রহমত

অঙ্কিত চিত্র

তুহিন কুমার চন্দ

গলির মোড়টায় বসে সেই ছেলেটা বারবার চোখ মুছছিলো, পাশে মাছের খালইটা রাখা আছে, আর শুকিয়ে কাঠ হওয়া টানা জালটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রোয়াকটার কাছে। এই ছেলেটার নাম রহমত।

পিয়ালবনের পাশে যেখানে সবাই ময়লা ফেলে তারই পাশে শুকিয়ে মরে যাওয়া পিতরাজ গাছটার নিচে কোনোভাবে রাত কাটায়। বৃষ্টি এলে পরিত্যক্ত বিশাল পাইপে আশ্রয় নেয় সবাই।


রহমত, রহমতের মা, আর রহমতের ছোট বোন। বোনের বিয়ের কিছুদিন পরেই স্বামী ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় সেও এখন এখানেই থাকে। মা, বোন আর বেটার খাবার কোনদিন জোটে আবার কোনদিন কিছুই জোটে না। নদীর পাড়ে রহমত একটা ছেঁড়া জাল কুড়িয়ে পেয়েছিলো একসময়, সেটাকে জোড়াতালি দিয়ে খাল বিল থেকে মাছ ধরে তার বিক্রির পয়সায় কোনোভাবে দিন কেটে যাচ্ছিলো রহমতদের। বৃদ্ধা মা সারাবছর জ্বরে ঘরে পড়ে আছে। ছোট বোনটা প্লাস্টিক আর ক্যারিব্যাগ কুড়িয়ে কয়টা পয়সা পায় বটে কিন্তু তাতে কিছুই হয় না। নদীতে মাছ

মারতে গেলে ইজারাদার ধমকে তাড়িয়ে দেয় রহমতকে।
এখানের খালবিল সব শুকিয়ে খাঁ-খাঁ করছে।

নদীতে এক হাঁটু জল। মাছ মারার কোনোই উপায় নেই। ঘোষালখুড়ো সেদিন ওর পুকুরে জাল ফেলতে বলায় রহমত সারাদিন ধরে কিছু শিং মাগুর আর চুনোপুঁটি ছাড়া কিছুই ধরতে পারেনি। খুড়ো বলেছিলো কয়টা শিংমাছ তুই নিয়ে যাস রহমত। ঘোষালখুড়োর দেওয়া পাঁচটা শিংমাছ আবুলের মা তিন টাকায় কিনে নিয়েছিলো। এদিন রবিবারের হাট থেকে ওই টাকায় রহমত কিছু মুড়ি আর কিছুটা গুড় কিনে সে রাতের মতো ক্ষুধা মিটিয়েছিলো বটে কিন্তু কাল কী খাবে এটা ভেবেই রহমতের কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। গলির মোড়ে বসে তাই চোখের জল ফেলছিলো রহমত।

এখানের খালবিল শুকিয়ে গেলেও পাশের গ্রামের কিছু নালায় নাকি এখনো কিছুটা জল আছে। পরদিন ভোরবেলায় রহমত সেই ছেঁড়া জালটা নিয়ে গোপালপুরের দিকে রওনা হলো। হাঁটতে হাঁটতে দুপুর গড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। কোথায় নালা, কোথায় বিল আর কোথায়ই বা জল। সব জল শুকিয়ে ফুটিফাটা হয়ে আছে। কোথাও সে আর জাল ফেলতে পারেনি। ক্লান্ত শরীরে নিজের গ্রামে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে হয়-হয়।
রহমত বুঝতে পারে মাছের ব্যবসাটা আর বেশীদিন চলবে না। জল না থাকলে মাছ পাবে কোথায়। অনেক চিন্তা করে পরেরদিন গঞ্জের মহাজনের কাছ থেকে এক কেজি বাদাম কিনে একটা ভাঙা ঝুড়িতে করে গ্রামের যেসব জায়গায় মানুষজনের জটলা হয় সেখানে বাদাম ফেরি করে। বেশ ভালোই রোজকার হয় তাতে। অন্তত একবেলা ভালোভাবেই হয়।

পাড়ার পাঠশালার কাছে, গ্রামের মাঠে যেখানে ছেলেরা খেলাধুলো করে সেসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করে রহমত।
আগামী বুধবার নদীর চরের মাঠে ফুটবল খেলা হবে শুনে বেশ কিছু বাদাম নিয়ে এসেছিলো রহমত। ভালোই লোকজন এসেছিলো খেলা দেখতে।

দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদে খেলা শুরু হয়েছিলো। চরের মাঠের চারদিকে কোনও গাছপালা নেই। নদীর পাড়ে যে কয়টা ছিলো তাও রোদে পুড়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোথাও কোনও ছায়া নেই। অনেকের মাথায় ছাতা ছিলো বটে কিন্তু সেটাও হাতে গোনা কয়েকজনের।
এই গরমে বাদামের বিক্রিও প্রায় নেই। রহমত মাথায় গামছা দিয়ে কেবল ক্রেতা খুঁজছিলো।

