আনন্দদীপ চৌধুরী
সক্কাল সক্কাল একচোট হয়ে গেল সুনন্দর সঙ্গে। হবে না! মালটা সাত সেয়ানার এক সেয়ানা যে। টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না ব্যাটা! সারাক্ষণ শুধু টাকা-টাকা আর টাকা। সুযোগ পেলেই হল। ঝোপ বুঝে কোপ মারে টেনে।
ওই আজ যেমন মারল একটু আগে। প্রথমটায় মটকা গরম হলেও ওর ছোড়া অনৈতিক দাবী মেনে নিলাম শেষমেশ। অনৈতিক নয়! এমনি দিনে ড্রাইভার সেন্টার থেকে পাঁচ ঘন্টার ড্রাইভার নিলে ভাড়া গুনতে হয় চারশো টাকা। আর বিশেষ দিন হলে তো কথাই নেই। ভাড়া হয় দেড়গুণ। মানে চারশোর বদলে ছয়শো। আজ জামাইষষ্ঠী। শ্বশুরবাড়িতে আমার মত ভায়রা-ভাইবিহীন ব্যক্তির নিকট দিনটি বেশ বিশেষই বটে। কিন্তু তা বলে ভাড়াবাবদ ছয়শোর পরিবর্তে আটশো চাইবে সুনন্দ?
ঘটনাটা বিষদেই বলি তবে। বছর ছয়েক আগে জমানো টাকা দিয়ে চারচাকা হ্যাচব্যাক কিনেছিলাম একটা। না, না পুরোটা নয়, জমানো টাকা ব্যয়ে গাড়ি মূল্যের ত্রিশ শতাংশ দাম মিটিয়েছিলাম কেবল। বাকিটা ব্যাঙ্ক প্রদেয় ধারবাকিতে। সে লোন ফুরোতে বছরখানেকের ধাক্কা এখনও। ওদিকে নিজের কেনা গাড়ি আমার নিজের হাতেই চালানোর ইচ্ছা বরাবর। ইচ্ছা বাস্তবায়নের হেতু চেষ্টাও করেছিলাম প্রথম প্রথম। কিন্তু ঘনঘন ক্লাচ-ব্রেক চাপার চক্করে অচিরেই বাধ সেধেছিল গাড়ি চালানোর ইচ্ছা। অগত্যা বাহনের চালক খুঁজতে এলাকার ড্রাইভার সেন্টারের দ্বারস্থ হয়েছিলাম আমি।
এমনিতে ব্যক্তিগত প্রয়োজন ব্যতীত চারচাকাটা বার করি না সচরাচর। আগে যেদিন যেদিন গাড়িটা বেরোত সেদিন সেদিন ফোন করতাম ড্রাইভার সেন্টারে। নতুন নতুন ড্রাইভার পাঠিয়ে বিপন্মুক্ত করত সেন্টার। এ চক্করে হঠাৎ করেই সুনন্দর সঙ্গে আলাপ হল একদিন। প্রথম দর্শনে বছর আটত্রিশের সৌম্যদর্শন ব্যক্তিটিকে ড্রাইভার কম, উচ্চপদস্থ ম্যানেজার বেশি বলে মনে হয়েছিল আমার। এর উপর ছিল কথার মায়াজাল। পাক্কা সেলসম্যানের ন্যায় সুমিষ্ট ভাষণে মাল এমন মোহাবিষ্ট করল আমায়, যে তাকে ছাড়া গাড়ি বার করতে ভরসা পাই না আর। সুনন্দও কথার খেলাপ করে না তেমন। শুধু সেন্টারকে ডিঙিয়ে জার্নি শুরুর ঘন্টাকয়েক আগে ফোন। তাতেই বাড়ির সামনে এসে হাজির হয় সে ।
ওই আজও যেমন ফোন করলাম তাকে। জানতে চাইলাম, ‘সুনন্দ, আজ কি ড্রাইভার সেন্টারের ডিউটি আছে তোমার?’
