ঋভু চট্টোপাধ্যায়
এই পিন্টে কুথাকে লুকায় অছিস রে, সকাল থেকে যে তুর দেখা পেছি নাই, ফিরিছিস, একবার বেরোই আয় তাড়াতাড়ি এক বস্তা না ঢাললে আমার দুকান চলবেক নাই রে।
কথাগুলো দাসপাড়ায় খুব পরিচিত। শক্তি মোদক প্রায় প্রতিদিন সকালে এসে একবার করে এরকম করেই ধমকে দিয়ে যায়, বলা ভালো তাড়া দিয়ে যায়। এই সেমি-টাউনে শক্তি মোদকের দুটো চালু মিষ্টির দোকান। মিষ্টির সঙ্গে এখন ঠান্ডা রাখলেও সকালে কচুরি আর জিলাপি খাবার যে লাইন পড়ে তাতেই সেদিনের খোরাকি উঠে যায়। তার সঙ্গে সারাদিন মিষ্টি আর চায়ের বিক্রি তো আছেই। সেই ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত উনুনে সসপ্যানটা চাপানোই থাকে। রাতের বেঁচে যাওয়া চা ফ্রিজে রেখে দেওয়ার কথা সবাই জানলেও কেউ এই ব্যাপারে শক্তিকে কোনও প্রশ্ন করে না। একদিকে গনগনে আঁচে দুধ ফোটে অন্যদিকে একটা ছোট উনুনে চাপানো থাকে চায়ের সসপ্যান। এমনিতে কাস্টমারদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও দোকানের কর্মচারীদের ওপর সব সময় হাড়ে চটা থাকে। উনুনটা ফাঁকা থাকলেই চিৎকার করে ওঠে। কর্মচারীদের কেউ কেউ আবার খুব ঠোঁট কাটা, বলে ওঠে, ‘অত চেল্লান কেনে কয়লা তো আর সোজা রাস্তায় কিনেন নাই।’
এই কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ একটু দমে যায় শক্তি মোদক। এসব কথা তো লোকানো থাকে না। তাছাড়া এই অঞ্চলের সব দোকানি এই রকম করেই কয়লা নেয়। সোজা রাস্তার কয়লা কিনে আর দোকান চালাতে হবে না। শুধু কি দোকান, যে সব বাড়িতে গ্যাস আছে তারাও ভাত চাপানোর জন্য ঘুর পথে কয়লা কেনে। এই তো কয়েকদিন আগে পার্টির মিটিং হল, খাওয়া দাওয়ার বিরাট আয়োজন ছিল, সেখানেও সেই দু’নম্বরি কয়লা। কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে।
নিচুপাড়ার লোকগুলানের হাতে কত টাকা! শালারা মদে না ফুটালে আজ উয়াদের পয়সা খায় কে, সবটাই লাভ, শুধু পুলিশকে কুড়ি টাকা ধরায় দাও বাস, তুমি আপনার মজায় কয়লা তুলো।
এই শালা পিন্টেও দিন দিন বদের হাঁড়ি হয়ি যেছে, একটাকাও দাম কম লিবেক নাই। কিছু শুধালেই দাঁত বের করে বলে ওঠে, ‘আপনি তো সবই জানেন, সেই রেতের থিকে ছুটতি হয়, কম দিলে পুশাবেক কেনে। সোজা রাস্তায় কত দাম বলুন দিকি।’
ই’কথাট মন্দ বলে নাই, গেদে দাম এখন, তাও মোদক প্রতিবার দাম দেবার সময় পাঁচ টাকা কম দেবেই। পিন্টু কিছু বললেই মোদক বলে ওঠে, ‘লে লে ইট লে, এক কপ চা খেয়ে পালা।’
