মাতৃহারা

কাল্পনিক চিত্র

আব্দুল বারী


প্রভু, প্রভু রে, ও বাবা প্রভু, প্রভু রে, শোন বাবা। একবার এদিকে শোন রে বাপ। প্রভু…
বেলা দশটা। নদীর ঘাটে একখানা নৌকা এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রিরা সব নেমে গেছে। ওপারে যাওয়ার জন্য কিছু যাত্রী ঘাটের কিনারে বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। নৌকার মাঝি প্রভু। ঘাটে নৌকা বেঁধে চা খেতে চলেছে। ঘাটের উপর একপাশে একটি মাত্র চায়ের দোকান। সেখানে যাবে সে। বট গাছের পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গার জলে। বটগাছটি ঘুরে চায়ের দোকান যেতে হয়। প্রভু সেদিকে পা বাড়িয়েছে। আর সিঁড়ির ধাপ থেকে একজন বৃদ্ধা আকুল কণ্ঠে প্রভুকে ডাকছে।

প্রভু মাঝি কানে একটু খাটো, এতে তার একপ্রকার সুবিধা হয়। যাত্রীরা অনেক সময় নৌকা ছাড়ার জন্য তাড়া দেয়। মাঝি শুনেও না শোনা হয়। তাড়া থাকা কোন কোন যাত্রী গালাগালিও দেয়। প্রভু যেন শোনে না। ঘাট মালিক বলে দিয়েছে নৌকা বোঝায় না হলে যেন সে না ছাড়ে। তাই যাত্রীদের কথা সে কানে তুলে না।


বৃদ্ধা আকুল কণ্ঠে ডেকে চলেছে প্রভুকে। খুব আন্তরিক সে আহ্বান। এমন আন্তরিক আকুল কণ্ঠে বটতলায় রাখা বাবা ভোলানাথকে ডাকলে এতক্ষণ বুঝি বাবা সশরীরে হাজির হতেন। অথচ এ ব্যাটা প্রভু উদাস উপেক্ষায় এড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা কয়েকজন নিত্যযাত্রী একটু বিরক্ত হই।

এই প্রভু, মাসিমার ডাক কানে যাচ্ছে না? কী বলছে শোন। এখনই তোমাকে নৌকা ছাড়তে বলবে নাকি, তাই পালাচ্ছো? যাও শোন কী বলছে। একটু ধমকের সুরে কথাগুলো বলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আবির আহমেদ।

দুজন ছুতোর মিস্ত্রি বসে ছিল। রোজ যাতায়াত করে। একজন বলে ওঠে, শালা দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের কথা কানে যায় না। এমন করে ডাকছে, আর ও বেটা যেন লাট সাহেব, এড়িয়ে যাচ্ছে।

প্রভু আমতা আমতা করে আমাকে সাক্ষী মেনে বলে, দেখুন তো মাস্টারমশাই, আমাকে কী সব বলছে? আমি শুনলে কি আর আ-কাড়বনা? শুনতেই তো পাইনি।

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে পায়ে পায়ে বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে যায় প্রভু।

বৃদ্ধা তার হাতে ধরা থলে থেকে একটা ক্যারি ব্যাগ বের করে প্রভুর হাতে দিয়ে বলে, তুই কাঁঠাল খেতে ভালবাসিস তাই এনেছি। একটা বড় কাঁঠাল ভেঙে ছিলাম। নে ধর, খাস যেন বাবা। খাবি তো? একটাও নষ্ট করবি না। সব কয়টা খাবি। তোর জন্য কষ্ট করে অনেকটা পথ হেঁটে নিয়ে এলাম রে। তুই খেলে আমার খুব ভালো লাগবে।

হ্যাঁ খাব খাব, বলে ক্যারি ব্যাগটা নিয়ে নৌকার দিকে পা বাড়ায় প্রভু। নৌকার গলুয়ে তার একটা ব্যাগ রাখা আছে। তাতে ছাতা গামছা হাফপ্যান্ট রাখে। সেই ব্যাগে কাঁঠাল কোয়া রাখা ক্যারি ব্যাগটা রাখতে চলেছে। পেছন থেকে সেই আন্তরিক সুরে বৃদ্ধা বলে চলে, খাস যেন বাবা, খাস রে। একটাও নষ্ট করিস না। না হলে আয়, আমার সামনে বসে খা। ওই ধাপের উপর এসে বস। দোকান থেকে দুটি মুড়ি এনে দিই। মুড়ি দিয়ে মেখে খা।

