ড্রপ আউট

কাল্পনিক চিত্র

সুব্রত সরকার

সুদীপ আর স্কুলে আসে না।
পড়া ছেড়ে দিয়েছে। এবার ক্লাস ফোরের ফাইনাল পরীক্ষাও দিল না।
ওর বাবা গ্রামে থাকে না। বাইরে চলে গেছে কাজের জন্য। বাইরে মানে বিদেশ— নেপালে। মাও রোজ সকালে শহরে চলে যায়। আয়ার কাজ করে। বাড়িতে সুদীপের আর কেউ নেই। সারাদিন ও একা একা থাকে। সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নদীর ধারে চলে যায়। ওখানে একটা শ্মশান আছে। সেই শ্মশানে এক সাধুবাবা থাকে। সুদীপ সাধুবাবার সঙ্গে নাকি গল্প করে। সাধুবাবার দোকান এনে দেয়। পুজোর ফুল চুরি করে দিয়ে আসে। সুদীপ পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে এসব কাজ করে দিন কাটায়।

সুদীপের জন্য সৌরভের খুব মন খারাপ। খুব ভালো বন্ধু ছিল দুজনে। এখন আর বন্ধু নেই। দেখাই হয় না। সৌরভের বাড়ির থেকে বলে দিয়েছে সুদীপের সঙ্গে কথা না বলতে। একদম মেলামেশা না করতে। আগে দুজনে একসঙ্গে কী সুন্দর স্কুলে যেত। সাইকেল চালাত। ফুটবল খেলত। লাট্টু ঘোরাত। নদীর ধারেও দু-একদিন চলে যেত।


সৌরভের আজ শেষ পরীক্ষা ছিল পরিবেশ। খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। সৌরভ ভালো রেজাল্ট করে ফাইভে উঠে যাবে। বাবা বলেছে, এবার ওকে আর গ্রামের স্কুলে রাখবে না। টাউনের বড় স্কুলে ভর্তি করে দেবে। স্কুল বাসে করে রোজ স্কুলে যাবে।

আজকের শেষ পরীক্ষা দিয়ে সৌরভ সাইকেল চালিয়ে বাড়ি আসছিল। ভালো হয়েছে পরীক্ষা। মনে তাই আনন্দ। খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছিল। মালির পুকুরের সামনে হঠাৎ একটা কুকুরছানা রাস্তা পেরোচ্ছিল। সৌরভ ওকে বাঁচাতে গিয়ে এমন জোরে ব্রেক কষে যে, সাইকেল উল্টে গিয়ে পড়ে পুকুরে। সৌরভও পুকুরের জলে ছিটকে পড়ে যায়। নতুন সাঁতার শিখেছে ও। তাই তাড়াতাড়ি সাঁতরে পাড়ে আসতে না পেরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। দম ফুরিয়ে কেমন যেন করছিল জলের মধ্যে। সুদীপ তো সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। এটাই যেন ওর কাজ। আজও সাইকেল চালিয়ে এ পথ দিয়ে সাধুবাবার কাছেই যাচ্ছিল। রাস্তার পাশেই মালির পুকুর। সেই পুকুরের জলে একটা ছেলেকে হাবুডুবু খেতে দেখে ও ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। তারপর দক্ষ হাতে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে পাড়ে নিয়ে এসে দেখল যে ওর সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু সৌরভ!

সৌরভ অনেকটা জল খেয়ে ফেলেছিল। সুদীপ সেই জল কী সুন্দর বের করে দিল। সৌরভের ভয় আতঙ্ক তখনো কাটেনি। সুদীপকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। দু’বন্ধুর আজ অনেকদিন পরে কী অদ্ভুতভাবে দেখা হয়ে গেল। মালির পুকুরের দিকটা খুব নির্জন। এখন এই দুপুরে আরও শুনশান লাগছে। পুকুরপাড়ে দু’বন্ধু বসে গল্প জুড়ে দিল। সৌরভ ওকে চেপে ধরে বলল, ‘তুই স্কুল ছেড়ে দিলি কেন? আমাদের কী সুন্দর রোজ দেখা হতো। কত খেলতাম। গল্প করতাম।’
সুদীপ প্রথমে চুপ করে থাকে। তারপর বলল, ‘আমার পড়তে ভালো লাগে না রে।’
‘কেন ভালো লাগে না বল?’
‘ভালো লাগে না পড়াশোনা। আমি বড় হয়ে মিলিটারিতে চলে যাব।’
‘তাহলে তো তোকে পড়তেই হবে। পাস করতে হবে। নাহলে কেন তোকে নেবে মিলিটারিতে?’
সৌরভের একথা শুনে সুদীপ চুপ করে থাকে।

