পিনাকী দত্ত
ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে ডা. রায় দেয়াল-ঘড়িটার দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। এখনো কফি এলো না। মাসখানেক হল এই চেম্বারটায় বসছেন। প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে বেল বাজাতে যাবেন অমনি কফি নিয়ে উপস্থিত হলেন দোকানের বয়স্ক স্টাফটি।
লোকটাকে কেন জানি ডা. রায়ের একদম সহ্য হয় না। কেমন যেন কাঠকাঠ ব্যবহার। যন্ত্রের মত কফি কাপটা নামিয়েই পাশে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন ইনস্ট্রাকশন দিলে কী যে বলে কিছু বোঝাও যায় না। মুখে সবসময় মাস্ক পরে থাকে। বললেও খোলে না। সামনের দিকে বড় বড় কাঁচা পাকা চুল কপালের উপর এমনভাবে নেমে এসেছে যে, শুধু চোখ দুটোই দেখা যায়।
ডা. রায় চেষ্টা করেও মুখ খোলাতে পারেননি। তবে লক্ষ করেছেন, ভদ্রলোকের চোখ দুটো কেমন যেন ভরা বর্ষার মেঘের মতো কান্নাভেজা। শুধু বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষা।
ডা. রায় ইতিমধ্যেই শুভকে (দোকানের মালিক) বয়স্ক স্টাফটিকে নিয়ে দু-এক কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। কখনো বা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শুভ বরাবরই নির্লিপ্ত বা নিরুত্তাপ থেকেছে। ডা. রায়ের কোথাও যেন মনে হয়েছে ব্যাপারটাতে শুভর প্রশ্রয় রয়েছে।
২
আজ সন্ধ্যায় হঠাৎই হুড়মুড় করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় পেশেন্টের চাপ কম রয়েছে। আর মেয়েও স্কুল ফাইনালে দারুণ রেজাল্ট করায় ডা. রায়ের মুডটাও বেশ ভালো।
তিনি শুভর সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করলেন— ‘আরে! ওই ভদ্রলোককে দেখছি না? কী যেন নাম?’
‘কে ? মানসদা?’ —শুভ বলে উঠে।
আজ আসেনি? না, কাজ ছেড়ে দিয়েছে? তুই জোগাড়ও করেছিস বটে! মার্কেটে আর লোক পেলি না? কত স্মার্ট ছেলে-মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তবে বুড়োগুলোর কী হবে? আমাদের মা-বাবাও তো বুড়ো, আই মিন, স্মার্ট নয়। ফেলে দেব বলছিস?
শুভর গলায় উষ্মা গোপন থাকে না।
ডা. রায়— সরি। তুই পার্সোনালি নিবি আমি বুঝতে পারিনি। নিশ্চয়ই মানসবাবুর প্রতি তোর কোন সফট্ কর্নার আছে। নইলে তুই এভাবে রিয়্যাক্ট করতিস না।
শুভ বলে আমাদের পুরানো পাড়ার ‘আরোগ্য ফার্মেসি’র কথা মনে আছে? সেই সময়ের সবচেয়ে চালু ও বড় ওষুধের দোকান।
হুমম্। বেশ মনে আছে।
ওটা মানসদাদের ছিল। দারুণ রানিং বিজনেস।
‘তো আজ এই অবস্থা কেন?’ ডা. রায়ের গলায় বিস্ময়।
তুই মেডিক্যালে চান্স পেয়ে কোলকাতায় চলে যাওয়ার পর-পরই তোর বাবা-মা বাড়ি বিক্রি করে আমাদের পাড়া থেকে চলে গেলেন। তাই তুই হয়তো জানিস না, বৌদির ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। কোলকাতা-বেঙ্গালুরু ছোটাছুটি করেও কোনও লাভ হল না। ছয়মাসের মধ্যেই সবশেষ। শেষদিকে তো বৌদি নিজের ছেলে স্বামী কাউকেই চিনতে পারত না। ছেলে মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়ালে ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত।
