সুতপা সোঽহং
‘এই এই এই ছেলে! এই
সবুজ সোয়েটার! বলতো মাইটোকন্ড্রিয়া কী?’
স্যারের চিল চিৎকারে রিকের সম্বিত ফেরে। ও হতভম্ব হয়ে তাকাতেই স্যারের বাজখাঁই গলা আবার চিৎকার করে ওঠে, ‘কী হলো? মাইটোকন্ড্রিয়া কী বল? না বলতে পারলে বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়া।’
রিক গুটিগুটি পায়ে ক্লাসরুমের বাইরে বের হয়ে আসতে নিতেই স্যার আবার আটকায় ‘এটা হাতে কী পরেছিস? স্মার্টওয়াচ! এদিকে পড়াশোনায় লবডঙ্কা বাবু আবার স্মার্টওয়াচ পরে!’
একটা হাসির রোল উঠলো। ফার্স্ট বয় অনিক পাশ থেকে টিপ্পনি কাটলো ‘স্যার, এটা নিশ্চয় ও চুরি করেছে। ওরা ঠিক করে খেতেই পায় না। ওরা যে গরীব স্মার্টওয়াচ কিনবে কোথা থেকে?’
‘চোর চোর’ কয়েকটা গলা আশপাশ থেকে ফিসফিস করে ওঠে।
স্যার চেঁচিয়ে ওঠেন ‘সাইলেন্স সাইলেন্স! এই সবুজ সোয়েটার দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? যা বাইরে গিয়ে কান ধরগে।’
বাইরে গিয়ে কান ধরতেই অপমানে রিকের দুচোখ ফেটে জল এলো। যত নষ্টের গোড়া এই স্মার্টওয়াচটা। আজ স্কুলে আসার পথে জিনিসটা রাস্তায় পড়েছিল। এর আগে স্কুলের কয়েকজন বন্ধু, বড় ক্লাসের দাদাদের হাতে দেখেছে জিনিসটা। একটু এদিক ওদিক দেখে ঘড়িটা তুলে পরেও নিয়েছে। মাঝখানে বেশ কয়েকবার স্মার্টওয়াচটার গায়ে হাত বুলিয়েছে; পাশের বোতামগুলো টিপেছে। কিন্তু ঘড়িটা শুধু
ভোঁ-ভোঁ করে ভাইব্রেট করে থেমে গেছে। ঘড়িটা কি নষ্ট? হয়তো সেইজন্যই কেউ জিনিসটা ফেলে দিয়েছে। স্ক্রিনটা পর্যন্ত অন হয় না। এই নষ্ট ঘড়িটার জন্যই আজকে ওর চোর অপবাদ শুনতে হলো। রিক হাতের তেলোয় আরেক ফোঁটা চোখের জল মুছতে গেল। কিন্তু সেটা মোছার আগেই জলের ফোঁটাটা পড়ল ঘড়িটার উপরে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটা খুব জোরে জোরে ভোঁ-ভোঁ করে কেঁপে উঠলো। কম্পনটা এতো জোরে যে রিকের মনে হলো পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো। ও দেখতে পেল ওর চারপাশের মাটি ফেটে গেছে। হঠাৎ ওকে সুদ্ধ ওর চারপাশের মাটি ধসে পড়ল কয়েক হাজার ফিট নীচে। যখন ওর জ্ঞান ফিরলো, দেখলো বড় একটা আলোকিত জায়গায় সে শুয়ে আছে। চারপাশে বড় বড় নানারকম যন্ত্র। সেগুলোতে লাল নীল নানারকম সুইচ। সে উঠে বসার চেষ্টা করতেই একটা ধূসর রঙের রোবট এগিয়ে এলো। রোবটটা যান্ত্রিক স্বরে বলে উঠলো ‘রি২২৩, তুমি ঠিক আছো?’ রিক একটু ভাবলো ‘রি২২৩’-টা আবার কে? এমন বিদঘুটে নাম তো বাপের জন্মে শোনেনি। রিককে চুপ থাকতে দেখে রোবটটা আবার বলে উঠলো, ‘রি২২৩, তুমি কি কিছুই মনে করতে পারছ না? আমাকে কি চিনতে পারছ না?’