এমনি ভাবেই বেশ কয়েক বছর ধরেই শক্তি মোদক পিন্টেদের কাছ থেকে বস্তার পর বস্তা কয়লা কিনে যাচ্ছে। শক্তি মোদক পিন্টের কাছ থেকে কেনে, অন্য দোকানগুলো অন্য কারোর থেকে কেনে, কয়লা সবাই এমনি ভাবেই কিনে নেয়। এমনকি এই অঞ্চলে বড় ছোট কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতেও পিন্টুদের থেকেই কয়লা কেনা হয়। পিন্টেরা সবাই দাসপাড়া বা মুচিপাড়ায় থাকে। দুটো পাড়াই কাছাকাছি, তারপরেই একটা মাঠ আর মাঠের পরেই বেশ কয়েকটা ছোট ছোট গর্ত, বাইরে থেকে শুধু ভিতরের অন্ধকারটাই দেখা যায়। রাতের বেলা পিন্টেরা পিঠে একটা দড়ি বেঁধে নিচে নেমে যায়, হাতে গাঁইতি আর বস্তা থাকে, খুব বেশি নিচে নামতে পারে না, তাও ওখান থেকেই কয়লা কেটে বের করে। বাইরে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকে, দড়ি বাঁধা ঝুড়িতে কয়লা চাপিয়ে দেওয়ার পর দড়ি টেন সেই কয়লা বাইরে আনে, বিক্রি করে। একটু দূরেই আরেকটা কয়লার খাদান আছে, মালিক আছে, সেই সব কয়লা নিয়ে নেয়, পিন্টেদের মত অনেকে সেখানে কাজ করে। কাজ করতে করতে খনির নিচেই পড়ে মারা যায়, মারা যাওয়াটা তাদের বেঁচে থাকার মধ্যেই পড়ে। পিন্টুরাও মারা যায়, অন্ধকার গুহার ভিতরে বিষাক্ত গ্যাসে বা সাপের কামড়ে কখনো বা দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে গিয়ে। মাঝে মাঝে পুলিশ আসে, এই তো কয়েকদিন আগেই পিন্টুদের পাড়া থেকে নন্টে, তপু ফুচকাকে ধরল। ছেলেগুলো গেদে বদ। জোয়ান ছেলে সাইকেলে চাপিয়ে এক এক বারে আশি কিলো থেকে এক কুইন্টাল কয়লা গ্রামের ভিতর দিয়ে ঠিক সামনের শহরের একটা লোহার কারখানাতে পৌঁছে দিচ্ছিল, টাকাও কামাচ্ছিল খুব। এক কেজি কয়লা দশ টাকায় বিচছিল। শালা রোজ দুটো টিপ প্রায় মিলে প্রায় দুহাজার টাকা, কামাও আর খাও।
পিন্টু আগে অন্য কাজই করত। একটা সব্জির আড়তে ভ্যান চালাত। বিয়ে করল, বউটার একটা পা খোঁড়া। একটা ছেলেও হল। পাড়ায় তখন কাঁচা টাকার রমরমা। ছেলে বুড়ো সবাই লুকিয়ে কয়লা তোলারই কাজ করছে। হাতে সবার কাঁচা টাকা আসতে লাগল। পিন্টু তখনও সব্জির আড়তে কাজ করে। তারপরেই পাড়ারই এক কাকা একদিন বলে, ‘তুর আর কিছু হবেক নাই, পাড়ার সবাই কত টাকা কামাচ্ছে আর তুই বউয়ের আঁচলের তলে বসে আছিস।’ ঘরে বউকে কথাগুলো বলতেই বউ অবশ্য বলে, ‘যে যা বলে বলুক গে, কালই একজন চাপা পড়িছে, তুমি যা কাজ করছ তাই করগে।’ পিন্টে বউয়ের কথা শুনে সব্জির আড়তের কাজের সাথে রিক্সাও চালাতে আরম্ভ করে।
দাসপাড়ার সবার একটা ভারি খারাপ রোগ আছে। সারাদিন কাজ করবার পরে সন্ধে থেকে চোলাই খেয়ে পড়ে থাকে। পিন্টেও আলাদা কোন মহাপুরুষ নয়। কখনো কখনো সকালেও মদের নেশা পেয়ে বসে। পিন্টের কাজ চলে যায়, ছোট শহরে রিকশার ঘাড়ে টোটোর নিঃশ্বাস পড়তে আরম্ভ করে, টাকায় টান পড়ে। এদিকে ঘরে প্রাণের সংখ্যা বাড়ে, ছেলেরা বড় হয়, ঘরে খাবারের জোগানে ভাটা পড়ে। একরাতে বউয়ের সাথে মদ খেয়ে তুমুল ঝগড়া হয়, ঝগড়া হাতাহাতিতে পৌঁছে যায়। পরের দিন সকালে বউই কাছে এসে কয়লার খাদানের কথা বলে। পাড়ার