সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘এই শহরটা তো আমার ছিল না কখনও, এখানে শৈশব কাটেনি, যৌবনও নয়। তবে? বিয়ে ভাঙা মেয়ে এক বছরের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে উদ্বাস্তু? ভাবলে কৌতুকবোধ হয় বৈকি! মাত্র এক প্রজন্ম আগে এই তো সেদিন আমার পিতৃপুরুষ একবস্ত্রে প্রায় ভিটে মাটি ছেড়ে এসেছিলেন না এই শহরেই? পুনর্বাসন? এমন ইঁট কাঠ, ধোঁয়া ধুলোর মধ্যে পুনর্বাসন কোথায়? তাঁরাও কোনোদিন এই শহরের হয়ে উঠতে পারেননি আমিও নয়। তবু এখানেই— হ্যাঁ এখানেই। বুকে জারুলের বেগুনি পাপড়িগুলো ছড়াতে শুরু করেছে আবার। মনে পড়ছে সেই পাতা ঝরার মরশুম! খেলার মাঠের প্রান্তে একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জারুল, রাধাচূড়া, আর বিষাদ রঙের গোলাপি কেশিয়া ফুলের গাছ। চৈত্রমাসে তাদের দমকা হাওয়ায় পাতা ঝরার উৎসবে বিকেলগুলো রঙিন হয়ে উঠত! ঝরঝর করে সারাদিন পাতা ঝরছে, হলুদ, লাল, কমলা। দেখতে দেখতে আমাদের পায়ের গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে সেই পাতায়, আমরা হো-হো করে হেসে উঠছি, ছুটে যাচ্ছি, দু’হাতে কুড়িয়ে নিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছি বিপক্ষ হাওয়ায় সেই পাতার বিক্ষোভ অকারণ! সেদিন কি ভুল করেছিলাম? ঝরা পাতার থরো থরো কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়া মনে পড়ে। এমনি করে ছড়িয়ে যায় জীবন, জাবর কাটে স্মৃতি!
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এই শহর কখনও আপন হবে না, যেমন ভীষণ সুন্দর সাজানো হোটেল ঘর হয়ে ওঠে না কখনও। এখানে সিগনালে, দাঁড়াতেই রাস্তার বাঁ দিকে পলাশ ফুটেছে। তবু আমার শিমূল বেলা, পলাশ বেলা, আমার শিরীষের গন্ধ আর বিজন কাঁপানো মেঘ সন্ধ্যার আকাশ যেন পাগল শিল্পীর একলা ক্যানভাস! সে সব এখানে নেই, এখানে তৈরি হবে না কোনোদিন। আমি এখানে থাকব, ভাঙবো গড়ব নিজেকেই, এই শহর আমায় ভাঙতে বা গড়তে পারবে না। পারবে সেই মাটি! যেখানে আমার শিকড় পোঁতা আছে আর সেই শিকড় চারিয়ে গেছে তার অবচেতনের ভিতর। আমার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে সে আছে, এমন করেই কি থেকে যায়, যা কিছু হারিয়েছে? এই ভেবে খুঁজে বেড়াই সারাক্ষণ?’
একটানা কথাগুলো লিখে থমকে গেল ঝিল। আজ তার গল্প লেখার কথা ছিল না? এ সব কি লিখছে সে, আর কেনই বা লিখছে! এ তো গল্প নয়, এ তো আত্মকথা, আত্ম-পরিক্রমা। কে যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে! কে?
