শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
সকালের কুয়াশাটা যেন কাটতেই চাইছে না কিছুতেই। হাতড়ে হাতড়ে পথ চলতে হয়। বেণু তার ভিতরেই তড়িঘড়ি পৌছে গেল সাঁইত্রিশ নম্বরে। এই আবাসনে প্রতিটা বাড়ি একইরকম দেখতে। একই রকম দরজা, জানলা, বারান্দা, এমনকি ঘরের আলোগুলোও একরকম। তাই ঠিক কোন বাড়িতে পৌঁছোতে হবে, সেটা ঠিক করতে এই নম্বর মিলিয়ে নিতেই হবে।
সাঁইত্রিশ নম্বরের নীচে গারাজে একটা ছোট জটলা হয় রোজ। ওই জটলার পাণ্ডা নমিতা। এই আবাসনে কাজ পেতে হলে নমিতাকে এড়িয়ে ঢোকা অসম্ভব। অবশ্য বেণুর ঘটনাটা আলাদা। সে তো বৌদিদের বাড়ি কাজ করছে আজ প্রায় পনেরো বছর হল। বৌদিরা এপাড়ায় বছর দু’য়েক হল এসেছে। তার আগে ছিল যে পাড়ায়, সেই ফ্ল্যাটগুলো এতো বড় ছিল না। কমপ্লেক্সটাও ছোট ছিল। এখানে ঢুকতে বেরোতে গেটে আই কার্ড দেখাতে হয়। তারপর ঘরে ঢোকার আগে নমিতাকে সেলাম ঠুকতে হয়। নাহলে খুব সমস্যা। অবশ্য সে সমস্যা সৃষ্টি ইতিমধ্যে করেনি নমিতা, এমন নয়। নমিতার সাগরেদ সন্তোষী আর লক্ষ্মী। দু’জনেই ফেউয়ের মতো লেগে থাকবে পিছনে। কোন বাড়িতে দুপুরে কী রান্না হল, কোন বাড়ির পুরুষমানুষ চরিত্রহীন, কোন বাড়িতে কখন কে ঢুকছে, বের হচ্ছে, সব জানা চাই। এর ভিতর বেণুর জ্বর এল। হাত পা গিঁট হয়ে আছে, ওষুধে কাজ হচ্ছে না। এদিকে বৌদির বাড়ি বাবুর অ্যানুয়াল। সিক্স থেকে সেভেনে উঠবে। রান্নাবান্না টিফিন দেওয়া, সবকিছু বেণু একা হাতে করে। তখন সুযোগ বুঝে নমিতা কোপ মেরেছিল। পাশের বস্তির একটা নতুন মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বৌদির বাড়ি। বেণু ভেবেছিল তার কাজটা এবার গেল। এতো বড় শহর, এতো ঘর, এতো কাজ। তবু কাজ পাওয়া সহজ নয়। তার মতো একলা মেয়েছেলের জন্য তো নয়ই। তার ওপর আবার যদি সেন্টার জানতে পারে বরের সঙ্গে থাকে না সে। কুপ্রস্তাব আসবেই নানা রকম। সেবার অবশ্য বৌদি বাঁচিয়ে দিয়েছিল বেণুকে। কাজটা যায়নি তার। কিন্তু তারপর থেকেই নমিতার সঙ্গে ক্ষারটা আরেকটু বেড়ে গেছে যেন। সরাসরি উপেক্ষা করার উপায় নেই। ওই চোখাচোখি হলে কায়দা করে সরে যেতে হয়। ঘন কুয়াশার ভিতরেও অবশ্য আজ বেণু নমিতাকে এড়িয়ে যেতে পারল না।— কী মহারাণী? জেল্লা তো বাড়ছে দিন দিন! মুখে একটা লাজুক হাসি টেনে লিফ্টে উঠে পড়ল বেণু। বাবু স্কুল যাবে। অনেক কাজ পড়ে আছে ঘরে। সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করলে চলবে না।