মৃদু হেসে রহস্য ছড়িয়েছিল সুনন্দ, ‘না, দাদা আজ নো অফিশিয়াল ডিউটি। তবে’
—‘তবে কী সুনন্দ?’
আমার কথা শুনে ঝেড়ে কেশেছিল সুনন্দ, ‘আজ জামাইষষ্ঠী তো, শুধুই ফ্যামিলি ডিউটি তাই।’
সুনন্দর শেষ বলা কথার ব্যবচ্ছেদ করে মনে হয়েছিল জামাইষষ্ঠীতে যাবে বলে আজ অন্য কোথাও যেতে অপারগ সে। হতোদ্যম হয়ে জানতে চেয়েছিলাম তাই, ‘তুমি যাবে না যখন সেন্টারে ফোন করি তবে?’
আমার অন্তিম বাক্যটি শুনে গলার স্বরে মাখন-প্রলেপ এনেছিল সুনন্দ, তারপর ছদ্ম আন্তরিকতা দেখাতে তত্পর হয়েছিল সে, ‘দাদা, তুমি ডাকলে না কীকরে করি বলো! আমি বারোটা নাগাদ আসছি তোমার বাড়ি। কিন্তু…’
—‘কিন্তু কী?’ অস্বস্তির স্পষ্ট ছোঁয়া গ্রাস করেছিল আমার কন্ঠ।
রহস্য খোলসা করতে ফোনের ওপারে শব্দ করে হেসেছিল সুনন্দ। তারপর দাঁত দাঁত চিপে বলেছিল, ‘কিন্তু দুটো কন্ডিশন দাদা। প্রথমত পাঁচঘন্টায় ছেড়ে দিও আজ। আর দ্বিতীয়ত ছ’শোর বদলে আটশো টাকা দিও, কেমন।’ ছ’শোর বদলে আটশো! কথাটা কানে যেতেই দপ করে উঠেছিল মাথা। আজই প্রথম নয়। আগেও বারকয়েক অতিরিক্ত টাকার দাবি রেখেছিল সুনন্দ। তবে সে গন্ডি ত্রিশ-পঞ্চাশের বেশি ছাড়ায়নি কখনও। সে সব ছাড়িয়ে এবার এক্কেবারে দুশো টাকার লাফ! সত্যি, লোভের সব সীমা আজ অতিক্রম করেছে ব্যাটা!
রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘পাঁচঘন্টার বিষয়টা না হয় বুঝলাম সুনন্দ। কিন্তু এক্সট্রা টাকা চাওয়ার বদভ্যাসে তো দিনে দিনে শিল্পী হয়ে উঠছ তুমি।’
—‘কী যে বলো দাদা!’ সুনন্দ একটু আগের সশব্দ হাসির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বলল, ‘এ তো চাওয়া নয়। তোমাকে বড় দাদা বলে মানি, তাই আবদার করেছি কেবল। তাছাড়া বাজারে সবকিছুর দাম কী বেড়েছে বল। এ ক’টা টাকায় চলে ঠিকঠাক!’
সুনন্দর এহেন দাবি শুনে সেকেন্ড কয়েক নিরুত্তর ছিলাম প্রথম। ক্রমে ভিন্ন একটা চিন্তা গ্রাস করেছিল মাথা। মনে হল সুনন্দ নিজেও আজ শ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রিত, সে কারণ দর্শিয়ে হেলায় প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল তার। কিন্তু ও পথে না হেঁটে আমার অনুরোধের মর্যাদা দিয়েছে ব্যাটা, এক্সট্রা ক’টা টাকার বিনিময়ে গাড়ি চালাতে রাজি হয়েছে শেষমেশ। তাই দুশো টাকার অতিরিক্ত দাবীকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার চেষ্টায় ব্রত হলাম ক্রমে। আর সে কথা মনে আসতেই রাগটা গেল গলে। ফলস্বরূপ ওর দেওয়া অন্যায্য শর্তদুটি নিলাম মেনে। মনে অবশ্য ছোটোখাটো কৌতূহল ছিল তখনও। তা নিরসনে প্রশ্ন করলাম ওকে, ‘একটা কথা বলো সুনন্দ, আজ কি তোমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া বাতিল করলে শেষমেশ?’