সৌরভ আবার বলে, ‘ওরে মিলিটারিতে ভালো চাকরি করতে হলে একটা দুটো পাস তোকে করতেই হব। নাহলে দেখবি ওরা তোকে দিয়ে রান্না করাবে। বাসন মাজাবে।’
সুদীপ অবাক হয়ে সৌরভের কথাগুলো শুনল। তারপর বলল, ‘তাই!’
‘হ্যাঁ তাই!’ সৌরভ জোর দিয়ে বলল, ‘তুই আবার পড়া শুরু কর। স্কুলে আয়। ড্রপ আউট হলে তোকে চলবে না।’
সুদীপ সৌরভের এসব কথা মন দিয়ে শুনল।

দু’বন্ধু আজ অনেকদিন পর এমন গল্প করছে। কথা বলছে। তাই খুব আনন্দ ওদের।
পুকুরের জলে দুটো রাজহাঁস হঠাৎ কোথা থেকে এসে নেমে পড়ল। তারপর দিব্যি ভেসে বেড়াতে লাগল। দু’বন্ধু রাজহাঁস-দুটোর দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসল। সুদীপ বলল, ‘আমি এখন কি আর স্কুলে যেতে পারব? নাম তো কেটে দিয়েছে। পরীক্ষাও তো দিলাম না।’

‘তুই তো এখন ড্রপ আউটের দলে। সব স্কুলেই শুরু হয়েছে নতুন করে ড্রপ আউটদের ফিরিয়ে আনার কাজ। স্যারদের দায়িত্ব খুঁজে খুঁজে ড্রপ আউটদের আবার স্কুলে নিয়ে আসা।’
‘তাই নাকি!’
‘হ্যাঁ। আমি গিয়ে কুশল স্যারকে বলব তোর কথা। তুই আবার পড়া শুরু কর। ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে পাস কর। দেখবি মিলিটারিতে তোর দারুণ চাকরি হবে।’

সুদীপ হাসল একটু। সৌরভের কথাগুলো ওর খুব ভালো লেগেছে। তাই প্রিয় বন্ধুকে বলল, ‘ঠিক আছে আমি আবার পড়াশোনা শুরু করব।’
‘ভেরি গুড।’ সৌরভ হেসে বলল, ‘তোর মধ্যে তো মিলিটারি ম্যান লুকিয়েই আছে। তুই আজ যেভাবে জলে ঝাঁপ দিয়ে আমাকে টেনে তুলে আনলি, এগুলো তো মিলিটারিরাই করে।’
‘তাই?’

‘হ্যাঁ তো। আমরা অরুণাচলে বেড়াতে গিয়ে খুব বিপদের মধ্যে পড়েছিলাম। টেঙ্গা চু নদী বৃষ্টির জলে ফুলে ফেঁপে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। আমরা আটকে পড়েছিলাম বমডিলায় দু’দিন। সে সময় এই মিলিটারি কাকুরাই আমাদের রাস্তা পার করে দিয়েছিল। দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে আমরা রাস্তা পেরিয়েছিলাম।’

সুদীপ এসব গল্পকথা জানত না। তাই সব শুনে ওর ভীষণ ভালো লাগল। সৌরভের হাত চেপে ধরে বলল, ‘তুই তাহলে কুশল স্যারকে বল।’
‘বলব তো। আজই বলব। স্যার তো আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে।’
মালির পুকুর পাড় থেকে এবার দু’বন্ধু ফিরে চলল বাড়ির পথে। সৌরভের জামা প্যান্ট জুতো সব ভেজা। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া দরকার। সুদীপ ওকে বলল, ‘তুই চলে যা বাড়ি। আমি এখন যাই তাহলে।’
‘কোথায় যাবি?’

সুদীপ ঠিক কোথায় যাবে বলতে পারে না।
সৌরভ বলল, ‘তুই এখন আমার সঙ্গে চল। আমাদের বাড়িতে আজ যাবি।’
‘না। না।’
‘আজ তোকে যেতেই হবে আমাদের বাড়ি।’

দু’বন্ধু এবার একই পথে চলেছে। দুটো সাইকেল পাশাপাশি যাচ্ছে। আজ কতদিন পর সুদীপ যাচ্ছে সৌরভের বাড়িতে। কুশল স্যার শুনলে কত খুশি হবেন।