২
মাটি। হ্যাঁ আমারই ডাকনাম। আমি ওকে চিনতাম, কিন্তু অনেক বছর হল খোঁজ পাই না। এতদূর অতলে আমার তার বসতবাটি, তার ঘর, অন্য শহরে ঘর খুঁজবে কি সে? পাগল! আমি যে তার হৃদয় জোড়া সোঁদা সোঁদা আঁচল পেতে আছি! এই তো খিড়কি দরজার পাশে এইখানে ফুল কুড়ত মেয়েটা, অবাক শিউলি ফুল! আর ফুল তাকে কুড়ত, জড়ো করত, সাজাত, মালাও গাঁথত, প্রত্যেক বছর। মৃদু গন্ধে আমোদিত সেই সব উঠোন ঘেরা পাঁচিলতোলা গাছগাছালির রোদ্দুর আর ছায়ার এক্কা-দোক্কা খেলায় আমিও তো ছিলাম! আমি মাটি, আমার বুকে যেমন আগুন তেমন জল। ছলাৎ ছলাৎ রূকরূকার মতো নয়, ছোট্ট মেয়ের চোখের মতো স্থির। তখনও সে বিদ্যুৎ শেখেনি। সেই সময় আমার বুকে পাটকাঠি দিয়ে আঁচড় কেটে ছবি আঁকত, সদ্য ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরতে শেখা মেয়েরা যখন বড়দের লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া ছেলেদের সঙ্গে গাছের আড়ালে ভয়ে ভয়ে কোনও বুক কাঁপানো বিকেলে যখন দেখা হতো।
সেই মেয়েটার বাড়ির বাগানে ভুঁইচাঁপা ফুটেছিল। সে কী আনন্দ! লম্বা পাতাওয়ালা গাছটাকে আমি অনায়াসে ভ্যানিশ করে দিতেই আমার শরীরে ফুটে উঠল একরাশ হালকা বেগুনি রঙের ফুল! কী যে আনন্দ হল আমার! ছোট্ট মেয়ে আমায় দেখে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে উঠল, ‘মা দেখ, ভুঁইচাঁপার ফুল!’
আমি তখন তাকে দেখছি! সে জানে না সে নিজেও ভুঁইচাঁপা আর কদিন বাদেই! পাপড়ি মেলবে, পাতার আড়াল লাগবে না!
তার আগে, শুধু একবার খিড়কি দরজা খুলে বাইরে যাবে সে দুপুরবেলা। তখন তাদের উঠোনের কোনায় সদ্য বড় হয়ে ওঠা আম গাছটায় আমের বোল এসেছে। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ তার! স্নান সেরে, হলুদ রঙের ফ্রক পরে সে উঠোনে এল। খিড়কি দরজার শিকল তোলা থাকত, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঠে সেদিন নাগাল পেল সে। বাগান পার হয়ে পৌঁছে গেল ছাইগাদায়। সেখানে ওদের বাড়ির মাটির উনুনের ছাই ফেলা হত আমার ওপর। সেই ছাই অস্বীকার করে বেড়ে ওঠা কুমড়োর লতা আর সন্ধ্যামালতি ফুলের ঝুমরো গাছটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে! ঠিক তখনই উঠোনের কালো জামগাছের পাতার আবডাল থেকে ডানায় কাঁচা হলুদ বিস্ময় মেলে একটা বসন্তবৌরি উড়ে উঠৈই হারিয়ে গেল উত্তরের চা বাগানের ওপর। বুকখোলা আকাশে তখন অনেক উঁচুতে পাক খাচ্ছিল একটা চিল আর বিষণ্ণতা। তার ঝুমরো চুল হাওয়ায় উড়ছিল। একটু ভয় পাচ্ছিলাম আমি, যেন ছাইগাদায় ভাঙাচোরার জঞ্জালে ওর পা না কেটে যায়! ভীষণ আনমনা ছিল যে! বুঝেছিলাম বড় হয়ে যাবে এইবার!
৩
মোবাইলের শব্দে চমক ভাঙল। ঝিল নামটা দেখল, ইনবক্স খুলল না। জানতে ইচ্ছে করছে না কেন কী লিখেছে তীর! আসলে সে তো এখন ছাইগাদায়!
