ময়ূরী মিত্র
ধীরেন নামে ল্যাম্পপোস্টটা তুমুল ভিজছে৷ দু’দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি৷ ভিজে একশা ধীরেন আর ধীরেনের মাথায় সর্বক্ষণ বসে থাকা ভুলু কাক! সে ব্যাটা এমন ভিজেছে, কালো পালকগুলো কয়েকগাছা দড়ি হয়ে গেছে! পেটেও দানা নেই৷ একমাস হল আকাশে উড়তে গিয়ে ডানায় আঘাত লেগেছে৷ প্লেনটা একদম কাছে এসে পড়েছিল৷ প্রবল শব্দে বাতাস খুব কাঁপছিল৷ তার মধ্যেও ভুলু চেষ্টা করেছিল তার আর প্লেনের ডানার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করতে৷ মনের আলোচনা অপরপক্ষ টের পায় না৷ সাঁ করে প্লেনটা চলে গেল। ভুলু দেখল তার কালো পালক ডাটি ভাঙা রজনীগন্ধার মতো আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে৷ ডানায় ব্যথাও শুরু হয়ে গেল৷ সেই যে আকাশ ছেড়ে ধীরেনের মাথায় এসে বসল, আর ওড়েনি৷ সকালে ডিমের খোলা থেকে শিকনি লাগা রুমাল চোষা— সব ধরনের খাবার সে গ্রহণ করে ধীরেনের মাথায়৷ পটি, সেও ধীরেনের নাকে৷ পেটখারাপ হলে পটি বেশি তরল আর চুনবর্ণ হয়ে যায়৷ ধীরেনের মাথা থেকে সুড়ুত করে গড়িয়ে পড়ে লোকের মাথায়৷ লোকে ওপরে তাকায়! এনতার খিস্তি খেয়েও ভুলু তখন খুব হাসে৷ তবু তো বর্জ্যের সূত্র ধরে পাড়ার মানুষ তার অস্তিত্ব এখনো বোঝে!
নতুবা ডানার যা অবস্থা তাতে মানুষ আর কদ্দিন মনে রাখবে! যার যা ধর্ম তা তো তাকে পালন করতে হবে রে বাপু! না উড়তে পারলে ভুলু যে পাড়ার কাক তা লোকে মনে রাখবে কেন! এই মনে না রাখায় লোকের তেমন দোষ দেখতে পায় না ভুলু৷ এই যে দত্তবাড়ির মেয়ে ঈশানী সেই ছোটবেলা থেকে সেদিন অব্দি, বেলা দশটা বাজলেই রান্নাঘরের টিনের চালে এঁটো সাজিয়ে রাখত, আলাদা এক টুকরো খবরের কাগজে দুধের ছাঁচি রাখত— এখন সে সব করে কি! দশটায় ভাত ডাল আলুভাজা খেয়ে গটগটিয়ে কলেজ চলে যায়! পাতে এঁটো রাখার মতো মেনুই নেয় না৷ কারণ ভুলু নেই৷ কিংবা ভুলু হয়ত আছে কিন্তু তার ভুলুত্ব নেই৷ ধীরেনের মাথায় একটুকরো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে! নাহ! ঈশানীর ভুলে যাওয়ায় কোনো ভুল দেখা উচিত না৷ বরং ঈশানীর সঙ্গে তার সোনার দিনগুলো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা যায়৷ নীল স্ল্যাক্স পরা ছয় বছরের ঈশানী লুকিয়ে লুকিয়ে বোয়াল মাছের গোটা পিস ভুলুকে দিয়ে দিচ্ছে৷
—ভুলু কাঁটা বেছে দেব? খেতে পারবি গোটাটা? হাঁ, কর দেখি! দেখি গলার ফুটোটা কত বড়! হাত ঢোকাতে দে বলছি! বোয়াল গলবে কিনা দেখি!