—‘সে উপায় নেই দাদা। তোমার ডিউটি সেরে রাতে যাব শ্বশুরবাড়ি।’ স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি মুখে মেখে ফোন রেখেছিল সুনন্দ।
সুনন্দ রাতে যাবার প্ল্যান করলেও আমি কিন্তু এ ব্যাপারে বরাবরের পাংচুয়াল। আজকেও বেলা বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেলাম শ্বশুরবাড়ি। ছেলের স্কুলে সামার ভেকেশন এখন। সে কারণে স্ত্রী-পুত্র চলে গেছে আগেই। চারচাকা গাড়িতে আজ সওয়ারি কেবল আমিই, সঙ্গে আছে শাশুড়িমার জন্য কেনা নতুন একটা শাড়ি আর কেজি প্রতি আড়াইশো টাকা মূল্যের মহার্ঘ দইয়ের হাঁড়ি। হ্যাঁ রসগোল্লার বদলে দইয়ের হাঁড়ি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই আসল বাস্তব। সত্যি বলতে রসগোল্লার হাঁড়িই নিয়ে যেতাম আগে। কিন্তু তেমন সদ্ব্যবহার হত কই? শাশুড়িমা, রান্নার মাসিকে বিলিয়ে দিতেন সব। হয়ত উনি পছন্দ করেন না তেমন। ওদিকে আমাদের দিকের দইয়ের সুখ্যাতি জগৎ জোড়া, তার উপর শাশুড়িমারও ফেভারিট তা। সে কারণে সঙ্গীবদলের নয়া এ প্রয়াস।
এমনি দিনে শ্বশুরবাড়ি যেতে মিনিট পঁয়ত্রিশেক সময় লাগে আমার। তবে জ্যাম লাগলে ক’টা মিনিট বেশি লাগে আরও। সত্যি বলতে এটুকু পথ যেতে এযাবৎকাল অস্বস্তি হয়নি কোনো। তবে আজ হচ্ছে বেশ। আসলে গরমটা যে খুব। তার উপর গাড়ির এসিটাও গেছে বিগড়িয়ে। এতদসত্ত্বেও চালিয়েছিলাম তা। কিন্তু গরম হাওয়ার তীব্র ঝলক পেয়ে আশাহত হয়েছি একচোট।
শ্বশুরবাড়ি আসার পথে আজ রাস্তাঘাট ফাঁকা পেলাম বেশ। তার উপর ঘর্মাক্ত কলেবর-ধারী অত্যুত্সাহী জামাইদেরও দেখা পাইনি তেমন। তবে কি তীব্র দহনের কাছে হার মানল জামাইবাহিনী? নাকি বিশ্রী গরমের কথা মাথায় রেখে গত সন্ধ্যাতেই ভিড় জমিয়েছে সব? মাথায় আসা প্রশ্নগুলোর অভিঘাতে শরীরটা অস্থির লাগে ভীষণ।
যাই হোক, গাড়িতে করে শ্বশুরবাড়ি আসার ইতিপূর্বের সব রেকর্ড ব্রেক করেছি আজ। হ্যাঁ, ফাঁকা রাস্তার সৌজন্যে পঁচিশ মিনিটে শ্বশুরবাড়ি পৌছে গেছি আমি। তারপর প্রণাম আর টুকিটাকি রীতিনীতির অধ্যায় সেরে সেঁধিয়ে গেছি সোজা শ্বশুরের বেডরুমে। কালবিলম্ব না করে দেড়টনের স্প্লিট এসিটাও চালিয়ে দিয়েছি এরপর। মিনিট দশেকের প্রতীক্ষা। গোটা ঘর ঠান্ডা হাওয়া নেমে এল ক্রমে। উফ! কী অপার শান্তি এবার! চোখদুটো বুজে এল ধীরে, নরম বিছানায় নিজের অজান্তেই এলিয়ে দিলাম শয্যাপিয়াসী শরীরটা।
