ডিমের গন্ধ

কাল্পনিক চিত্র

চৈতন্য দাশ

‘ও স্যর, আজকে কী বার? স্যর, ও স্যর আজকে কী বার…?’ টিফিনের ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে ক্লাস টু-এর তিতলি দুই-তিনবার জিজ্ঞেস করার পর আনমনা হেডস্যার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দেন, ‘মঙ্গলবার।’
জবাব পেয়ে তিতলি মুখে চিলতে হাসি ফুটিয়ে ফিরে যায়।

হেডস্যার হাতের কাজ সেরে অফিসঘরের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই তিতলির কচি-হাসিখুশি মুখটা চোখের তারায় ভেসে ওঠে। তাঁর মনে পড়ে যায়, তিতলি, একরত্তি ছোট্ট মেয়ে কেন জিজ্ঞেস করল ‘স্যার, আজকে কী বার?’


তিনি মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববার চেষ্টা করলেন, আজকে মঙ্গলবার, কালকে আসছে বুধবার। বুধবার মানে বিদ্যালয়ের মিডডে-মিলে গোটা‌ গোটা ডিম বরাদ্দ। সুতরাং তিতলি কালকে স্কুলে আসবেই, কেবলমাত্র গোটা ডিমটা হাতে পাওয়ার জন্য। সে কথা মনে পড়তেই হয়তো ছোট্ট তিতলি হেডস্যারকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে, আগামীকাল সত্যি সত্যিই বুধবার কিনা! সপ্তাহে দুটো করে বুধবার হলে কতোই না ভালো হতো! সপ্তাহে দু’দিন গোটা গোটা ডিমের গন্ধ। তিতলিদের মনে খুশির জোয়ার…!

হেডস্যারের ধারণা মিথ্যে নয়। কারণ হেডস্যার যখনই বললেন, ‘আজকে মঙ্গলবার,’ তখনই তিতলির মুখমণ্ডলে হাসির ঝিলিক দেখেছিলেন।
তিতলির হেডস্যার সাহিত্যসাধক, ভাবুকে মানুষ। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর লেখেন। সেজন্যই শিশুর মুখদর্পণ দেখলেই তিনি অনেক কিছু বুঝে ফেলেন। ডিমের দিন তিনি নিজের হাতে শিশুদের মধ্যে ডিম বিলি করেন। কোনো শিশুর পাতে একটা গোটা ডিম দিতেই শিশুটি বলে উঠলো, ‘স্যার, বড় ডিম দাও’। ওর থেকে বড় ডিম পাত্রে না থাকলেও শিশুর মন বুঝে হেডস্যার ২-৩ বার একই সাইজের ডিম পাল্টে পাল্টে শিশুদের পাতে দেন। শিশুরা ভাবে, সত্যি সত্যিই হেডস্যার ডিম পাল্টে বড়টাই দিয়েছেন। এতে শিশুর মন-আত্মা খুশি হয়। হেডস্যারও সন্তুষ্ট হন।

দুধসাদা ওই লম্বাটে-গোলাকার বস্তুটি হাতে পেতেই শিশুদের মুখমণ্ডলে সব পেয়েছির সে উজ্জ্বলতা পৃথিবীর যাবতীয় দারিদ্র-দুঃখকে যেন ভোরের সূর্যের উজ্জ্বল হাসির মতোই মুছে দেয়।

সর্বোপরি, যেদিন ডিম হয়, সেদিন প্রয়োজনের তুলনায় চাল বেশি নিতে হয়। কারণ হেডস্যার লক্ষ্য করেছেন, প্রায় প্রত্যেকটা শিশু গোটা ডিম হাতে নিয়ে জিভ দিয়ে চেটে চেটে গন্ধ নেয় আর ভাত মুখে দেয়। টিমের গন্ধ নিতে-নিতেই এক থালা ভাত সাবড়ে দেয়। ডিমটা গোটাই থেকে যায়।

কেউ কেউ খাবার শেষে স্কুলের মাঠে ঘুরে ঘুরে ডিমটা দু’চোখ-মন ভরে দেখে আর ছোট ছোট দাঁত দিয়ে তুলে একটু একটু করে খায়। কেউ কেউ ব্যাগে পুরে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেদিন বেশ খুশি খুশি বাড়ি যায়। কারণ সে জানে তার ব্যাগে গোটা ডিমটা আছে। বাড়ি গিয়ে তৃপ্তি করে খাবে।


সেদিন বাজারে হেডস্যারের সঙ্গে তাঁর বন্ধু আরেক হেডস্যারের সঙ্গে দেখা হল।‌ দু’জনে একটি চায়ের দোকানের সামনে বসে গল্পে মশগুল হয়ে পড়েন। কথায়-কথায় সেই হেডস্যার বন্ধুটি বললেন, ‘আজ মনটা ভালো নেই…’
‘কেন, মনে আবার কী হলো?’

“আর বোলো না, স্কুলে টিফিন দিতেই আমার স্কুলের একটি শিশু এসে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যর, আজকে ডিম দিবা না?’ সে কথাটা আমি কিছুতেই হজম করতে পারছি না!”
‘তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না!’

‘আসলে আজকে বুধবার, কিন্তু ছাত্রদের পাতে ডিম দিতে পারিনি। সাত থেকে আট টাকা ডিমের পিস। প্রতি সপ্তাহে ডিম খাওয়াতে পারছি না। মাসে ২-১ দিন শিশুদের পাতে ডিম পড়ছে। কী করবো বলো, ৫০-৬০টা বাচ্চার জন্য যে টাকা পাই, তাতে গ্যাস-সার্ফ-সাবানের টাকা বাদ দিলে বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর মতো টাকা-পয়সা হাতে থাকে না। শাকসবজির যা দাম, মিডডে-মিল চালানো সম্ভব, বলো?’

উত্তরে হেডস্যার বন্ধুকে বলেন, ‘‘আমারও একই দশা! তবুও প্রতি সপ্তাহে ডিম না খাইয়ে পারছি না! তার কারণ ওই একটাই। বুধবারে স্কুল বসার পর মাঝেমধ্যে ছোট ছোট নিষ্পাপ মনের শিশুরা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ও স্যার, আজকের ডিম দিবা তো?’ তার উত্তর যদি ‘না’ হয়, সেটা শিশুদের কাছে কতটা কষ্টকর, তার কোমল কচিমনের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেটা উপলব্ধি করেই প্রত্যেক সপ্তাহে বুধবার শিশুদের পাতে ডিম তুলে দিতে না পারলে আমি যে ঘুমিয়েও শান্তি পাবো না! অনেক শিশু বুধবারে কেবলমাত্র ডিমটার জন্যই বিদ্যালয়ে আসে। টিফিনব্রেকে মিডডে-মিলের সময় হাতে গোটা ডিমটা পেতেই কেবলমাত্র ডিমের গন্ধে-গন্ধেই এক থালা ভাত গোগ্রাসে সাবড়ে দেয়। একমাত্র ডিমের গন্ধে!

সপ্তাহে একদিন শিশুর নাকে সেই গন্ধটা যোগান দেওয়ার জন্যই প্রতিমাসে নিজের পকেটের পয়সা কিছুটা খরচ করেও আলাদা শান্তি। শিশুমনে-নাকে ডিমের গন্ধের শান্তি।”

হেডস্যার বন্ধুটি অপর হেডস্যার বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কোনো বুধবারই তিতলিদের ডিমের গন্ধ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না…’
‘একদম!’