ঘরভর্তি কাগজের কুচি ছড়িয়ে রেখেছে বাবু। দাদা কিছুদিন হল বাইরে আছে। বেণু ঠিক বুঝতে পারে না সবটা। তবে এটুকু বোঝে বাবুর বাবা, অর্থাৎ দাদা একটা বড় অফিসে কাজ করে, যার জন্য কাজের সুবাদে মাঝে মাঝেই কলকাতার বাইরে থাকতে হয়। বৌদি সেই সময়টা কেমন মুষড়ে থাকে। বেণুর সঙ্গে কথা বলে মাঝেমধ্যে। নাহলে টিভি খুলে বসে থাকে থাকে সারাদিন। জামাকাপড়গুলো ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে গাছে জল দিতে বসল বেণু। ফ্ল্যাটবাড়ির একমাত্র ফুসফুস একচিলতে বারান্দা। সেখানে টব পেতে নানান রকমের গাছ করেছে বৌদি। দাদা না থাকলে এই গাছগুলোই বৌদিকে খানিকটা হাসিখুশি রাখে। ওভেন জ্বালিয়ে ভাত বসিয়ে দিল বেণু। আড় চোখে দেখে নিল ঘড়ি। এক ঘন্টায় বাবুর কারপুল চলে আসবে নীচে। ঘরে ঝাড়ু দিতে দিতে বেণু দেখল, বৌদি এখনও বিছানায় শুয়ে আছে। শরীর ভালো নেই! জ্বর এল? —টেবিলের ওপর থেকে ওষুধটা এনে দে না বেণু। টেবিলে একটা ওষুধের ফয়েল পড়ে আছে। সেটা এনে দিয়ে বেণু বলল, ‘শরীরটা খারাপ বৌদি?’ বৌদি বেণুর দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আজকাল হাড়ে খুব যন্ত্রণা হয় জানিস। ইউটিউবে দেখছিলাম, ভিটামিন-ডির অভাব হলে এমন হয়। মাছ খেতে বলছে। কে এনে দেবে মাছ? তোর দাদাবাবু থাকলে এনে দিত। অনলাইনের মাছ ভালো না। বাবুও তো মাছ খায় না।’
আবাসনে ঢোকার পঞ্চাশ পা আগে একটা তেমাথা আছে। সেখানে একটু বেলা হলে শনিবার রবিবার মাছওলা বসে। বেণু দেখেছে। তাই খানিক ভেবে সে বলল। —আমাকে খানিকটা টাকা দিও না বৌদি। কাল তো শনিবার। এনে দেব। —বেশ। নিয়ে আসিস। ঘরের ময়লা ফেলতে সেই নীচে গ্যারাজে একবার যেতে হবেই। গ্যারাজে ময়লা ফেলার ড্রাম আছে। প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টে নিজস্ব। বাবুর রান্না হয়ে গেলে ওকে কারপুলে তুলে দিয়ে টুক করে ময়লা ফেলতে গেল বেণু।খানিকটা সংশয় হচ্ছিল ভিতর। নমিতাকে চোখাচোখি করতে চাইছিল না সে। কিন্তু নীচে নেমে সে দেখল তেমন কেউ নেই। ময়লা ড্রামে ফেলে লিফ্টে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। গ্যারাজের এক কোণে বসে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা এ পাড়ায় নতুন। বয়সে তার থেকে কয়েক বছর ছোটই হবে। ইতস্তত করে এগিয়ে গেল বেণু। —কী হয়েছে তোর? চোখ মুছে মুখ তুলে সন্ধ্যা বেণুর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘কই, কিছু না তো?’ —জামশেদ আবার বলেছে কিছু? সন্ধ্যার চোখ ছলছল করে। এই সন্ধ্যাও তার মতোই দলছুট। নমিতার দলবল তাকে বিশেষ নাগাল করতে পারেনি। কাজ সেরে ফেরার সময় অটোতে মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে দেখা হয় বেণুর। ও যেদিকটায় থাকে, সেখান থেকে বেণুর বাড়ি দশ-বারো পা। হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা বলেছিল একদিন সন্ধ্যা। সে জামশেদকে ভালোবাসে। সন্ধ্যারও বেণুর মতোই বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু টেকেনি। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সন্ধ্যা এপাড়ায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। জামশেদ শাটারিং করে পাশে একটা কনস্ট্রাকশনে। মাঝে মধ্যে চলে আসে সন্ধ্যার কাছে। কথায় কথায় বলছিল সে। সন্দেহ করে জামশেদ। প্রায়শই হাত চলে তার। বেণু দেখল সন্ধ্যার বাম চোখে কালশিটে পড়ে আছে। —আবার মেরেছে তোকে? —আমি পালিয়ে যাব দিদি। বাঙ্গালোর চলে যাব। নম্বর পাল্টে ফেলব। —আচ্ছা। সে করবি নাহয়। কাজ হয়ে গেছে তোর ফ্ল্যাটে? —হ্যাঁ। —চল। তাহলে ওই জলের ধারে গিয়ে বসি। আবাসনের মাঝবরাবর একটা বড় জলাশয় আছে। তার চারপাশে বাহার করে পায়ে চলার রাস্তা করা। পাশে ছোট ছোট মোড়ার মতো সিমেন্টের বসবার জায়গা। সন্ধ্যা হলে ফ্ল্যাটের আবাসিকরা সেখানে খানিকটা মুক্তবাতাস নিতে আসে। সকালের কুয়াশা এখন আর নেই। বাবু বেরিয়ে যেতে এখন কাজ খানিকটা হাল্কা। তাই সন্ধ্যাকে নিয়ে জলের পাশেই একটা মোড়ায় বসল বেণু। —ছেড়ে দে ছেলেটাকে। এতো কষ্ট দিচ্ছে তোকে। —ছাড়বে না দিদি। মাঝেমাঝে বলে, আমাকে নাকি খুন করে দেবে। —তাহলে বিয়ে করে নে। —করবে না গো। রোজগের নেই। একটা এজেন্সি পেয়েছি। বলেছে মাসে আঠারো হাজার দেবে। প্রথম তিন মাসের অর্ধেক মাইনে ওরা নেবে। বাঙ্গালোর যেতে হবে। দিনরাতের কাজ। ভাবছি চলে যাব। —একা একা। পারবি? —কী হবে বলো দিদি? প্রতিদিন তিলতিল করে মরার থেকে তো ভালো!
ঘরে এসে বৌদির জন্য গরম জল করে দিতে বসল বেণু। এই সময়টা বৌদি ভেপার নেয়। জলে আঁচ দিতে দিতে ভাবছিল বেণু। বরকে সে ছেড়েছে দশ বছর হলো। রোজ রাতে সেই মদ খেয়ে চিল্লাচিল্লি মারধর। ছেলেকে রেখে এসেছে গ্রামে। তিনমাসে একবার গঙ্গাসাগরে ছেলেকে দেখতে যায় সে। টাকা দিয়ে আসে। বাপটা এক পয়সাও দেয় না। এই শহরে সাহস করে একলা থাকার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না। মাঝেমাঝে এই শহরটাকে একটা জোঁকের মতো মনে হয় তার। সুযোগ পেলেই রক্ত চুষে নেবে। প্রথম বাড়িওয়ালা সুবিধার ছিল না। এক মাঝরাতে ঘরে ঢুকে এসেছিল। তারপর আর ওইপাড়ায় থাকেনি বেণু। এখন যেখানে থাকে, তার পাশেই একটা লেডিজ হস্টেল। দিনরাত মেয়েরা যাতায়াত করে। বাড়িওয়ালাটাও বয়স্কা। অসুবিধে নেই। কিন্তু সন্ধ্যার ব্যাপারটা ভাবনায় ফেলে দিল তাকে। সন্ধ্যা কী করবে? আজকাল দিন ভালো নয়। কোথায় যেন একটা মেয়েমানুষের মাথা, হাত পা মাছকাটার মতো কেটে ফেলে রেখেছিল রাস্তার পাশে। পরে জানা গেল, তার মাশুকার কাজ। বড় ভয়ানক সময়!