ততক্ষণে পাকা কাঁঠালের সুবাসে বটতলা ভরে গেছে। মাসিমার কথার মতো কাঁঠালটাও বড় মিঠে। প্রভু নৌকা থেকে হাঁক পাড়ে, খাব গো মাসি খাব। সব কয়টায় খাব। তুমি ভেবো না। আমি তো কাঁঠালের যম। একটাও নষ্ট হবে না।

বৃদ্ধা একটু তৃপ্তির হাসি হেসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। হাতের ব্যাগটা গঙ্গার জলে চুবিয়ে ধুয়ে নেয়। হাতে একটু জল নিয়ে নিজের মাথায় ছিটায়। তারপর উঠে আসে। বটতলায় বসে থাকা একজন বলে, আচ্ছা তুমি গোপাল মাস্টারের মা না?

হ্যাঁ বাবা, আমি গোপালের মা।
তুমি এখন গোপালের বাড়িতে থাকো না?
বৃদ্ধার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে যায়। একটু আগের প্রফুল্ল হাসিটা ঠোঁটের কোণে মিলিয়ে যায়। একটা বিষণ্ণ বেদনার রেখা ফুটে ওঠে সেখানে।
তুমি কে বাবা? কোন গ্রামে বাড়ি?
লোকটি বলে, ওই তো পাশের গ্রাম বনমালীপুরে।
এদের কথা শুনে আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। একেবারে বৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখে বৃদ্ধা বলে, বাবা তোমার বাড়িও কি বনমালীপুর?
আমি বলি, না মাসিমা, আমার বাড়ি দেবকুন্ড।
তা বাবা, এদিকে কোথায় যাবে?
ওপারের একটা স্কুলে ছেলে মেয়েদের পড়াই। স্কুল যাব।
খুব ভালো। আমার গোপালও স্কুল মাস্টার।
সেই লোকটি আবার বলে, তাহলে লোক মুখে যা শুনেছি তা ঠিক। গোপাল তোমাকে দেখে না।

বৃদ্ধা মনে হয় এই কথাগুলো এড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু লোকটা আমার জিজ্ঞেস করায় বলে, তুমি কি শুনেছ তা তো জানি না বাবা, তবে আমি বাগানের কোণে চালা করে থাকি। আজ গাছ থেকে একটা বড়ো পাকা কাঁঠাল নামিয়ে ছিলাম। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেদের ডেকে তাদের হাতে চারটে করে কোয়া ধরিয়ে দিলাম। খুব আনন্দ করে খেলো তারা। খুব ভালো লাগলো আমার। সেদিন চান করতে এসে শুনলাম ওই ছেলেটা গল্প করছিল কাঁঠাল খেতে ও খুব ভালোবাসে। তাই ক্যারি ব্যাগে করে ওর জন্য কিছু নিয়ে এলাম। সেদিন একটা গোটা পাকা কাঁঠাল দিয়েছিলাম ওকে। খাক, গাছের ফল। তা শুধু মানুষের জন্যই নয় বাবা, গাছের উঁচু ডালে একটা কাঁঠাল রেখে দিয়েছি। সেটা আর নামাবো না। পাখ পাখালিতে খাবে। ওরাও তো জীব।

তা গোপালকে দাওনি?
বৃদ্ধা আবার একটু চুপ করে যায়। তারপর বলে, বাগানে অনেকগুলা করে আম কাঁঠাল পেয়ারার গাছ আছে। একটা আধটা গাছে আমি হাত দিই। বাকি ফল তো গোপালই খাই। বেচে। তাও আজ কাঁঠালটা ভেঙে বৌমাকে এক বাটি দিতে গিয়েছিলাম। দুটো নাতি আছে, তারা খাবে। খেলে আমার মনে শান্তি হবে। গোপালকে ছোটবেলায় সামনে বসিয়ে খাওয়াতাম। তা বৌমা বলল, তাদের ঘরেই নাকি কাঁঠাল পচছে।
প্রভু মাঝি হাঁক পাড়ে— পারে, পারে, যারা ওপারে যাবে এসো গো, নৌকা ছাড়বো। ঘাটে বাঁধা নৌকার দড়ি খুলছে আর হাঁক পাড়ছে। বটতলা ছেড়ে নৌকার দিকে সবাই পা বাড়াই। আমি বলি, আসছি মাসিমা।
বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, সবার মঙ্গল হোক। এসো বাবা।


