• facebook
  • twitter
Friday, 14 March, 2025

হারিয়ে পাওয়া

সেদিন বিকেলবেলায় দু’জনে খাবার টেবিলে উঠে প্লেন থেকে ঝাঁপ দেওয়া অভ্যেস করছিল, হঠাৎ দুম করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শাঁটুলটা, আর কী পরিত্রাহি চিৎকার!

কাল্পনিক চিত্র

মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী

 

বাঁটুলকে চেনো তো? কী বললে? হাঁদা-ভোঁদা আর বাঁটুল! না গো না, এ বাঁটুল হল শাঁটুলের দাদা। বাঁটুল আর শাঁটুল দুটি ভাই, দিবারাত্র দুজনের দৌরাত্ম্যে ওদের মা হয়রান। খুব রেগে গেলে মা বলে, তোরা যদি এমন কুরুক্ষেত্তর কাণ্ড করিস, দেখবি, একদিন যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। কথাটা বললে বাঁটুল একটু ভড়কে যায়। সত্যি, মা চলে গেলে বেজায় মুশকিল হবে। নন্তুর মা সগ্‌গে চলে যাবার পর থেকে নন্তুর ভারি বেহাল দশা! সবসময়ে খাই-খাই ভাব; প্যান্টটা ঢলঢলে, খুলে যায় খালি। কোনও ছিরিছাঁদ নেই!

বাঁটুলরা এখন কোচবিহারে মামাবাড়িতে এসেছে। বাবা গেছে ডিমাপুরে, আসবে ক’দিন পর। দিদা আদর-যত্ন করছে, কিন্তু ওদের হুটোপাটিতে বেজায় বিরক্ত হয়ে মাঝে-মাঝে বলছে, এমন করলে দেখিস, তোদের মা তোদের ফেলে রেখে সত্যিই পালিয়ে যাবে একদিন। একটু থমকে গেলেও পরক্ষণেই ওরা ভুলে যাচ্ছে সব।

সেদিন বিকেলবেলায় দু’জনে খাবার টেবিলে উঠে প্লেন থেকে ঝাঁপ দেওয়া অভ্যেস করছিল, হঠাৎ দুম করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শাঁটুলটা, আর কী পরিত্রাহি চিৎকার! মা ছুটে এসে গম্ভীর মুখে বলল, এ খেলার বুদ্ধি কার? অমনি ঘর-ভরা লোকের সামনে বিশ্বাসঘাতক শাঁটুলটা এত্তো বড়ো হাঁ করে ওকে আঙুল দিয়ে দেখাল। মা গম্ভীর মুখে ওর দিকে বড় বড় চোখ করে একবার তাকিয়ে শাঁটুলের কপালে বরফ দিতে বসে গেল, আর একটি কথাও বলল না। বাবুলমামু ছুটে এসে বাঁটুলের কানটা টেনে বলল, ভাইটা মরে গেলে কী করতিস তুই!

বাঁটুলের এমন ভয় করল কথাটা শুনে যে, বাবুলমামুর কান পাকড়াবার ব্যথাটা বেমালুম ভুলে গেল। একটু বাদে শাঁটুলকে দুধ-রুটি খাইয়ে মা শুয়ে পড়ল, ওর সঙ্গে একটা কথাও বলল না, খেলও না। রাত্তিরে খেতে বসে বাঁটুলের গলার কাছটা ব্যথা-ব্যথা করতে লাগল। দিদা বলল, খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ো, শব্দ কোরো না!

সকালে বিন্নিপিসির বাসন মাজার ঝ্যাং ঝ্যাং শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে বাঁটুল দেখে সকাল গড়িয়ে গেছে কখন! ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে দেখে শাঁটুল অঘোরে ঘুমোচ্ছে, পাশে মা নেই। ওর কপালটা খুব ভালো করে নজর করল, ফোলাটা নেই এখন। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে মাকে খুঁজল বাঁটুল। ছাদে-কলঘরে, কোথাও নেই। তাহলে কি রান্নাঘরে? সেখানে গিয়ে দেখে দিদা আপনমনে তরকারি কুটছে।
মা কোথায় দিদুন?
দেখ-গে ছাদে আছে।
নেই তো!
তাহলে চান করছে।
না, সেখানেও নেই।