মানসদার তখন পাগল পাগল অবস্থা। বৌদিকে খুবই ভালবাসত। সেই ছোটবেলা থেকেই ওদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক। দুই পরিবারের মধ্যে বনিবনা ছিল না। বহু লড়াই করে দুটো পরিবারকে মিলিয়েছিল। অথচ সেই মানুষটাই অকালে যখন চলে গেল, তখন আঘাতটা আর নিতে পারল না মানসদা। সব ছেড়েছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
আর ছেলেটা? ডা. রায় মাঝপথে জিজ্ঞাসা করে।
মানসদার অবর্তমানে মামারাই দায়িত্ব নিয়ে বড় করছে। শত হলেও দিদির একমাত্র স্মৃতিচিহ্ণ।
জানিস, একটা ব্যাপারে আমরা মানসদার পরিবারের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। বাবার হঠাৎ করেই প্যাংক্রিয়াটাইটিস ধরা পড়ল। ডাক্তারবাবু বর্ধমান হসপিটাল থেকে সোজা পিজিতে রেফার করে দিলেন। কাউকে চিনি না, কারো সঙ্গে জানাশোনা নেই। সে এক কঠিন সময়। আমাদের অবস্থাও তখন বিরাট কিছু নয়। প্রচুর ওষুধ লাগছে আর সবই প্রায় দামী।
মানসদার বাবা এখান থেকেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ওঁর জন্যই বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি বলতে পারিস। কথা বলতে বলতে শুভর গলাটা আজও ধরে এল। চোখের মধ্যে একটা উদাসীনতা খেলা করে গেল।
তাই বহু বছর পর মানসদা যখন ফিরে এল তখন অনেকটা জোর করেই ধরে এনে এই কাউন্টারটায় বসিয়েছি। তুই নিশ্চয়ই বুঝেছিস ওঁকে আমি ঠিক স্টাফ হিসেবে নয়, আরেকটু বেশি কিছু হিসেবে ট্রিট করি।
আরেকটা সিক্রেট। তুইও মানসদাকে খুব ভালো করে চিনিস।
আমি! ডা. রায়ের গলায় বিস্ময়।
ইয়েস মাই ডিয়ার। কিন্তু আমি চাই তুই নিজে থেকে চেন। দেখবি চমকে যাবি।
পরের দিন কফি নিয়ে আসতেই ডা. রায় মানসদার মুখোমুখি দাঁড়াল। খুব গম্ভীরভাবে মাস্কটা খুলতে বলল এবং মনোযোগ দিয়ে মুখটা লক্ষ করতে লাগল। খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি! কোথায় দেখেছি!
ডা. রায়কে বিড়বিড় করতে দেখে মানসদা নিজেই মুখ খুললেন ।
১৯৯৪— সুকান্তকাপ ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন— ব্রজবালাদেবী স্মৃতিবিদ্যামন্দির। একমাত্র গোলদাতা রাজদীপ রায়। অ্যাসিস্ট মানস ভৌমিক। হঠাৎই একটানা কথাগুলো বলে মানসদা থামল।
ডা. রায়ের চোখে ভেসে উঠল— রাইট উইং ধরে বল নিয়ে ছুটছে দ্বাদশ শ্রেণির মানস ভৌমিক ওরফে মানুদা। আর অপোনেন্ট দলের গোলের দিকে ছুটছে সেন্টার ফরোয়ার্ড একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাজদীপ রায়। মানসদা তখন গতিতে দুজনকে পরাস্ত করে প্রায় কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে পৌছে মুখ তুলে একঝলকে রাজদীপকে দেখে নিয়েছে। মানসদার বাড়ানো বল যখন বক্সের উপর এসে পড়ল, তখন রাজদীপের হেড করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইলো না। মুহূর্তে বল জালে জড়িয়ে গেল।
ডা. রায়— আর-রে মানসদা! তোমাকে চিনতেই পারিনি! পরিচয় দাওনি কেন?
না মানে, তুমি, আই মিন, আপনি আজ কতবড় ডাক্তার! আর আমি!
মানসদা একটা কথা সবসময়ই মনে রাখবে, ডাক্তার আমি প্রফেশনাল জীবনে। সামাজিক জীবনে আমি তোমাদের কাছে এখনো শুধুই রাজদীপ ওরফে রাজু। বলেই স্কুলের দিনগুলোর মতই প্রচণ্ড আবেগে মানসদাকে জড়িয়ে ধরল। স্মৃতির সরণী বেয়ে ওরা দু’জনেই এখন ব্রজবালাদেবী স্মৃতিমন্দিরের সবুজ মাঠে কৈশোরের ঘামে ভেজা দিনগুলোর দিকে যেন হাঁটতে শুরু করল।