পুপুন দাদা বলে দিয়েছিল তাকে দুপুরবেলা ছাইগাদায় আসতে! ছাইগাদায় রান্নাঘরের নোংরা ফেলে বিমলাদিদি রোজ। উনুনের ছাই, শাকসবজির খোসা, ডিমের খোলা, এটা ওটা, এখানে মিশে গিয়ে নাকি সার হয়ে যায়! এই সব জমতে জমতে ছোটখাটো একটা টিলা, তাতে জংলি ঘাস, কুমড়ো লতা, সন্ধ্যামালতি আর মধুফুলের গাছ গজিয়েছে। সে নিচু হয়ে ছোট্ট সাদা মধুফুল ছিঁড়ে নিয়ে মুখে দিল। এই ফুলের মধু খুব মিষ্টি, কিন্তু এখন ভাল লাগছে না, কেমন ভয় করছে! কী বলবে পুপুনদাদা তাকে এই ছাইগাদায়? আসলে পুপুনদাদাদের বাড়িটা ঠিক ওদের পিছনেই। জোরে ডাকলেও শুনতে পাওয়া যায়। কাকিমণি যখন রেগে গিয়ে বকুনি দেয় ওদের, চাইলে সব বকুনি শুনতেই পারে সে কিন্তু ইচ্ছে করে না। পুপুনদাদাকে বকলে মারলে তার কষ্ট হয়। কেন? কে জানে! পুপুনদাদার বোন মিঠুদিদি ওর বন্ধু। সে মিঠুদিদির সঙ্গে খেলতে যায় ছুটির দিনে। রান্নাবাটি, পুতুল খেলা, চোরচোর, রঙরঙ, আরও কত কী। যখন ওরা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত সাদা বকের সারির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বকমামা বকমামা দুধ দিয়ে যা’— অমনি ওদের নখে বকমামা দুধ দিয়ে যায়, অন্ধকারে তারা খসলে সেদিকে তাকিয়ে আর চোখের পাতা ঝরে পড়লে তাতে ফুঁ দিয়ে নিজের নিজের ইচ্ছেমতো যা চায় ওরা, তখনি একে অন্যকে বলেও দেয়। কিন্তু এই কথাটা সে মিঠুদিদিকে বলতে পারেনি, পুপুনদাদা যে কথাটা ওকে চুপি চুপি বলেছিল বেরোবার সময়!
সেদিন ছিল রবিবার। মিঠুদিদির সঙ্গে ওদের বাড়িতে খেলতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল সে, পুপুনদাদা ডাকল। পুপুনদাদা অনেক বড়, পাজামা পরে, ঠোঁটের ওপর কালচে রোঁয়ার মতো গোঁফের রেখা, সব সময় পড়াশোনা করে, ক্লাস টেন। তাকে একটু ভয়ই পেত ও। একটুখানি।
‘এই শোন, আজ দুপুরে দুটোর সময় তোদের পিছনের দরজার বাইরে আসিস ছাই গাদায়, তোকে একটা জিনিস দেব। আসবি কিন্তু, ঠিক আছে?’
পুপুনদাদার গলার স্বরটা কেমন যেন ভাঙা ভাঙা, বোধহয় ঠাণ্ডা লেগেছে, নাকি কাকিমণি মেরেছে? কাঁদছিল নাকি পুপুনদাদা? ভাবতেই মায়া হল খুব, আর ভয় করল না।
‘আচ্ছা।’
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে এক ছুটে বাড়ি পালাল সে। পুপুনদাদা হাসছিল। হাসিটা সুন্দর। একটু পরেই সে আসতে মুখ থেকে মধু ফুল ফেলে দিয়েছিল। কীরকম যেন একটা ভয় করছিল, চিন্তু ভালও লাগছিল খুব। যদি কেউ দেখে ওদের ছাইগাদায়! ছাইগাদায় কেউ কথা বলে নাকি? তা ছাড়া পুপুনদাদা তো তার সঙ্গে কথাই বলে না। আজ কিন্তু অন্যরকম লাগছিল। পিছনের রাস্তা দিয়ে এসে, ওদের উঠোনের পাঁচিলের পাশ থেকে, ছাইগাদার ঘাসজমিতে সোজা উঠে এল পুপুনদাদা একেবারে ওর কাছে। ওকে দেখে একটু হাসল। হাসিটা পুপুনদাদার চোখ থেকে ঠোঁটে টুপ করে, যেন রঙিন মারবেল! অবাক হয়ে দেখছিল সে, পুপুনদাদাও ওকে দেখছিল। হঠাৎ ওদের আম গাছে একটা ঝটপট আওয়াজ হল, চমকে উঠেছে দু’জনেই!
‘কাক! ওদের বাসা বেঁধেছে ওখানে।’
ওর কথায়, পাজামার পকেট থেকে কী যেন বের করে ওর হাতের মুঠোয় গুঁজে দিল পুপুনদাদা, মুখে বলল—
‘এটা পড়ে যদি হ্যাঁ হয় দুটো আঙুল দেখাবি আর না হলে একটা, কেমন?’
তারপর একটু দূরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। পেস্তা রঙের পাজামা পরেছিল পুপুনদাদা আর ফুল হাতা স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট, কী অদ্ভুত, স্পষ্ট মনে আছে! জামাটা ওর বাবার মতো। সব ছেলেরা এরকমই পরে? ঝিলের দাদা নেই, ভাইও না। বাবা আছে আর ছোট কাকু। মিঠুদিদির কী মজা, দু-দুটো বড় বড় দাদা। বুবুনদাদা পুপুনদাদার চেয়েও বড়। টুয়েলভে পড়ে। মিঠুদিদির খুব আদর, ছোট বোন যে!