উফ! কত যে প্রশ্ন তখন ঈশানীর! কী মিষ্টি গলা ছিল মেয়েটার! সন্ধেবেলা পিকলু মাস্টার গান শেখাতে আসত৷ ঈশানী গাইত, দূরদ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি! দারুচিনির দেশে…! কমন দাওয়ায় বসে, চক্ষু মুদে ভুলু ঈশানীর গান শুনত৷ একটা মাত্র ঘর ছিল ঈশানীদের৷ দুপাশে রাখু মুদি, অনিল ডেকরেটারের সংসার৷ ওপরে থাকত পুষ্প বাড়িওয়ালির দুই বোনের ফ্যামিলি৷ পুষ্প মরে বাড়ি দুই বোনকে দিয়ে গিয়েছিল৷ বোন দুটো সারাদিন নীচতলার তিন ভাড়াটেকে ওঠাবার ধান্দা করত। আর সন্ধেতে দু-বর ফিরলে চাট মশলা খেতে খেতে ঈশানীর গান শুনত! আট-ন’ বছরেই ঈশানী কলকাতার নামী চ্যানেলের গান বাংলা প্রোগ্রামে চান্স পেয়ে গেল৷ তিন নম্বর রানার আপ হয়ে যেদিন পাড়ায় ফিরল, ভুলু ধীরেন পুষ্পর দজ্জাল বোন— সবার কী আনন্দ! বিকেলে দোতলার বারান্দায় উঠে পুষ্পর ছোট বোনের ল্যাংটাপোঁদা মেয়েটাকে কোলে নিয়ে চাট খাচ্ছিল ঈশানী৷ আটের কোলে চারের খুকি! ভুলুকে উড়তে দেখে মশলা মাখা ছোলা ছুঁড়ে দিল! মুগ্ধ চোখে চক্কর দিচ্ছিল তার প্রিয় কাক…!
—এই ভুলু! নে আজ হাফ টিকটিকি আর একটা পেঁয়াজি৷ এই পেলাম৷ সাবধান! ঠিক করে সাজিয়ে রাখ৷ নাহলে ল্যাম্পের শেড থেকে গড়িয়ে নীচে চলে যাবে খাবার! রাজেশ্বরী চিল রেগুলার রেশন বিলোতে এসেছে৷
মানুষখোর চিল ভুলুকে ভালোবাসে মন দিয়ে৷ উড়তে পারে না দেখে রোজ ভুলুকে নিজের ভাগের আদ্ধেক দেয়৷ রাজেশ্বরী দিয়েই ওপরে উঠে গেছে৷ চোখের বিন্দু মুছে ভুলু খাবারে মুখ দিল৷ খাবার এলে সব ভুলতে হয়! বিশেষ করে যাদের জোগাড়ের ক্ষমতা থাকে না৷ ছেলেবেলায় মায়ের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করল ভুলু৷ কিন্তু টিকটিকি কোথায় পেল রাজেশ্বরী মাসি! গেরস্তের দেওয়াল ছেড়ে টিকিটিকি কি আজকাল পথে হাঁটে নাকি! দু’বছর পাথর হয়ে থেকে ভুলু এখন পরিচিত সরীসৃপটির অজানা গতিপথ কল্পনায় ব্যস্ত৷ মরা টিকটিকির পচামি বাসি পিঁয়াজির সঙ্গে মিশে পরস্পরের গন্ধ ঢাকছে৷ বৃষ্টির চোটে বাল্ব নিভে গেলেও ধীরেনের হেলদোল নেই৷ অক্ষমের থেকে চিরস্থবিরের সুবিধে বেশি৷
২
সমরেশদা —এই যে আমি —সমরেশদা আমি এদিকে —আরে এই হাঁদা কোনদিকে তাকাচ্ছিস রে— তোর মতো আমার মাথায়ও ছাতা! দেখতে পাচ্ছিস না! ও রাখুদা! হেব্বি শেয়াল তো তুমি! দেখছ, পিছলে যাচ্ছি! তবু হাসছ! ইচ্ছে করে অন্যমনস্ক থাকা তোমার বার করছি! সমরেশদাকে দাঁড় করাও বলছি! পাস করে যায় যদি সমরেশদা… রাখুদা ছাড়ব না তোমায়…
—জলভরা রাস্তায় নাগাড়ে কথা বলে রাখু মুদিকে অস্থির করে তুলল ঈশানী৷ রাখু হাসছিল৷ ঈশানীটা পাগলা আছে৷ আর খুব ডেসপ্যারেড৷ সবাই দেখছে৷ ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছে না৷ তাও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মদ্দ ডাকছে পাগলি! বিপদ বুঝে রাখু নয় বাই আটফুটের দোকানে সমরেশকে আটকাল৷ হাতে চাও ধরিয়ে দিল৷ পাঁচ টাকার কাগজের কাপ চোখে দেখা যায় না৷ সমরেশের মাথার মতোই সেটা যখন তখন এদিক সেদিক লুকিয়ে পড়ে৷ বিরক্ত মুখে চা গলায় দিল সমরেশ৷ দুটো ছোট ঢোকে ফুট্টুস চা শেষ৷