এতক্ষণে পাহাড়পুরের দল একটা গোল দিয়ে দিয়েছে কানাইগঞ্জকে। সারাটা মাঠ এখন বেশ থমথমে। শরীরের ঘাম চুষে খাচ্ছে সূর্যের তেজ।
আবার খেলা শুরু হতেই অনেকেরই গরমে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। হারানখুড়ো বলল, আর নয়রে এবার বাড়ি চল। খুড়োর নাতি দেবল বলল— আর কিছুটা থাকলেই তো খেলার শেষটা দেখে যেতে পারতাম দাদু।
—নারে বাবা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এই গরমে। বাড়ি চল।

এ গ্রামের প্রায় সব জায়গায় জলের খুব কষ্ট। টিপ কলে আর জল আসে না। কুয়ো ইঁদারায় এক ফোঁটাও জল নেই। ঘোষালপুকুরের জল সারা গাঁয়ের ভরসা। তাও আর ক’দিন। ক্রমশ জল শুষে নিচ্ছে সূর্যের তেজ।

গত কয়েকদিনে এ গাঁয়ের অনেক ক’জন অসুস্থ হয়ে পড়েছে গরম আর জলের কষ্টে। জলের অভাবে গবাদি পশু ছাড়াও বনের পাখিরা কাতারে কাতারে যেখানে সেখানে মরে পড়ে আছে। সবুজ ঘেরা গ্রামটার চারদিকের প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছিলো গত কয়েকবছরে। গ্রামটা যেন এক মৃত নগরীর রূপ নিয়েছে।

খেলার মাঠে হঠাৎ কী এমন হলো যে সবাই চারদিক থেকে মাঠের মাঝখানে জড়ো হচ্ছে।
রহমতও সেখানে ছুটে গেলো। মাঠের এককোনে পাহাড়পুরের গোলকিপারকে সটান শুইয়ে রাখা হয়েছে। প্রচন্ড গরমে গোলকিপার অজ্ঞান হওয়ায় এই বিপত্তি।

গোলকিপার শুধু জল জল বলে জল চাইছে। কারো কাছে এইমুহূর্তে একফোঁটা জলও নেই।
সবার মুখেই শুধু এক কথা জল আনো, জল আনো। কিন্তু জল পাবে কোথায়। কারো কাছে থাকলেও মুখ ফুটে কিছু বলছে না। একমাত্র রহমত তার বাদামের ঝুড়ি থেকে একটা ছোট্ট বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল— এই যে দা’ঠাকুর আমার কাছে একটু আছে গো। রহমতের জলটুকু গোলকিপারের মুখে দিতেই সম্পূর্ণ জল ঢকঢক করে গিলে নিয়ে গোলকিপার চোখ মেলে চারদিকটা দেখতে লাগলো।
খেলা আর হলো না।

দর্শকদের মধ্য থেকে গোঁসাইজ্যেঠু বলল— যেভাবে গাছ কাটা হয়েছে তাতে অক্সিজেন যেমন শেষ হচ্ছে আর প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় অনাবৃষ্টির ফলে জলের অভাব ঘটছে।

অক্সিজেন আর জলের অভাবে মানুষজন যেমন মৃত্যুকে ডেকে আনছে তেমনি আমাদের চারপাশের জীবজগত ধ্বংস হচ্ছে। গোল কিপারের ডিহাইড্রেশনের জন্যই এই বিপত্তি।

এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে উপায় একটাই, চারদিকে শুধু গাছ লাগাতে হবে।
রহমতের মনে কথাগুলো খুব ভালো লেগেছিলো। জীবনধারণের জন্য অনেক কিছু নতুন পথের সন্ধান পেল রহমত।
ঠিকই তো, গুপ্তপাড়ায় ক্ষুদিবুড়ির একমাত্র দুধেল গরুটা অনাহারে জলের অভাবে দিনকয় আগে মাঠে মরে পড়েছিলো। অনন্তকাকার হাঁসগুলো রাতারাতি মরে গেলো। সজনে গাছে দৈনিক যে পাখিগুলো বসে ডাকতো, দোয়েলের শিস, টুনটুনির সারাদিনের ব্যস্ততা আর দেখাই যায় না। তবে কি ওদের অবস্থাও ক্ষুদিবুড়ির গরুর মতোই।