ঝিলের হাত কাঁপছিল। পুপুনদাদার ভেজাভেজা কাঁপাকাঁপা আঙুলগুলো ওর আঙুলে ছুঁয়েছিল কাগজটা দেওয়ার সময়। ও ছাইগাদাতেই দাঁড়িয়ে সেই চিরকুটের ভাঁজ খুলছিল। ছোট্ট কাগজের টুকরোটাও একটু যেন ভেজা। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে নীল কালিতে লেখা— ‘আই লাভ ইউ। তুই?’
কী বলবে ঝিল! সে তো জানেই না ভালোবাসলে কীকরে বোঝা যায়! গত সপ্তাহে বুবুনদাদা যদি মিঠুদিদির সঙ্গে পুতুল খেলার সময় হঠাৎ এসে ওর কানে কানে না বলত, ‘আমি তোকে ভালোবাসি’, তাহলে পুপুনদাদার এই চিঠিটাই প্রথম হত তো! সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঝিল। কত্ত বড় বুবুনদাদা ওরকম কেন বলল! আর এখন পুপুনদাদাকে এখন কী উত্তর দেবে সে? পুপুনদাদা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ভালোবাসা কাকে বলে? কিছু ভেবে না পেয়ে একটা আঙুল দেখিয়ে দৌড়ে খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে গিয়েছিল সে। পরে মনে হয়েছিল যাঃ পুপুনদাদা দুঃখ পাবে! মন খারাপ হল একটু। কথাটা ছোটপিসিকে জানাতে পিসি যে মাকে বলে দেবে আর মা যে মিঠুদিদিদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেবে তার কে জানত! মিঠুদিদি ওদের বাড়ি আসত কিন্তু পুপুনদাদার সঙ্গে আর দেখা হত না। এর কিছুদিন পরেই কাকু বদলি হয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন! সেই চিরকুটটা অনেকদিন ছিল ঝিলের পেনসিল বক্সে। স্কুল ছুটির একলা দুপুরে মাঝে মাঝে বের করে দেখেছে ও, সেটাও আস্তে আস্তে আবছা হয়ে ছেঁড়া-ছেঁড়া হয়ে একদিন হারিয়ে গেল। ঝিল অবশ্য তার অনেক আগেই সেই মন খারাপটা ভুলে গিয়েছিল। আজ এত বছর পর পুপুনদাদা! আশ্চর্য…
৪
ফেসবুক ছবিগুলোর ঝলমলে মধ্যবয়সী প্রোফাইলের মধ্যে কি ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায়? আচ্ছা! কী যেন একটা ডাকনাম ছিল মিষ্টি মতো— রাই! ওর কি মনে আছে সে দিনের কথা! ভাবতে গিয়ে নিজের মনেই হেসে ফেলল সে। মাঝখানে পঁয়তাল্লিশ বছর! তার নিজের কিন্তু বেশ মনে আছে! প্রথম ভালোলাগা বোধহয় ভোলে না কেউ আর এ তো প্রথম প্রত্যাখ্যান! আর কোনোদিন অবশ্য হারেনি তীর। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে নয়। চেম্বার শেষ করে ফেরার পথে রাই ফোন করেছিল আবার। হালকা দু-একটা কথা! ওর পুপুনদাদা নাকি বুড়ো হতে পারে না, এই সব। কথায় কথায় ওর একলা জীবনের পিঠোপিঠি উঠে এল তীরের নিজের কথাও। ঝকঝকে কেরিয়ারের ব্যস্ততা, ছবি আঁকার শখ, স্ত্রী আর কৃতি সন্তানদের নিয়ে জমজমাট জীবন। আশ্চর্য, দুজনেই ডাক্তারি পড়েছে ওরা শুধু দেখা হয়নি। হঠাৎ ওকে চমকে দিয়ে রাই বলেছিল—
‘পুপুনদাদা, তোমার মনে আছে, তুমি আমায় ছাইগাদায় কী দিয়েছিলে একদিন?’