ছেলেদের সাথে মেয়েরাও তখন নিয়মিত খাদানে যাচ্ছে, তাদেরও হাতে কাঁচা পয়সা, শুধু পিন্টের বউ তার খোঁড়া পা নিয়ে যেতে পারে না। তারপর থেকেই পিন্টেও এই কয়লার ধান্দায় নেমে যায়। প্রথম প্রথম একটা সাইকেল নিয়ে চুরির কয়লা পাচার করত। কতবার পুলিশের তাড়া খেয়েছে। একবার তো কয়লার বস্তা নিয়ে এক্কেবারে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কোন রকমে বেঁচে গেছে। তারপর এদিক সেদিক করে শেষে এখন নিজেই একটা পুরানো পড়ে থাকা খাদানের ভেতর থেকে কয়লা বের করে নিয়ে আসতে আরম্ভ করে। আগে একটা মহাজনকে দিয়ে দিত, লোকটা খুব বদ, বেশি পয়সা দিত না, কেজিতে দু’টাকা করে দিত। তারপরেই এখন শক্তি মোদকের দোকানে কয়লা দেওয়া শুরু করে, প্রতিদিন চার বস্তা, এরপর এদিক ওদিক আছেই।
আগে পিন্টে মাসে এক দামেই টাকা দিত, এখন অবশ্য প্রতিদিন আলাদা আলাদা দামে দিচ্ছে। সকালে সবাই মিলে দাম ঠিক করে সেই দামে সবাই বিক্রি করে। কিন্তু বিক্রি করলে কি হবে, বিকাল থেকেই সেই চুল্লুর নেশাতে মজে থাকে। শক্তি মোদক নিজের থেকে এই সব কথাগুলো পিন্টেকে অনেক বার করে বলেওছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি, না মদ কমিয়েছে না জুয়া খেলা। প্রতিদিন ভোরে হাঁটতে যাবার সময় একবার করে পিন্টেদের দাসপাড়াতে যায়। পিন্টেরা ভোর রাতে বেরোয় বেশির ভাগ দিন তখন চলে আসে। শক্তি মোদক কথা বলে আর চারদিকে তাকিয়ে দেখে। খুব খারাপ লাগে অত ভোরেই দাসপাড়ার বাচ্চাগুলো পয়সা দিয়ে গুলি খেলে। শক্তি মোদক প্রায় জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে পড়তে বস, এখন কেউ খেলে?’ দশ এগারো বছরের ছেলেগুলো বিড়ি খায়, ওরাও ভোর রাত থেকে কয়লার চোরা খাদানে চলে যায়। ওদের পুলিশ ধরতে পারে না, ধরলেও ছেড়ে দেয়। একটু বয়স হয়ে গেলেই চোরা খাদানে আর কাজে নেয় না, তখন বাইরের খাদান থেকে লুকিয়ে কয়লা চুরি করতে হয়। এর মাঝেই ছোটখাটো দুর্ঘটনা থাকে, পিন্টের অনেকবার হাত বা পায়ে লেগেছে, একবার তো পা ভেঙে বেশ কয়েক সপ্তাহ শুয়ে ছিল। সেই সময় আরেকজন কয়লা দিত। তারপর আবার ঠিক হল। আরম্ভ হল সেই কয়লা খাদান থেকে কয়লা তোলা আর মিষ্টির দোকানে দিয়ে আসা।
কিন্তু এখনও এল না কেন? শক্তি মোদক দাসপাড়া থেকে একবার রোজকারের মত ঘুরেও এসেছে। দোকানে এসেও এক কর্মচারীকে দাসপাড়াতে পিন্টের খবর আনতে পাঠিয়েও লাভ হয়নি। পিন্টের বউ তার খোঁড়া পা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছে, ‘উ তো এখনও আসে নাই, খুব ভয়ে আছি।’