এইসব কথা মাথায় নিয়ে রহমত মোড়লপাড়ার বাঁকটা ঘুরতেই রেশমাদের বাড়ি। ওরা তো আচার তৈরি করে বিক্রি করে। রহমত বাঁশের বেড়াটা সরিয়ে রেশমাকে জোরে জোরে বারকয় ডাকতেই রেশমার মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল— হ্যাঁরে এই পড়ন্তবেলায় এমন চেঁচামেচি করছিস কেন রে রহমত! আজ কিন্তু কিছু দিতে পারবো না বলে দিলাম।
রহমত বলল— না না তেমন কিছু চাইতে আসিনি চাচি। তোমাদের ফেলে দেয়া কিছু জিনিস আমাকে দেবে গো চাচি।
—কী জিনিস রে!
—বিচি।
—কিসের বিচি।
—যে কোন ফলের বিচি।
—ওগুলো দিয়ে তুই কী করবি রহমত।
—আমি মাটিতে পুঁতবো, চাচি।
—মাটিতে পুঁতবি! কেন?
—ওই বীজ থেকে গাছ হলে জলের কষ্ট কমবে আর চারদিকে সবুজ গাছ আমাদের অক্সিজেন বিলোবে, চাচি।
—সত্যি তুই একটা পাগল। রান্না ঘরের পিছনে দেখ কতরকম বীজ আছে, যা লাগবে তুই নিয়ে যা বাপ।

রান্নাঘরের পিছনে গিয়ে রহমত দেখলো সেখানে আমড়া, তেঁতুল, আম আরো কতরকম বীজ রয়েছে। রহমত বাদামগুলো গামছায় বেঁধে বাদামের ঝুড়িতে নানান রকমের বীজ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।

রহমতের বোন ভাদ্র মাসে অনেকগুলো তালের আঁটি কুড়িয়ে এনেছিলো আঁটির ভেতরে শাস হলে তা বাজারে বিক্রি করবে বলে। রহমত বোনকে সব কথা বলতেই বোন বলল— ওগুলোও তো মাটিতে পুঁতে দেয়া যাবে ভাই।
রহমত বলল— নিশ্চয়ই।

বীজ তো পাওয়া গেলো ঠিকই কিন্তু তার জন্য গাঁইতি, কোদাল বা শাবল লাগবে যে! চারদিকে দুই ভাই বোন সেরকম কিছুই খুঁজে পেলো না। শেষে ঘোষালদের নোংরা ফেলার জায়গায় অনেক খুঁজে রহমত একটা ভাঙা কোদালও পেয়ে গেলো ওই ফেলে দেয়া জিনিসপত্রের মধ্যে।
ভোর হতে না হতেই দুই ভাই বোন কোদাল কাঁধে বীজ লাগানোর জন্য এই গরম হাওয়ায় চললো গাছ লাগানোর কাজে।

ঘোষালদের পুকুরপাড়ে তালের বেশ কয়েকটা বীজ পুঁতে দিলো। ওদের কান্ড দেখে পাড়ার ছোট থেকে বড়রা প্রথমে হাসাহাসি করলেও পরে দল বেঁধে বীজ পুঁততে লাগলো।
দিনকয় চললো এই বীজ পোঁতার উৎসব।
চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায় বসে তারিণীখুড়ো বলল— এতদিনে সবার সুমতি হয়েছে রে।

একটা কথা সবাই যেন মনে রাখে, যদি কেউ গাছ কাটতে আসে, তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে গাছ আমাদের প্রকৃত বন্ধু।
এদিকে খেলার মাঠের দিকে সবাই প্রায় মিছিল করে চললো। মাঠের চারদিকে বীজ পোঁতা হবে তার প্রথম বীজ পুঁতবে আনাদের তারিণীখুড়ো।
কথাটা কানে আসতেই তারিণীখুড়ো বলল— না আমি নই। এই মাঠের চারদিকে বীজ পোঁতা উৎসবে প্রথম বীজটি পুঁতবে আমাদের চোখ খুলে দেবার জন্য সেই সাহসী ছেলেটা, যে অনেক কষ্টে দারিদ্রকে জয় করতে শিখিয়েছে, আর শিখিয়েছে, বুঝিয়েছে প্রকৃতিকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়। সে আমাদের রহমত।

মাঠের এককোনে সেই রোগা পাতলা রহমতের চোখে তখন আনন্দের অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশের বুক চিরে কয়েকটা বালিহাঁস কোন বিলের দিকে উড়ে যাচ্ছে হয়তো জলের সন্ধানে।

রহমতের লাগানো বীজ একদিন মহীরুহ হবে সেদিকেই তাকিয়ে আছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। রহমত তার হাত দু’টি আকাশের দিকে তুলে ঈশ্বরকে ডেকে বলছে— আল্লা রহম করো। আল্লা মেঘ দাও, আল্লা পানি দাও।

লাল গোলাকার সূর্যটা তখন পশ্চিম দিগন্তে ডুবে যাচ্ছে। খুশির হাওয়ায় সারাটা গ্রাম শুধু তাকিয়ে আছে আগামী প্রজন্মের দিকে। আগামী ভবিষ্যতের দিকে।