সন্ধ্যায় বৌদি দুশো টাকা তুলে দিল বেণুর হাতে। ‘কাল মাছ আনিস তো।’ বাবু ফিরবে এখুনি। কেন যেন মনে হল বেণুর, বৌদি কি কাঁদছিল? চোখের কোণটা কেমন ফোলাফোলা। মনে হলেও মুখে বলতে পারল না বেণু। কতো কথা হয় বৌদির সঙ্গে। ঘরের কথা, গ্রামের কথা, ছেলের কথা। তবু একটা ভয় থাকে সবসময়। এরা সব বড় মানুষ। কখন কী মন পালটায়। এটা তার চাকরির জায়গা, একথা ভুললে চলবে কেন?
পরদিন আসার পথে বাজারে বেশ কয়েকটা মাছ পাওয়া গেল। মাছওয়ালাটা রসিক। হেসে বলল, ‘কেমন মাছ চাইগো তোমার?’ —রুই দাও। রক্ত হয় যাতে। শরীর যেন শক্ত হয়। —এতো রক্ত নিয়ে কী করবে শুনি?বলতে বলতে একটা রুই তুলে ফেলল দাঁড়িপাল্লায়। —সিলভার কার্প। ভালো করে রান্না করো। মাছ নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে বেণু দেখল নমিতাকে ঘিরে আজ জটলাটা বেশ বড়সড় হয়েছে। কোনও সিরিয়াস বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে মনে হল। বেণুকে আসতে দেখে লক্ষ্মী বলল। —এই। এদিকে আয় তো একবার। দিদি ডাকতাসে। ভয়ে ভয়ে বেণু বলল, ‘কী হয়েছে গো?’ —দিদির কাছে যা। জানতি পারবি। নমিতা কী যেন আলোচনা করছিল। বেণুকে আসতে দেখে বলল, ‘এই যে। এদিকে আয়। কথা আছে।’ —কী হয়েছে দিদি? —সন্ধ্যাকে গতকাল দেখেছিলি তুই? বেণু খানিকটা ভেবে নেয়। কতোটা বলা উচিত। কতোটা বলা উচিত নয়। মাপজোক করতে থাকে মনে মনে। —দেখেছিলি? —হ্যাঁ। —কী বলেছে তোকে? —কেন? কী হয়েছে? —পুলিশ এসেছিল আজ ভোরে। ও যে বাড়িতে কাজ করে। কীসব যেন চুরি গেছে। আর সন্ধ্যাকে পাওয়া যাচ্ছে না। —সে কী? —তোকে কী বলেছিল? —বলছিল নতুন ঘর দেখবে। কোথায় বলেনি। —ও। ঠিক আছে। যা। আবার আলোচনায় ডুবে যায় নমিতা। বেণু একমনে ভাবতে ভাবতে ওঠে। তবে কি সত্যিই বাঙ্গালোর চলে গেল সন্ধ্যা? কিন্তু চুরি? সন্ধ্যা চুরি করে পালিয়ে যাবে, এমনটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল বেণুর। ভাবতে ভাবতেই ফ্ল্যাটে বেল দিল সে। দরজা খুলে দিল দাদাবাবু। দাদাবাবু ফিরে এসেছে! কাল রাতে বোধহয়। সামান্য হেসে বলল, ‘ভালো আছিস বেণু?’ বেণু মাথা নেড়ে ঢুকে পড়ল। কাজের ফাঁকেই সন্ধ্যার জন্য একটা দুশ্চিন্তা আচ্ছন্ন করছিল তাকে। সেই দুশ্চিন্তা নিয়েই সকালের কাজ সেরে ফেলল সে। বৌদির মনমেজাজ আজ বেশ হাসিখুশি। বাবুর শনিবার স্কুল ছুটি থাকে। মনে হল, ওরা আজ বেরোবে কোথাও। দুপুরে ময়লা ফেলতে এসে গ্যারাজে আর কারোকে দেখতে পেল না সে। চারপাশে যেন এক থমথমে ভাব। দুপুরে মাছ খেতে খেতে দাদাবাবু বলল, ‘ভারি সুন্দর রেঁধেছিস বেণু। কাল আবার আনিস।’ রান্নাঘরে গিয়ে বেণু শুনতে পেল দাদা আর বৌদির মৃদু কথাকাটাকাটি হচ্ছে। তা হোক। আসলে বেণু জানে। তার জীবন আর এদের জীবন পাশাপাশি চলতে থাকা রেলের লাইনের মতো। চলতেই থাকবে। মিলবে না কখনও।
