সুকান্ত পাল
গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় অবনী বাবুর একমাত্র ছেলেকে পড়াশোনার জন্য কলকাতার এক অভিজাত কলেজে ভর্তি করেছিলেন। তখন কলেজের হোস্টেলেই থাকত অরিন্দম। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার চার বছর আগেই হঠাৎ করে স্ত্রী মনিকা তিনদিনের জ্বরে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার আগেই অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের লেখ্যাগারে একটি চাকরি পেয়ে অরিন্দম কলকাতাতেই বাড়ি ভাড়া করে স্ত্রী স্বর্ণাকে নিয়ে থাকতে শুরু করেছিল।
অরিন্দম বাড়ি ভাড়া করে থাকার ফলে ওর একটা বাড়তি খরচ হয়ে যাচ্ছে, এই কথা ভেবেই অবনীবাবু নাগের বাজারের বাস স্ট্যান্ডের কাছে একটা থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তার রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের সব টাকা গুছিয়ে নিয়ে। যাতে একসঙ্গে সবাই মিলে থাকতে পারেন। বলা যেতে পারে তিনি তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁর একাকিত্বের যন্ত্রণাকে বিক্রি করে আপনজনের সঙ্গ কিনতে চেয়েছিলেন। মনিকা চলে যাওয়ার পর অবসর পর্যন্ত কীভাবে যে তাঁর দিন কেটেছে তা শুধু তিনিই জানেন। তাই সঞ্চিত সবকিছু দিয়ে তিনি কলকাতার ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিলেন। তাছাড়া অরিন্দম এবং স্বর্ণাও তাগাদা দিচ্ছিল তাঁকে কলকাতায় চলে আসার জন্য। ওদেরও তো মনে অস্বস্তি হতো তাঁর জন্য।
বছর দুয়েক বেশ চলছিল। হঠাৎই অরিন্দমের বদলির পোস্টিং হয়ে গেল দিল্লিতে। খুব চিন্তায় পড়ে গেল অরিন্দম। কিন্তু কিছু করার নেই। তাকে যেতেই হবে। চাকরি বলে কথা। অরিন্দম আর স্বর্ণা তাকে দিল্লিতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি যেতে চাননি। এই কয়েকদিনের মধ্যে পাড়ার বেশ কিছু লোকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আর তাছাড়া কাজের মাসি অনুমতি যখন দুবেলা রান্না করে দেয় তখন খুব একটা অসুবিধা হবে না বলেই তিনি জানালেন। অগত্যা বাবাকে রেখেই অরিন্দমদের চলে যেতে হলো।
২
কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লিতে স্বর্ণা একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সে এখন একটি কন্যা সন্তানের জননীও। কিন্তু এখনো তিনি নাতনিকে কাছে পাননি। মাঝে মাঝে ভিডিও কলে তাকে দেখেছেন ঠিকই কিন্তু তাতে তো আর সম্পর্ক জমাট বেঁধে ওঠে না! সম্পর্কের শিকড়-বাকড়গুলো অজানা পথেই তখন এগোতে থাকে।
এই কারণেই বোধহয় অবনী বাবুর একাকিত্বের বোধ ধীরে ধীরে আবার তীব্র হতে শুরু করল। এর ফলে প্রথমে যতটা সহজ ভেবেছিলেন ততটা সহজ হলো না অবনীবাবুর জীবন। ভীষণ একাকিত্বের মধ্যে যেন দিন দিন ডুবে যেতে লাগলেন। এতো বড়ো ফ্ল্যাটের তিন-তিনটি ঘর যেন তাকে হাঁ করে গিলে ফেলতে চায়। বড়ো অসহায় লাগে তাঁর। আজকাল মনিকার কথা ভীষণভাবে তার মনে পড়ে। ওষুধ তো দূরের কথা, কখনো কখনো দুপুর অথবা রাতের খাবার খেতেও ভুলে যাচ্ছেন। পরের দিন অনুমতি কাজ করতে এসে আবিষ্কার করে যে, অবনীবাবুর রাতের খাবার যেমন ভাবে বেড়ে রেখে গিয়েছিল সে ভাবেই আছে। অনুমতি অবনীবাবুকে মেসোমশাই বলেই সম্বোধন করে। এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে অনুমতি রাগে গজগজ করতে থাকে। তারপর অবনীবাবুর সামনে গিয়ে বলে,
—মেসোমশাই, একটা কথা ছিল।
—বল কি কথা আছে তোর।
—আমি আর কাজ করব না। কাজ ছেড়ে দেব।
এই কথা শুনে অবনীবাবু আকাশ থেকে পড়েন। অনেকক্ষণ হাঁ করে অনুমতির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
—সে কী রে! কেন?