রিক না সূচক মাথা নাড়ালো।
রোবটটা বলে উঠলো ‘রি২২৩, আমাদের এই রোবট জগতের নিয়ম অনুসারে তোমাকে যে তথ্যগুলো দিতে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ তা হলো:
১) এই নিয়ে তুমি ১০৩৬ বার মানুষের রাজ্য থেকে ঘুরে এসেছো।
২) প্রত্যেকবারই তুমি তোমার রোবট সত্তাকে ভুলে গেছ এবং মানুষের মতো আচার আচরণ করেছ।
৩) আমাদের রোবট দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রায় নিখুঁত রোবটটা হলে তুমি।
৪) তোমার আইপি অ্যাড্রেস হলো ৩৪৫ঙ৪ৎড়৬ঔ’
রিক হাঁ করে শুনছিল এসব কী বলছে রোবটটা। সে কেন রোবট হতে যাবে? সে তো রক্তমাংসের মানুষ যার সুখ আছে, দুঃখ আছে, অপমানবোধ আছে। রিক চেঁচিয়ে উঠলো, ‘চুপ করো। সব মিথ্যে। আমি মার কাছে যাব।’
রোবটটা আবার যান্ত্রিক স্বরে বলে উঠলো ‘রি২২৩, তুমি আবার নিজেকে মানুষ ভাবছো। শোনো রোবটের সুখ, দুঃখ কোনো কিছুর অনুভূতি থাকে না। তোমার স্মৃতি আমি নষ্ট করে দিচ্ছি।’
রোবটটার একটা হাত ওর মাথার কাছে নেমে এলো। রিক তড়াক করে নিজেকে সরিয়ে নিল। এখান থেকে তাকে পালাতে হবে। ওর পিছন পিছন রোবটটাও দৌড়তে শুরু করেছে। বড় বড় পা ফেলে রোবটটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। রিক কিছুদূর যেতেই সামনে একটা দরজা দেখতে পেল। কোনো কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখটা একটু সয়ে আসতেই দেখতে পেল একটা ত্রিভূজাকৃতির এরোপ্লেন ধরনের আকাশযান ল্যান্ড করা আর তার ককপিটে একটা গোলাপি রংয়ের রোবট। ওর মনে পড়ল ধসে নীচে পড়ার আগে স্মার্টওয়াচের স্ক্রিনে যে রোবটের মুখটা দেখেছিল সেটাই এটা। হঠাৎ গোলাপি রোবটটা ককপিট থেকে নেমে বলে উঠলো, ‘এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা একটাই। যেভাবে এসেছো সেভাবেই ফেরত যেতে হবে।’ ফেরার কথা বলতেই রিকের মার জন্য বুকটা আরেকবার আনচান করে উঠল। এক ফোঁটা জল চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে এলো। গোলাপি রোবটটা ঝট করে রিকের স্মার্টওয়াচটা নীচে ধরলো। জলের ফোঁটাটা সেখানে পড়তেই ঘড়িটা ভোঁ-ভোঁ করে তীব্রভাবে কম্পিত হলো। রিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা জোরে ভূমিকম্প হলো আর দেখল সে শুয়ে আছে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে। ওর খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুমে দুচোখ বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে সে শুনতে পেল তার মা খুব আস্তে ঠোঁট নেড়ে বলছে, ‘রোবট নং রি২২৩ আরো একবার মানুষের দুনিয়ায় এসেছে মানুষের আকুলতা ও ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে। এটা তার ১০৩৭তম যাত্রা। তার যাত্রা ও অভিজ্ঞতা শুভ হোক।’