দাদা বৌদি বাবু সেজেগুজে বেরিয়ে যেতেই বেণুর ছুটি হয়ে গেল।মনটা ভালো ছিল বেণুর। দাদাবাবু ফিরে এলে তিনজন কেমন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে একনিমেশে।
ফেরার পথে গেটে যাবার সময় দেখা হয়ে গেল আসমার সঙ্গে। আসমা পঁয়তাল্লিশ নম্বরে কাজ করে। পথচলতি কথা হয় মাঝেমাঝে। —কী বেণুদিদি। আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল বুঝি? বেণু হাসল সামান্য। আসমা কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘জানো তো কী হয়েছে পঁচিশে?’ —কী? —ওই যে। সন্ধ্যা নামের মেয়েটা। ফ্ল্যাটের লোকগুলো কী বদ দেখো। পুলিশ ডেকে এনেছিল চুরির জন্য। —শুনলাম তো। তারপর? —তারপর আর কি? যে সোনার হার চুরি নিয়ে এতোকিছু, সেটা পাওয়া গেল ওই ফ্ল্যাটেই বেসিনের খাঁজে… কথা বলতে বলতে একটা বড় কালো গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল ওদের পাশ দিয়ে। গাড়ির কালো কাঁচ নামানো ছিল। একঝলক দেখতে পেল বেণু, গাড়ির পিছনের সীটে নমিতা আর এই আবাসনের সুপারভাইজার পাণ্ডেজি বসে। সেদিকে তাকিয়ে বেণু বলল, ‘তোমাদের নমিতাদিদি পাণ্ডেজির বাড়ি কাজ ধরল নাকি?’ আসমা বেণুর কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ‘এ বাবা। তাও জানো না?’ —কী? গলা নামিয়ে আসমা বলল, ‘কারোকে বলো না যেন। ওই পাণ্ডেজি তো নমিতাদিকে মাঝেমাঝেই ওর গেস্টহাউজে নিয়ে যায়।’ বেণু কথা বাড়ায় না আর। অটো স্ট্যাণ্ডে অটো নেই। আসমা পাশেই থাকে। যাবার আগে বেণু জিজ্ঞেস করল একবার, ‘আচ্ছা। সন্ধ্যার খোঁজ পাওয়া গেল?’ আসমা মাথা নেড়ে বলল, ‘জানি না গো।’
মাছওয়ালাটা সত্যিই রসিক। গুনগুন করে গাইতে গাইতে মাছ বেচছে। বেণুকে আসতে দেখে দুটো রুপোলি রুই তুলে বলল, ‘আজ দুটো নিয়ে যাও দিদিমণি। রক্ত হবে।’ —আজও ওই মাছই দেবে বুঝি? ওই একরকম মাছই রাখো বুঝি তুমি? বেণুর কৌতুকে মাছওয়ালা আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘যুগটা রুপোলি দিদিমণি। এখানে রুইমাছও রুপোলি, মানুষও রুপোলি।’ —মানুষ আবার রুপোলি হয় বুঝি? দোকানে ভিড় সামান্য কম আজ। কেন কে জানে? আজ তো রবিবার। ভিড় হওয়া উচিত। মাছওয়ালার নাম জুব্বার। বয়স শরীরে হলেও মনে ধরেনি তেমন। গলা নামিয়ে হেসে বলল, ‘শোনো দিদিমণি। এই যে দোকানে এতো কেক বিক্রি দেখ, বলো দেখি কী দেখে লোকে কেক কেনে?’ —কী দেখে? —কেকের ওপর রুপোলি রাংতা দেখে। কেক থেকে মিষ্টি, আসল জাদু ওই রাংতায়। মানুষের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। এই যে দেখছ এতো বড় গেট, বড় বড় গাড়ি, বড় বড় মানুষ, সব রুপোলি রাংতায় ঢাকা। রাংতা সরালে বুঝবে আসল চরিত্তির। এই জন্যই তো আমার এই রুপোলি রুইয়ের এতো দর। সবার প্রিয়। দরাদরি করে দশ টাকা কমিয়ে নিল বেণু। ফ্ল্যাটের নীচে আজ কোনও জটলা নেই। ফ্ল্যাটের একটা চাবি বেণুর কাছেই থাকে। ঘরে ঢুকে বেণু দেখল বসার ঘরে সোফার ওপর জামাকাপড় অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। বাবু ভিতরের ঘরে দরজা অর্ধেক বন্ধ করে পড়ছে। দাদাবাবু বাড়ি নেই। বেণু হাত ধুয়ে মাছগুলো সিঙ্কে রেখে রান্নাঘরে কাজে লেগে পড়ল। বৌদির ঘর বন্ধ। ঘুমোচ্ছে বোধহয়। ঘুমোক। কাজ গুছোতে গুছোতে ভাবছিল বেণু। সন্ধ্যার কী হল কে জানে! হারিয়ে গেল মেয়েটা? জামশেদ মেরে ফেলল না তো? কাজ সেরে কাপড়চোপড় মেশিনে দিয়ে বৌদির ঘরে ঢুকে চমকে উঠল বেণু। বৌদির ডান চোখের পাশে কালশিটে! ডান চোখের সাদা অংশে জমাট হয়ে আছে রক্ত। পড়ে গেছে বৌদি! সে কী! দাদাবাবু কোথায়? বৌদির কী হয়েছে?-তোমার কী হয়েছে বৌদি? —আমি চলে যাব বেণু। —কী হয়েছে তোমার?দাদাবাবু কোথায়? —দাদাবাবু কাল রাতেই চলে গেছে। —কী হয়েছে তোমার? —তোর দাদাবাবু আমাকে সন্দেহ করে। কী বলব তোকে বল। মারে আমাকে। গতকাল ব্যাট দিয়ে মেরেছে। বাবুর সামনে। বলে খুন করে দেবে আমাকে। বাবু বড় হচ্ছে। বাবুর সামনেই বলে। কী করব বল বেণু? —শান্ত হও দিদি। আমি বরফ এনে দিচ্ছি। —না রে। বস এখানে। আমি ফোন নম্বর পাল্টে নেব। অন্য শহরে চলে যাব। —বাবা মাকে জানিয়েছ বৌদি? —বিয়ের পর মেয়েদের বাবা মা থাকে বেণু? বল তো? তোর দাদাবাবু অন্য শহরে সংসার পেতেছে। আমি জানতাম না। কী বোকা দেখ আমি। বেণুবৌদির কালশিটে দাগের উফর বরফ লাগিয়ে দিতে থাকে। তারপর রান্নাঘরে মাছরান্নায় ফিরে যায়। কড়ায় রুপোলি রুই মাছের টুকরোগুলো দেখতে দেখতে তার হঠাৎ মনে হয় সে, সন্ধ্যা, বৌদি, সবাই যেন রুপোলি পাখনায় নিজেদের ঢেকে রেখেছে। ওই রসিক মাছওয়ালা ঠিক বলেছিল।