হাঁটু অব্দি প্যান্ট গুটিয়ে দোকানের কাছে চলে এসেছে ঈশানী৷ চামড়ার ব্যাগটা দড়াম করে বেঞ্চে নামিয়ে কলতলায় পা ধুতে গেল৷ একটু আগেই কানু সেখানে ঘুঘনির প্লেট ধুতে গেছে৷ এই রে! আজ আবার ঈশানীর সঙ্গে ঝগড়া বাধবে কানুর৷ রোজ টিউশনি থেকে ফেরার পথে একবার করে রাখুর দোকানে ঢুঁ মারে ঈশানী৷ এসেই মুখ হাত ধুতে কলতলায় ছুটবে৷ আর কানু খেপবে৷ কানুর কাজ খুব গোছানো৷ একটা একটা করে প্লেট আগে জলে ধোবে৷ তারপর আবার সেগুলোকে একটা একটা করে সাবান দিয়ে ধোবে৷ ঠিক এইসময় ঈশানী গিয়ে বাসন বালতি এদিক ওদিক সরিয়ে পা মুখ ধুতে লাগে৷ গরম হলে রুমাল ভিজিয়ে কানের দুপাশে বুলোবে৷ আর কানু চেঁচাবে! আজো চেঁচাল কানু—
রাখুদা, আজ কাজ ছাড়ব৷ এসে দেখো ঈশানীর কাণ্ড৷ নোংরা জল মাড়িয়ে এসে সেই পা দিয়ে বাসন সরাল৷ আবার জল মাড়িয়ে বাড়ি ফিরবে৷ তাও বাসন মাজার কলতলায় গু মাখা পা নাচাচ্ছে! সর …সর বলছি! বালতি দিয়ে মাথা গুঁড়ো করব তোর!
কানুর মুখে জল ছিটিয়ে দিল ঈশানী৷ দু-মুঠো জল নিয়ে এবার ছুটে আসছে সমরেশের দিকে৷ খদ্দেররা হাসছে৷ রাখুর দোকানের খদ্দের সব এলাকার মানুষ৷ ধীরেন ল্যাম্পপোস্টের চারপাশের বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংসার করে৷ আর রোজ ঈশানীর কাণ্ড দেখে মজা মারে৷ সন্ধের এই সময় রাখুর দোকান জমিয়ে রাখে ঈশানী কানু৷
আজ কিন্তু লাস্ট রাখুদা …ওকে সাবধান করে দিও৷ শয়তান মেয়ে একটা…
—বলতে বলতে বাসন মাজায় ফিরল কানু৷
রাখু এক প্লেট ঘুঘনি আর দুটো টোস্ট দিল ঈশানীকে—
আগে খা৷ তারপর সমরেশের সঙ্গে কথা বলবি৷ ঘুঘনিতে আজ কিমা পড়েছে৷ মুরগির অবশ্য৷ তবে গন্ধ লাগবে না৷ বেশি করে গরম মশলা দিয়েছি৷
আর একটা প্লেট দে, রাখুদা—
আমি খাব না রে৷ বৌদি আজ চাউমিন করবে৷ না খেলে রেগে লাল৷ তোর কথা মানে তো জেরক্সের দোকান৷ কদ্দুর এগোল— তাড়াতাড়ি বল৷
—বলতে বলতে প্যাকেট থেকে ক্লাসিক ঠোঁটে নিল সমরেশ৷
ঈশানী ধীরে সুস্থে ঘুঘনিতে পাউরুটি ডোবাল৷ সে জানে সমরেশের এই নির্লিপ্তি বানানো৷ হাজার প্লেট চাউমিন পড়ে থাকলেও দোকানের কথা না শুনে সমরেশ যাবে না৷ দোকানে পঞ্চাশ শতাংশ ভাগ রাখুদার৷ সমরেশ আর ঈশানীর পঁচিশ-পঁচিশ৷ সমরেশ খানিকটা লোনের এপ্লাই করে দিয়েছে৷ বাদবাকি সব রাখুদার একাউন্ট থেকে৷ গতর ঈশানীর৷ ব্রেইন পুরো সমরেশের৷
—আগে কথা শেষ কর, ঈশানী৷ পুষ্প বাড়িওয়ালির বোনের সঙ্গে কথা ফাইনাল করেছিস? ঘরটা দেবে কবে থেকে বলতো! —সমরেশ অধৈর্য হচ্ছিল ৷
ঈশানীর খাওয়া শেষ৷ রাখুকে টাকা দিল৷ কাল আর আজের৷
রাখুদা তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাড়ি আয়। সকাল থেকে বৃষ্টি৷ শালা কেউ বেরোবে না বাড়ি থেকে৷ পুষ্পর বোন ঘরের চাবি দিয়ে দেবে আজ। দেখে নিবি… রঙ করতে হবে কিনা…!