—‘কী গো, খাবে না নাকি? আড়াইটে বাজতে চলল যে!’ স্ত্রীর আচমকা ডাকে সুখনিদ্রা নিপাত গেল আমার। চোখ খুলে উঠে বসলাম দ্রুত, তারপর মৃদু হেসে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম ক্রমে, দেখি এক থালা জামাই আদর হাজির সে স্থানে। মনটা খুশিতে নেচে উঠল কেমন। বড়ি দিয়ে আড় মাছের ঝোল থেকে কচি পাঁঠার মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারি থেকে ইলিশ মাছের পাতুরি। কী নেই আজ! একে একে সব হাজির হয়েছে মেনু তালিকায়। উদরপূর্তি সারতে সারতে সওয়া তিনটে বাজল প্রায়। এবার একটু ভাত-ঘুমের পালা।
খাওয়া সেরে এই সবে মাথা রেখেছি বালিশে, ঠিক এ সময় শাশুড়িমার প্রবেশ ঘরে। অপরিমিত আহারে শরীর তখন এমনিই আইঢাই তার উপর দুচোখ বেয়ে ঘুম নেমেছে তেড়ে। স্বভাবতই বিরক্ত হলাম বেশ। কিন্তু তা লুকিয়ে ছদ্ম হাসি মুখে ঝুলিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কিছু বলবেন মা?’
—‘হ্যাঁ, বলছিলাম কি আজ তো ষষ্ঠীর দিন। তা তোমার ড্রাইভারকে একটু ফল-মিষ্টি-জল দিয়ে আসি?’ প্রশ্ন রাখেন শাশুড়িমা।
শাশুড়িমার করা প্রশ্নে শয়ন অবস্থা থেকে উঠে বসলাম সটান, এরপর হাত নাড়িয়ে বললাম, ‘না-না, মা। একদম নয় মা। ড্রাইভার তো নিজেও জামাইষষ্ঠী যাবে সন্ধ্যাবেলায়। তাছাড়া আজ সকালে সে কী বলেছে জানেন?’
—‘কী?’ শাশুড়িমার গলায় একরাশ কৌতূহল।
বিস্তারিত জানাতে মাথার বালিশটা কোলের উপর নিলাম এবার, তারপর বলতে শুরু করলাম। —‘বলে কিনা ওর দেওয়া দুটি শর্ত মেনে নিলে তবে গাড়ি চালাবে আজ। তার মধ্যে একটা হল পাঁচটার মধ্যে বাধ্যতামূলক ছেড়ে দিতে হবে তাকে। বাবু নাকি শ্বশুরবাড়ি যাবেন সন্ধ্যায়।’
আমার কথায় মৃদু হাসেন শাশুড়িমা, ‘তা জামাইষষ্ঠী বলে কথা। এটুকু আবদার তো করতেই পারে সে।’
—‘আবদার!’ চমকে উঠি আমি, ‘আমি কি তাকে জোর করেছিলাম মা! ও না করে দিলে অন্য কাউকে সেন্টার থেকে নিয়ে নিতাম ঠিক।’
—‘সে ঠিক। যাক বাবা রাগ কর না আর।’ কথাটা বলে ঘর ছাড়তে উদ্যোগী হলেন শাশুড়িমা। তবে ছাড়ার আগে ড্রাইভারের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করলেন তিনি, ফের একবার। —‘আজ আসলে গরম তো খুব। রাস্তাঘাটও খাঁখাঁ পুরো। তাছাড়া গাড়ির ভেতরও গরম বেশ। আর তো অল্প সময়ের অপেক্ষা। ড্রাইভারকে ডেকে নীচের ঘরে বসতে বলি একটু?’