খবরটা শক্তি মোদকের কানে যেতেই ওরও চিন্তা আসে। এত দেরি তো করে না, সকালে দাসপাড়াতে যেতেই ওকে প্রায় প্রতিদিন দেখতে পায়, না হলে একটু পরেই দোকানে এসে হাজির হয়। কিন্তু এবার কী হল? কিছু সময় পরে আবার একজনকে দাস পাড়াতে পাঠায়। সে দোকানে এসে খবর দেয় পিন্টে খাদানের অন্ধকার থেকে আর আলোতে ফিরতে পারে নাই, সঙ্গে যারা গেছিল তারা চেষ্টা করলেও কাজের কাজ কিছু হয় নাই, তিন জন ভিতরে ছিল, যেমন প্রতিদিন থাকে। কয়েকজন বাইরে কয়েকজন ভিতরে নামে, কোমড়ে দড়ি বাঁধা থাকে, দড়ি বেয়ে নিচে নামে, তারপর আস্তে আস্তে দড়ি বেয়ে উঠে আসে। কিন্তু সেদিন আর উঠে আসতে পারে নাই। শুধু ভিতরে একটা শব্দ শুনেছে, চাঁগড় ভাঙার শব্দ।
শক্তি আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি দাসপাড়াতে চলে আসে। পাড়াতে তখনই একটা শোকের পরিবেশ। পিন্টের বউটা একদিকে বসে, বড় ছেলেটা নাকি আবার খাদানের কাছে গেছে, বাকি ছেলে মেয়েগুলো ওখানেই বসে। শক্তির খারাপ লাগে। অনেক বছর ধরে কিছুটা হলেও কম টাকায় পিন্টের থেকে কয়লা কিনছে। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট পিন্টের বউয়ের হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা এখন রাখো, পরে আমি আরো দেখছি।’
মাথায় হাত পড়ে শক্তি মোদকের, আবার নতুন কারোর সঙ্গে কথা বলা, নতুন কাউকে সব কিছু বলা, সে এক বেশ ঝামেলার ব্যাপার।
শক্তি মোদক আরেক জনের সঙ্গে কথাও বলে, নতুন লোকটা বাউরি পাড়ার, নাম রতন, কিন্তু সেরকম ভালো না। কয়লাগুলোও কিরকম পাথর পাথর। উনুন ধরতে খুব দেরি হয়। আঁচেও সেরকম দম নাই, মোদকের মিষ্টির দোকানেও মন নাই। কাস্টমাররা এলে পিন্টের কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে মারা গেল তার কথা বলবার পাশে নিজের কী ক্ষতি হল সেকথাও শোনায়। এমনি ভাবে মাস দুই কাটে।
সকাল বেলা দাসপাড়াতে যাবার অভ্যাসটা শক্তি মোদক আস্তে আস্তে ভুলে যায়। শুনতে পায় পিন্টের সংসার চলছে না। মাঝে মাঝে কারোর হাতে টাকা পাঠালেও সেটা রোজ হয়ে ওঠে না, রোজ পাঠালেও এই ছোট শহরে কথাও ওঠে।
একদিন সকালের দিকে সবেমাত্র শক্তি মোদক ঘুম থেকে উঠে দোকানের সামনেটাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে, এমন সময় পিন্টের বউটাকে দেখতে পায়। খোঁড়া পায়ে দোকানের সামনে এসে মাথা থেকে একটা বড় বস্তা নামিয়ে বলে, ‘আজ থিকে আমিও আরম্ভ করিচি, উয়াদের বাবা তো আপনাকেই দিতেক, তাই না শুধায়ে চলি এলোম, আমার থিকে লিবেন তো? একটো বাঁধা খরিদ্দার না পেলি আনতে লারব, তখন তো পথে বসতি হবেক, ছুটু ছুটু ছিলা কে দেখবে উয়াদের?’
শক্তি মোদক স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে থাকে। দোকানের একটা কর্মচারী সেই মাত্র উনোন ধরিয়েছে। শক্তি বউটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘ইখানে বোসো, চা হচে খেইয়ে যাবে।’
উনোনের ধোঁয়ার পাশ দিয়ে তখন আস্তে আস্তে ভোর হয়, পিন্টের বউয়ের শরীরে ভোরের বাতাস লাগে।