ঝঙ্কার দিয়ে উঠল দিদা। তা আমি কীকরে বলব বলো! তোমরা গুণধর দুটিতে মা-টাকে তো একেবারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খেলে—! যাও, চুপ করে বোসো টেবিলে, দুধ-বিস্কুট খাও—
ভয় পেয়ে পালিয়ে আসে বাঁটুল। একটু পরে শাঁটুল ঘুম থেকে উঠল। সে দিদা, বিন্নিপিসি আর বাবুলমামুর কোলে কোলে ঘুরতে লাগল। তাকে আজ খেলতে দেওয়া হবে না।

লুচি-বেগুনভাজা বাঁটুলের প্রিয় খাবার। দিদিমা জলখাবার বানিয়েছে। খেতে বসে বাঁটুলের গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। দিদা, বাবুলমামু, বিন্নিপিসি বেশ চাকুম-চুকুম করে খাচ্ছে। ডুকরে উঠল বাঁটুল, মা কোথায়? মা খাবে না? ওর অবস্থা দেখে দিদিমা কোমল স্বরে বললেন, খেয়ে নাও, শান্ত হয়ে থাকলে মা ঠিক ফিরে আসবে।

আচ্ছা, মা তাহলে রাগ করে চলে গেছে! দুয়োরানির মত যেদিকে দুচোখ যায়! আসবে তো ফিরে!
মা ফিরে আসবে তো দিদুন? কান্না চাপতে চাপতে আর একবার জিজ্ঞেস করে বাঁটুল। হ্যাঁ, ভালো হয়ে থাকো, আসবে। কান্নাকাটি কোরো না।
খুব শান্ত হয়ে রইল বাঁটুল, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদল। শাঁটুল দু’বার ওর চুল টেনে দিল, কিচ্ছু বলল না। দিদা বললেন, খেয়ে ঘুমোও, মনে মনে মাকে ডাকো, দেখো মা এসে যাবে।

তাই করল বাঁটুল। তারপর একসময় মনে হল কেউ ওকে ডাকছে, বিবেকবুদ্ধবাবু, বিবেকবুদ্ধবাবু। হ্যাঁ, ওর ভালো নাম বিবেকবুদ্ধ। কে ডাকছে? চোখ খুলে দেখে বাবা! লাফিয়ে উঠে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বাঁটুল। বাবার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মা। দিদা বলল, মা ভক্ত হনুমান ছেলে বটে তোমার, কত কষ্টে সারাদিন তাকে বোঝানো…

ধাঁ করে বাঁটুলের মগজ খুলে গেল। আচ্ছা, মা তাহলে বাবাকে আনতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিল, আর দিদা ওকে বোকা বানিয়ে রেখেছে এমন! তাই তো, মা হারিয়ে গেছে বলে ও একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, আর মেয়ে হারিয়ে যাবার পরও দিদা চোখ বন্ধ করে আয়েশ করে লুচি খাচ্ছে, এমন হয়! ওকে ঠকানো! গাল ফুলে উঠতেই বাবা দুটো ছবির বই বের করে দিল, এই যে লাল বইটা বিবেকবুদ্ধবাবুর, নীল বইটা শুদ্ধসত্ত্ববাবুর। শাঁটুল অমনি চিৎকার জুড়ে দিল, ন্‌না….লাল বইটা আমার!

হাতটা তুলেও সরিয়ে নেয় বাঁটুল। নাঃ, ও আর মারবে না কাউকে। মা সত্যিই হারিয়ে যায়নি, কিন্তু তাতেই যা কষ্ট হল, ও এবারে ভালো ছেলে হয়ে উঠবে। লাল বইটা ও দিয়ে দিল শাঁটুলকে।

তখনই মা বলল, শাঁটুল, ও তোমার দাদা হয়। এক্ষুণি ওকে ওর বই ফেরৎ দাও। বাবা বলল, আমাদের বিবেকবুদ্ধবাবু একটি সোনার টুকরো ছেলে! তখনই দিদা বলল, বেচারি সারাদিন মায়ের কথা ভেবে খায়নি, ওকে ক’টা লুচি ভেজে দিই, ওর বাবার সঙ্গে বসে খাবে এখন! বাবুলমামু বলল, আমি বাঁটুলের প্রিয় মিষ্টি নিয়ে এসেছি, গজেনের দোকানের রসকদম্ব।
বাঁটুলের রাগ গলে জল!

News Hub