—‘মা, উদ্বিগ্ন হবেন না অতো।’ এই প্রথম গলার স্বর চড়াই আমি, ‘জানেন, এখানে আসবে বলে পাঁচ ঘন্টার শর্ত ছাড়াও নির্ধারিত রেটের থেকে দুশো টাকা বেশি চেয়েছে সে। তাছাড়া গরমে গাড়িতে বা খোলা রাস্তায় ওয়েট করার অভ্যাস ভালোই আছে ওদের। কোনো কষ্ট হবে না।’
আমার কথা বোধহয় মনপসন্দ হল না তেমন। তাই অতৃপ্তিদায়ক একটা হুম ছেড়ে ঘর ছাড়লেন শাশুড়িমা। তিনি চলে যেতেই টের পেলাম ঘরটা ঠান্ডা হয়েছে বেশ। এই হল এসির এফেক্ট। বাইরে যখন চুয়াল্লিশের গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ, ভিতরে তখন প্রাণজুড়ানো আরাম। স্ত্রীকে ডেকে চাদর নিলাম একটা, তারপর পায়ের উপর ছড়িয়ে দিলাম তা। আহ! কী আরাম! এমনিতেই শাশুড়িমার বকবকানিতে নষ্ট হয়েছে ঘুমের দশটা মিনিট। আর নষ্ট করলে ঘুম বাবাজি চটে যাবেন নির্ঘাত।
কিছু কিছু দিন থাকে এমন, যেদিন সাউন্ড স্লিপের বারোটা বাজাতে কোনো না কোনো সাউন্ড হাজির হয় ঠিক। আজ যেন তেমনই এক দিন। না হলে শাশুড়িমা চলে যেতেই ফোনরিংটা বেজে উঠবে কেন! ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখদুটো খুলে দেখি সুনন্দ কলিং। কী ব্যাপার! পাঁচ ঘন্টা ফুরোতে ঘন্টাদেড়েক বাকি এখনও। মালটা তবু ফোন করছে কেন? বিরক্তি নিয়েই ফোনটা ধরি আমি। —‘হ্যালো।’
ফোনের ওপারে ভেসে আসে সুনন্দর কন্ঠ, ক্লান্ত তবে সজাগ। —‘দাদা, আজ গরমটা খুব বেশি। সে কারণে ঘাম হচ্ছে খুব, এখন আবার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে শরীরে। দেখবে, যদি একটু আগে বেরোন যায়।’
ঘাম হচ্ছে! অস্বস্তি হচ্ছে! এসব কী শুরু করেছে কী সুনন্দ! আগেও তো গরমে বহুবার আমার সঙ্গে ডিউটিতে গেছে সে, গাড়িতেই ঘন্টার পর ঘন্টা থেকেছে, কই কখনও তো এসব অজুহাত দেখায়নি সে! তবে আজ কি জামাইষষ্ঠী যাবে বলেই মিথ্যাভাষণের আশ্রয় নিয়েছে সে? নিশ্চয়ই তাই। মনে মনে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই তেতোমুখে ঝাড় দিই তাকে, ‘এক্সট্রা টাকা চাইবে আবার পাঁচ ঘন্টার কম ডিউটিও করবে, সব কি একসঙ্গে হয় সুনন্দ? ঠিক সময়মত বেরোব আমি। ফোন করে বিরক্ত কর না আর।’ কথাটা শেষ করে ফোনটা কেটে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাই আমি।