জলে নেমে ঈশানীকে টানল সমরেশ৷
দু’জনের বাড়ি ধীরেনের ডান ও বাম কোণে৷
ঈশানীর হাতে জোর জোর চাপ পড়ছে৷ সমরেশের ঠোঁট নেমে এসেছে ঈশানীর কানের লতিতে—
একটা কাচের ডিভিশন করতে হবে ঈশানী৷ রাখুকে বলবি৷ তুই বললে না করবে না! বিয়ের পর তোর টিউশন আমার জেরক্স… শোধ হয়ে যাবে…
মুখ নীচু করে হাঁটছে ঈশানী৷
কাল সকালে উঠেই পার্টি অফিসে গিয়ে মিস্ত্রীর কথা বলতে হবে৷
ধীরেন গোটা সন্ধে আঁধার হয়ে আছে৷
জলে সমরেশের ঝকঝকে হাসিটা দেখা যাচ্ছে না৷
৩
কিছু রোদে খুশি থাকে৷ আজ তেমন রোদ৷ চওড়া সবুজ পাড়ের শাড়ি পরে পুজোর ফল কাটছে রাখি৷ আজ দেওরের দোকানের উদ্বোধন৷
বেলা বারোটা নাগাদ পৌরমাতা নিভা পাল এসে ফিতে কাটবেন৷
বৌদির মতো তাঁর জন্যেও গরদের শাড়ি কিনেছে সমরেশ৷ কিছু না দিয়ে ফিতে কাটানো যায় না৷ রাখু আগেই বলে রেখেছিল—
হার্ড ক্যাশ দিস না৷ পাড়ার বউ চক্ষুলজ্জায় নিতে পারবে না৷ তার চেয়ে একটা গিফট প্যাক কর৷ তাতে শাড়ি, অরিজিনাল ম্যাক লিপস্টিক আর পাটের গয়না৷ জমে যাবে রে সমরেশ৷ গড়গড় করে চলবে আমাদের শব্দের ছবি ছাপানো৷
জেরক্সের ভালো নাম বের করেছে রাখু৷ ওর এতো বুদ্ধি আগে ধরা পড়েনি তো! রাখুর গিফট প্যাকের কথা শুনে বোকা বোকা হেসেছিল সমরেশ৷ তবে ঠিকঠাক জিনিসগুলো জোগাড় করে এনেছিল। রাখিবৌদি হ্যান্ড মেড ব্যাগে ভরতে বলেছিল৷ সমরেশ প্যাকেটের ওপর হাত বোলাতে লাগল৷
আমি ব্যাগের ওপর কাল রাতে ফ্লোরাল ড্রইং করে দিয়েছি সমরেশদা৷ দেখ তোর পছন্দ হয় কিনা—
ক’ঝুড়ি খুচরো ফুল নিয়ে ঢুকছে ঈশানী৷
বরের জন্য ফুল এঁকেও গলা এমন কাঠ কেন ঈশানী?
—রাখি আলতো করে প্রশ্ন ছুঁড়ল৷
আসলে মেয়েটাকে অসহ্য লাগছিল রাখির৷ সৌভাগ্যের দিনে কেমন প্যান্ট শার্ট পরে ঘুরছে৷ নেহাত সমরেশের পছন্দ তাই৷ বিজনেসের আদ্দেকের বেশি মূলধন আসছে ঈশানীর জোরে৷ রাখিকে এমনটাই বলেছে সমরেশ৷
এই গাঁদার মালা দুটো আলাদা করে রেখো৷ বিয়ে যবে হবে, হবে! আজ দোকান চালু হলে বিকেলে গানবাজনা করব৷ তোমরা দুটো মালা পরে গাইবে৷ গান গান বাংলায় যে গান গেয়ে থার্ড হয়েছিলে সেটা মনে আছে? সেটা গাইবে— অপছন্দ ঢাকতে অনেক কথা একসঙ্গে বলছিল রাখি৷ নোংরা পোশাক পরলেও আজ ঈশানী উজ্জ্বল৷ অনর্গল হাসছিল৷ সমরেশের চুল মুঠ করে টানল৷
—বৌদি, এই দেখো তোমার দেওরকে কেমন চুলের মুঠি ধরে ঘোরাচ্ছি৷
—তুমিই তো ঘোরাবে ভাই৷
দু’মিনিটে রাখির মুখ কালি৷ সমরেশ দূরে গিয়ে চুপ করতে বলছে৷
এত পেট গুলিয়ে হাসি কেন আসছে ঈশানীর! বেশি হাসার পর অস্বস্তি হয়৷ বাইরে গাড়ির আওয়াজ৷ দরজায় একসঙ্গে রতন পুরুত আর নিভা পাল৷
সমরেশ রাখু সব দৌড়েছে৷
—কাতলা আর চিতল আছে মেনুতে৷ সব গরম গরম হয়েছে৷ খেয়ে যেতে হবে দিদি৷ না শুনতে পারি না দিদি— রাখুদার স্বর গদগদ৷
নিভা পাল না না করছেন৷
শাঁখ ঘন্টা যখন যেরকম বাজার, বেজে চলেছে৷
ঈশিতা জানলা দিয়ে ধীরেনকে দেখল৷ কদিন আগে ওর মাথা থেকে ভুলি আর ভুলির দুটো ডিম নামানো হয়েছিল৷ নামানোর কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য ভুলি মরে গিয়েছিল৷ মাটির জন্যই হয়ত প্রাণটুক ছিল৷ পাখির টান মাটিতে! ওমাগো! আবার হাসি আসছে! তেলওয়ালা মাছ রাখুদা তার জন্য এনেছে!