—আমার আর ভালো লাগে না।
—তোর কি শরীর-টরীর খারাপ নাকি! তাহলে ডাক্তার দেখা। দাঁড়া, টাকা দিচ্ছি ভালো করে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্র নিয়ে আয়।
—আমার শরীর যথেষ্ট ভালো আছে। ডাক্তারের দরকার নেই।
—তবে কী হলো বলবি তো! মাইনে বাড়াতে হবে? বাড়িয়ে দেব। কত করে দিতে হবে বল।
—ছিঃ ছিঃ মেসোমশাই আপনি আমাকে এতো ছোট ভাবলেন।
—ছোট কোথায় ভাবলাম! সবারই টাকার প্রয়োজন হয় রে। দেখিস না সরকারি কর্মচারীদের মাঝে মাঝে ডি-এ বাড়ে। তোদের মতো লোকের কথা কে আর ভাবে বল।
—এতো কথা আমি বুঝি না। দাদাবাবু দিল্লি থেকে এসে আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইলে আমি কী বলব।
—কৈফিয়ৎ চাইবে কেন?
—বুঝতে পারছেন না!
—না।
—কালকে রাতে খেয়েছিলেন?
এই প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বললেন,
—না, মানে ইয়ে, ঠিক মনে করতে পারছি না।
—তা পারবেন কেন, যত্তসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা করতে করতে শরীরটার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন যে।
অবনীবাবু কীকরে অনুমতিকে বলবেন যে, গতকাল সন্ধ্যায় একটু ঝিমুনি আসতেই মনিকা যে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল! তারপর সব কেমন যেন গুলিয়ে গেছে। আজকাল প্রায়ই এমন হয়। এর থেকে মুক্তি যে কী উপায়ে পাওয়া যাবে তার কোনো হদিস তিনি করতে পারেন না।
৩
এই অবস্থায় নতুন এলাকায় তাঁর পরিচিতজনেদের মধ্যে দত্তবাবু একটা প্রস্তাব নিয়ে এলেন। সরকারি কর্মচারী এক যুবক, প্রীতম তার স্ত্রী ও বিধবা মাকে নিয়ে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া খুঁজছে। যদি অবনীবাবুর আপত্তি না থাকে তবে তারা অবনীবাবুর অন্য ঘর দুটি ভাড়া নিতে চায়। তারা অবনীবাবুর সব খবর জেনেই প্রস্তাব দিয়েছে যে, যদি তাঁর আপত্তি না থাকে, তবে তিনি যেহেতু একা মানুষ, সেহেতু তিনি তাদের সঙ্গেই একসঙ্গে খেতে পারেন। যাতে তাঁর আত্মসম্মানে কোনো আঘাত না লাগে তার জন্য তিনি খাওয়া বাবদ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে পারেন, অবশ্য ঘরভাড়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রস্তাবটা যেন কেমন অভিনব। তিনি চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। দত্ত বাবু বললেন,
—আপনার আপত্তি থাকলে নিঃসংকোচে বলতে পারেন।
—না, না, তা নয়। তবে…
—তবে কী?
—ভাবছি ওঁদের উপর একটা বাড়তি চাপ পড়ে যাবে…
—সেটা আপনি ভাববেন না। প্রস্তাবটা তো ওঁরাই দিয়েছেন।
কিছুক্ষণ আবার চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আপনি কথা বলুন।
সেদিন একাকিত্বের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এখন নিজের বাড়িতেই যেন তিনি পেয়িং গেস্ট। কথাটা ভাবলেই মাঝে মাঝে তাঁর খুব হাসি পায়। তবুও দুটো পরিবার যেন কোনো এক মন্ত্রবলে এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেল!
পুরো ফ্ল্যাটটাই এখন বেশ গমগম করে। মানুষের কথা সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। মানুষের গন্ধে একটা সাংসারিক গন্ধ জানালার শিক ধরে ঝুলে থাকে। প্রীতমের মা যখন ঘরে সন্ধ্যাবেলায় ধূপধুনো দেন তখন কেন যে অনিবার্যভাবে মনিকার কথা মনে পড়ে যায়, তা অবনীবাবু বুঝতে পারেন না। এভাবেই চলে যাচ্ছিল। বছর খানেক পর হঠাৎই একদিন প্রীতম এসে তার মাকে বলল, মা একটা ভালো খবর আছে, তুমি শুনলে খুব খুশি হবে।
—কী রে? কী এমন খুশির খবর শুনি।
—বালিগঞ্জ স্টেশন লাগোয়া এলাকায় একটা থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাট পেয়েছি। আগেই বুক করেছিলাম। তোমাকে আগে বলিনি সারপ্রাইজ দেব বলে। আগামীকাল রেজিস্ট্রি। সামনের রবিবার আমরা শিফট্ করব ভাবছি। এখন আর আমাদের লোকের বাড়িতে ভাড়া থাকতে হবে না।
সব শুনে তার মা শর্মিলা দেবী একটু থমকালেন। তারপর খুব নিচু স্বরে ধীর গলায় অবনীবাবুর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন,
—ওই লোকটা ভীষণ একা। ওকে একা ফেলে আমি যেতে পারব না। তোরা গিয়ে থাক।