‘মনে আছে তো! তোর মনে আছে? অনেক ছোট ছিলি তুই, পরে মনে হতো আমি কীকরে অত ছোট্ট একটা মেয়েকে— কী যেন বলেছিলাম— আঙুল দেখাতে— তুই অবশ্য একটাই দেখিয়েছিলি’—
‘তাই? মনে নেই তো!’
মিথ্যে কথা! মনে তো আছেই, প্রথম চিঠি আই লাভ ইউ—
‘এক আঙুল দেখিয়েছিলাম? কী জানি! ছোট ছিলাম তো, জানো বুবুনদাদাও তার আগে— তোমাকে কিন্তু আমার ভালই লাগত’—
উত্তর পঞ্চাশের গলায় কথা বলছে দুটি বালক বালিকা! অহেতুক এলোমেলো কথা যার জাগতিক মানেই হয় না আর!
‘তোকে আমি, আসলে আমরা চলে গিয়েছিলাম’
‘তোমার স্ত্রী কী করেন? হাউস ওয়াইফ না চাকরি?’
খুব সুন্দরী? মনে মনে এই প্রশ্নটা ব্লটিং পেপারে শুষে নিল সে। ভালোবাসো খুব? সুখী তো নিশ্চয়ই— ম্যাজিক স্লেটের লেখা মুছে ফেলা আবার।
‘তোমার প্রফেশনাল সাকসেস, প্র্যাকটিসে মূল্যবোধ খুব ভাল লাগছে জেনে’—
‘আমার স্ত্রী খুব ভাল মেয়ে, চাকরি করে, আমি অনেক বদলেছি ওর জন্য, খুব রাগ ছিল আমার… আমার প্যাশান এই প্রফেশন, হ্যাঁ তবে কম্প্রোমাইজ করি না, তুই তো অনেক স্ট্রাগল করেছিস, লিখিসও দারুণ’—
‘তুমি তো ছবি আঁকো— আমাদের অনেক মিল পুপুনদাদা’—
কেজো কথাগুলো আড়াল দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে, কিম্বা এগুলোই আছে বাকিটা আর নেই, বাড়িতে পৌঁছে ফোন রেখে দিচ্ছে তীর, আর ঝিল পুপুনদাদার ভিডিও কল বন্ধ করে দিয়েছে, ছুটিতে ছেলে বাড়ি এসেছে— কিচ্ছু নেই, কিছুই না, তবু দু-জনেই আয়না দেখছে, ইস! বুড়ো হয়ে গেছি! দেখা হলে, চিনতে পারবে?
‘তোমার তো সময় নেই কথা বলার, বউয়ের গল্প করবে না আমার কাছে— কী বললে? প্লেটোনিক? লজ্জা করে না’—
‘তোর তো অনেক ফ্যান, কী যেন কী দাদা? কে ওটা? সিনেমার? আলাদা ব্যাপার’—
‘ধুস! হিংসুটে— কেন ফিরে এলে না পুপুনদাদা’
৫
আমি মাটি। ছাইচাপা মাটি। আসলে ওরা কেউই নেই আমি আছি। একবুক শেওলা নিয়ে বসে বসে চিঠি লিখছি ওদের হয়ে। অথচ আমাকেই ওরা খুঁজছে। সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা খুব ক্লান্ত তার নাকের দু-পাশে চশমার পুরু দাগ চুলে পাক ধরেছে, সে ভারী মন্থর গতিতে এদিকেই হেঁটে আসছে। সেই ছেলেটা, কাঁচা পাকা দাড়ি, নিজেকে বুড়ো ভাবতে চাইছে প্রাণপণে, অথচ সেও এসেছে ছাইগাদায়! আমি ওদের জন্য মেলে ধরেছি এক বুক ভুঁইচাঁপার ফুল, জারুলের ঝরা পাতা, আমের মুকুলের গন্ধ মাখা এক আশ্চর্য সব পেয়েছির দেশ!
পরিশিষ্ট—
রাইয়ের সঙ্গে ওর পুপুনদাদার দেখা হয়নি, শুধু ঝিলের সঙ্গে যেদিন তীরের দেখা হল, তারপর চারশো মাইল দূরে এই পৃথিবীর দুটি শহরে রাই আর ওর পুপুনদাদা দু-জনেই স্বপ্নে একটা চিরকুট খুঁজে পেয়েছিল, ছাইগাদার মধ্যেও যার অক্ষরগুলো এখনও স্পষ্ট পড়া যায়।