প্রতিদিন কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কতজনকেই বা মনে রাখি? কিন্তু বিশেষ কিছু মানুষের কথা মনে থেকে যায়। পরে দেখা হলে চোখ আটকে যায় তার উপর। শুধু চোখ কেন, পাও আটকায়। সেদিন স্কুলে যাচ্ছি, নদীর ঘাট থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঘোষপাড়ার একটি বাড়ির ধাপির উপর কোঁচড়ে কিছু নিয়ে বসে আছে গোপালের মা।

জিজ্ঞাসা করি— কী মাসিমা, এখানে বসে যে? কী খবর?
এই যে বাবা ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছি। নিতাইয়ের বউকে দেবো বলে। বউটা পোয়াতি। খাবে। মুখে একটু স্বাদ আসবে।
বেশ তো। কোন বাড়িটা তাদের, বাড়ি গিয়ে ডেকে দিয়ে দাও।

বাড়িতে নেই বাবা। ধনার দোকান গেছে জিরে আনতে। তাই এখানে বসে আছি। আসুক, তার হাতেই দিয়ে যাব।
আরেকদিন দেখি— বেশ ফাঁকা মতো একটা জায়গায় বসে গোপালের মা। হনুমানকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। প্যাকেট থেকে বিস্কুট বের করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর হনুমানরা লুফে লুফে নিচ্ছে। কেউ শান্তভাবে বসে খাচ্ছে, তো কেউ স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বাঁদরামি করছে। সব মানুষই তো মানুষ হতে পারল না। এরা তো মনুষ্যেতর।

কী মাসিমা, এদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছো যে? এরাও বুঝি তোমার কাছে বিস্কুট খেতে চেয়েছে?
মাসিমা একটু হাসল। তারপর বলল, না বাবা, এরা মুখ ফুটে খেতে চাইনি। তবে কালকে মদন দোকানীর দ্বারা তাড়া খেতে দেখেছিলাম, তাই আজ এদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছি।
মদন দোকানীর তাড়া খাওয়া মানে?

মাসিমা বলে, কাল বিকালে মদনের দোকানে গিয়েছিলাম গুড় কিনতে। গিয়ে দেখি মদনের দোকানের সামনে একটা বাচ্চার হাত থেকে দুটো বিস্কুট কেড়ে নিয়ে পালাচ্ছে একটা হনুমান। আর মদন ঝাঁপ লাগানো হুড়কো নিয়ে তাকে তাড়া করছে। অবলা জীব, খেতে মন চেয়েছে। তাই আজ আমি ওদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছি।

আচ্ছা বুঝলাম। তা তুমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
আছি বাবা। বেশ আছি। তোমাদের আশীর্বাদ আর ঠাকুরের কৃপায় ভালো আছি। শরীরের সুখের কথা বলছো বাবা? সত্তর বছর পার হয়ে গেল, আবার শরীরের সুখ। এবার চিতায় উঠে মা গঙ্গায় নেমে যেতে পারলেই হয়।

তা বললে হয় মাসিমা। তাহলে এদের কে দেখবে?
মাসিমা একটু মলিন হেসে হনুমানদের বিস্কুট খাওয়াতে থাকে।


সেদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরছি। গঙ্গার ঘাটে সেই বটতলায় বেশ কয়েকজন লোক বসে। তাদের মধ্যে দুজন পরিচিত। কয়েক বছর ধরে এ পথে যাওয়া আসাতে মুখ পরিচয় হয়ে গেছে।
কাকা কী খবর? এই অবেলায় এখানে?
একটু আসতে হলো বাবা। গোপালের মা মারা গেছে। তাই এলাম।
কোন গোপালের মা? গোপাল মাস্টার?
হ্যাঁ গো, গোপাল মাস্টারের মা। চেনো নাকি?
হ্যাঁ, চিনি কাকা।

খবরটা শুনে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। ভেতরের কোথাও যেন একটু ক্ষরণ হলো। আপন কেউ নয়। তবু মানুষটার জন্য ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। জলের উপর গঙ্গার শূন্য বুকের মতোই ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। একটা বেদনার স্রোত বইতে লাগলো। তেমনভাবে মিশিনি। শুধু কয়েক দিন চোখে দেখেছি। তাতেই মানুষটার উপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেছিল। একটা স্নেহের বন্ধনে আটকা পড়ে গেছিলাম।

এই বটতলা থেকে খানিকটা দূরে শ্মশান ঘাট। সেখানে একটা চিতা জ্বলছে। অল্প কয়েকজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে।
কাকা মাসিমার কী হয়েছিল?

