়েছি, তবে ছবির একটা কালার জেরক্স মানে ফোটোকপি করিয়ে রেখেছিলাম। এই দেখুন। বলে হেড মাস্টার সকলের সামনে ছবিটা মেলে ধরেন। একটা স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছাত্র রাস্তা দিয়ে মায়ের হাত ধরে পিঠে ভারি ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে রাস্তার পাশে মাঠে ঘুড়ি নিয়ে ছুটন্ত একটা ছেলের দিকে তাকাচ্ছে। ছবির নাম— শৈশব।
আঁকা দেখে সকলে হাততালি দিয়ে ওঠে। অজয়বাবু ডাকেন— শাগির উঠে আয়।
শাগির জড়সড় হয়ে অজয়বাবুর কাছে এগিয়ে যেতেই অজয়বাবু ছোটখাটো শাগিরকে দু’হাতে করে জাপটে তুলে ধরে চেঁচিয়ে উঠেন— থ্রি চিয়ার্স ফর শাগির, হিপ হিপ—
ছেলেরা চেঁচিয়ে ওঠে— হুররে!

News Hub