৪
পূর্ণিমার চাঁদ কখনো নারায়ণ কখনো লক্ষ্মীচাঁদ, বুঝলি ঈশানী! গান করার কথা না তোর!
রাখুদা বাচ্চাদের মতো বায়না করছে ৷ সমরেশ, রাখি, অনিল ডেকরেটারের বউ, পুষ্পর জোড়া বোন সবাই চেঁচাচ্ছে—
গান গান— গাও গান— গান গান বাংলার গান…৷
গাইব গাইব৷ বাট শর্ত শর্ত… শর্ত…! মিটলে শর্ত, গাইব গাইব গাইব! ও মোর প্রেমিক দাদারা গেয়ে গেয়ে কানে তোদের পিচুটি ভরে দেব রে… বলতে বলতে ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিতে শুরু করেছে ঈশানী!
তোর গানের জন্য সব শর্ত রাখব৷
—সমরেশ রাখু একসঙ্গে বলছে৷
—রাখি বাজি?
—কী বাজি?
—তার আগে আমার পঁচিশ ভাগ সমরেশদাকে দিলাম৷
রাখির চোখ বড় বড় হয়ে গেছে—
বাবা বরের ওপর এখনই এতো টান! ক’দিন বাদেই নাহয় পঁচিশ যোগ পঁচিশ হত! আজই ঘোষণা করতে হল!
বাজির পরের টার্ম দিল ঈশানী—
তাহলে রাখুদা আর সমরেশদার সমান সমান হল৷
তা তো হল৷ তাতে তোর কী লাভ হল বল দেখি! মেয়েদের নিজস্ব টাকা রাখতে হয়! চিরকালের হাঁদা একটা মেয়ে…
—অনিল ডেকরেটার, পুষ্পর বোন সবাই রেগে উঠেছে৷ ছোট থেকে তারা ঈশানীকে দেখছে৷
ঈশানী এবার ফাইনাল টার্মে—
একবছর সময়৷ যে দোকান থেকে বেশি টাকা আনবে আমি তার৷
বিয়ে বা না বিয়ে তার ব্যাপার৷ কিন্তু আমি ক্লিয়ারলি তার৷
বেগুনি রঙের তাঁতে হলুদ গাঁদার মালায় অপূর্ব লাগছিল ঈশানীকে৷ বিকেলে ঘরে গিয়ে মায়ের পুরোনো শাড়িটা পরেছে৷
পুরোনো গানের সুরে নতুন নাচের ছন্দ পায়ে৷
উঠোন ঘুরে ঘুরে নাচে!
তার পিছনে সমরেশ রাখু!
ঈশানীর শর্ত তাদের খুব পছন্দ৷
উঠোন ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে তিন বণিক!
অনিল ডেকোরেটার ভয় পাচ্ছে খুব!
পাগল মেয়েটা দুটোকে ছুটিয়ে মারবে নাকি!
পথের শেষে পুকুর!
সেখানে নিয়ে গিয়ে ডুবসাঁতার দেওয়াবে!
রাখু সমরেশ হুঁশ হারিয়েছে!
এইমুহূর্তে তাদের কাজ ঈশানীর মনোরঞ্জন৷
নাচ নাচ ঈশানী …নাচি নাচি আমরা!
রাজেশ্বরী ওপর থেকে ভুলির বন্ধুটাকে দেখল একবার!
ধীরেন কাল থেকে থাকবে না৷
নগরায়নের নতুন আলো জ্বলবে৷