শুনলাম দুই দিন আগে গোপালের সঙ্গে একটু ঝামেলা হয়েছিল। গোপাল উল্টোপাল্টা কিছু কথা বলেছিল। সেদিন থেকেই শরীর খারাপ হয়। তারপর আজ সকালে…।

পাশ থেকে একজন প্রৌঢ় বলেন, সবটা শরীর খারাপ নয় রে গোবিন্দ, এর মাঝে আরো অনেক কাহিনী আছে। গোপাল তো সুজন নয় । বাপটার সাথে কি করেছিল মনে নাই?

আর একজন বলেন, সুভাষ কাকা ঠিকই বলেছেন। গোপাল শিক্ষিত হলে কি হবে, একটা কালসাপ। ওর বাবাকে চিকিৎসা করাবার নাম করে বাঁকুড়া না পুরুলিয়া কোথায় যেন নিয়ে গেল। তারপর সেখানেই দাহ করে বাড়ি আসে। আমরা জানি লোকজন চিকিৎসা করাতে কলকাতা মুম্বাই চেন্নাই যায়। পুরুলিয়া যায় কখনো শুনেছো?

সুভাষ বাবু বলেন, হ্যাঁ, তাইতো। গোপাল ওর বাবাকে চিকিৎসা করানোর নাম করে বাঁকুড়া না পুরুলিয়া কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছিল। তারপর সেখানে নাকি ভুল চিকিৎসা করে মেরে দিয়েছিল। এসব তো শোনা কথা। তবে যা রটে তা কিছু না কিছু তো বটে।
গোবিন্দ কাকা বলেন, বাপের তখনও কয়েক বছর চাকরি ছিল। ও আজ সেই বাপ মরা চাকরি করছে।

পাশ থেকে একজন বলেন, শুধু কি বাপ মরার চাকরি, ওর মা যে ফ্যামিলি পেনশনটুকু পেত তাতেও ভাগ বসাতে চেয়েছিল। সবটা নিতে চায়। এ নিয়ে মা ছেলের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়। গোপাল মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।

কাকারা বটতলায় গোপাল চরিত আলোচনা করতে থাকেন। আমার শুনতে আর ভালো লাগে না। মাসিমার জন্য মনটা কেমন কেঁদে ওঠে। যেদিকে শ্মশানে চিতা জ্বলছে সেদিকে একটু এগিয়ে যাই।

একটা বাবলা গাছের নিচে কয়েকজন কিশোর কেমন এলিয়ে বসে আছে। অদূরে চিতা জ্বলছে। ছেলেগুলোর চোখেমুখে বিষন্নতা। কান্না শুকিয়ে মুখের উপর বেদনা হয়ে লেগে আছে। সকাল থেকে হয়তো কেউ এতোটুকু কিছু মুখে তুলতে পারেনি। ওদের বুকের ভেতর আপনজনের চিতা জ্বলছে। পুড়ে যাচ্ছে ভেতরটা।

আরেকটু এগিয়ে বাম পাশে চারা বটগাছ। তার ডালে বেশ কয়েকটি হনুমান। জ্বলন্ত চিতার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কী এক বেদনায় নুয়ে নুয়ে পড়েছে তারা। স্বভাবসিদ্ধ চঞ্চলতা আজ ভুলে গেছে।

চোখের সামনে একটা অপার স্নেহ-মমতা ধোঁয়া হয়ে মিশে যাচ্ছে অসীম শূন্যলোকে। একটা বিগলিত করুণার ধারা ছাই হয়ে মিশে যাচ্ছে মর্ত্যের সুরধ্বনির সঙ্গে। নিঃস্ব হচ্ছে পৃথিবী।