সময়জ্ঞান বিষয়টাকে ছোটোথেকেই বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখি আমি। আজও ব্যতিক্রম ঘটে না তার। ঠিক চারটে বেজে বাইশ মিনিটে ভাতঘুমটা ভাঙে আমার। এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তৈরি হয়ে নিই আমি। এরপর পাশের ঘরে ঢুঁ মারতেই দেখি টিভি দেখছে সব। সব বলতে সবই, শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে স্ত্রী-পুত্র, সবার চোখ যেন আটকে টিভির দিকে। আমায় দেখে হুঁশ ফেরে ওদের। সবার উদ্দেশে হাত নেড়ে সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির মেইন গেটের দিকে ধাবিত হই দ্রুত। পিছন পিছন সি-অফ করতে সঙ্গ দেয় স্ত্রীও। হ্যাঁ, আজ বাড়ি যাবে না ও। ছেলের স্কুল খুলতে ঢের দেরি এখনও। পতিগৃহে থাকার মেয়াদ দিনকয়েক বাড়িয়েছে তাই।
আমার শ্বশুরবাড়ির মেইন গেটের পাশে ফাঁকা মাঠ আছে একটা। বিকেলবেলা হলে ছেলেপিলে খেলতে নামে ওতে। এখানে এলে সে মাঠেই সাইড করে রাখি গাড়ি। আজও সেখানেই আছে গাড়ি। আর গাড়ির ভিতর আছে সুনন্দ। রোদের তাপটা এখনও কমেনি সেভাবে। তার উপর হাওয়াও নেই সেরকম। রাস্তায় পা রাখতেই ফিনকি দিয়ে ঘাম ছেড়েছে আমার। তার উপর গাড়ির ভিতর উঁকি মারতেই দেখি, ঘাড় এলিয়ে ঘুম দিয়েছে সুনন্দ। সত্যি, আচ্ছা বেয়াক্কেলে ছেলে এ সুনন্দ! আমায় জলদি আসতে বলে নিজেই কেমন ঘুম দিয়েছে দেখুন! ঠিকই ধরেছিলাম তখন। ঘাম হওয়া, অস্বস্তি লাগা এসব ওর মিথ্যাভাষণের অঙ্গ বই অন্য কিছু নয়।
ঘুম ভাঙাতে সুনন্দর কানের কাছে সজোরে চেঁচাই এরপর, ‘সুনন্দ, উঠে পড়ো। আমি এসে গেছি। পাঁচটা বেজে গেলেই তো আবার এক্সট্রা চার্জ করবে তুমি।’
কিন্তু আমার কথায় আজ আশ্চর্যজনক নিরুত্তর থাকে সুনন্দ। কী ব্যাপার! পিছন থেকে উদ্বিগ্ন স্ত্রীও ডাক দেয় তাকে। না, দিবানিদ্রা ভাঙার নামই নেই সুনন্দর। মজা পেয়েছে নাকি ব্যাটা। এক্সট্রা টাকা নেবে আবার ঘুমও দেবে জমিয়ে। রাগটা ক্রমেই জাঁকিয়ে বসে মাথায়। ফলস্বরূপ গাড়ির জানলা দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারি তাকে। কিন্তু একি! ধাক্কা দিতেই ঘাড় এলানো বডিটা সিটের কোলে ঢলে পড়ে কেমন। এই প্রথম ঘর্মাক্ত মুখটা নিরীক্ষণ করি সুনন্দর, কেমন একটা নিথর লাগে যেন। ঠোঁটদুটোর মাঝেও অদ্ভুত এক ফাঁক। গায়ে হাত দিতে টের পাই শরীরটাও ঠান্ডা খুব। কী হয়েছে সুনন্দর? এমনভাবে নেতিয়ে আছে কেন? পালস রেটটাই বা থেমে গেছে কেন? আবদার করা অতিরিক্ত দু’শো টাকা নেবে না নাকি সে? প্রশ্নগুলোর দাপটে মাথার উদ্ভুত রাগটা ঝিমিয়ে আসে দ্রুত। অদ্ভূত এক বিমূঢ়তা গ্রাস করে আমায়। চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে আসে ক্রমে। দিশা হারিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি আমি।