বনপরি

রূপক চট্টরাজ

এক রাজ্যে এক রাজা বাস করত ৷ তার ছিল এক রানি৷ তাদের কোনো সন্তান ছিল না ৷ রাজা ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর৷ কিন্ত্ত রানি-মা ছিল খুবই দয়ালু৷ রাজ্যের প্রজাদের দু:খ-কষ্ট সহ্য করতে পারত না৷
একদিন রানি-মা প্রজাদের দুঃখ দূর করার কথা বলতেই রাজা রানি-মাকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাডি়য়ে দিল ৷ কেউ ভয়ে সেদিন কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি৷ রানি-মা কাঁদতে কাঁদতে রাজপ্রাসাদ থেকে চলে গেল৷
তখন গাঢ় সন্ধ্যা৷ রানি-মা রাজ্যের সীমানা ছাডি়য়ে এক গভীর বনের মধ্যে ঢুকে পডে়ছে৷ অন্ধকারে পথ চলতে ভয় লাগছে৷ কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে জানে না৷ ক্লান্ত পায়ে পথ চলার কষ্টে চোখ জলে ভরে উঠছে৷ হঠাৎ থমকে দাঁডি়য়ে ভাবল— প্রজাদের কাছে ফিরে যাবে৷ কারো বাডি়তে নিশ্চয়ই আশ্রয় মিলবে৷ কিন্ত্ত রানি-মা বনের মধ্যে আর ফেরার রাস্তা খুঁজে পেল না৷ পথ খুঁজে খুঁজে পরিশ্রান্ত শরীরে এক গাছতলায় এসে বসলো৷ প্রজাদের কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পডে়ছে৷ হঠাৎ একটা কীসের শব্দে রানিমার ঘুম ভেঙে গেল৷ চোখ মেলে চমকে উঠে দেখল এক দুধসাদা পরি সামনে দাঁডি়য়ে আছে৷

রানি-মাকে বলল—‘তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ, সব আমাকে বল৷ কোনো ভয় নেই তোমার৷ আমি এই বনে থাকি৷ এ বন আমার৷ এখানে সব পশুপাখি আমাকে বনপরি বলে জানে৷’


রানি-মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে জীবনের ঘটনা সব বলল পরিকে৷ পরির খুব কষ্ট হল শুনে৷ রানি-মাকে বলল— ‘এখন থেকে তোমার আর কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না৷ তুমি এসো আমার সঙ্গে৷ আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷’ পরির কথামতো রানি-মা, পরির সঙ্গে গেল৷ কিছুদূর যাওয়ার পর বনের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড গুহা দেখতে পেল৷ পরি বলল— ‘তুমি এখানে থাক৷’

সে রাতটা রানি-মার কোনোমতে কেটে গেল৷ সকালে উঠেই দেখল গুহার পাশ দিয়ে ঝর্না বয়ে চলেছে৷ চারিধারের গাছগুলো ফুলে ও ফলে ভর্তি৷ রানি-মার খুব ভালো লাগলো জায়গাটা৷ দিনের বেলায় রানি-মা আর পরির দেখা পেল না৷

বেশ কিছুদিন কেটে গেল৷ হঠাৎ-ই একরাত্রে পরি আবার এসে হাজির৷ রানি-মা তো দেখেই খুব খুশি৷ পরি বলল— ‘তুমি এই বনে একা, তাই তোমার জন্যে উপহার নিয়ে এসেছি৷ এ তোমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট দূর করবে বড়ো হয়ে৷’

রানি-মা তো দেখেই অবাক৷ দেখল একটা ফুটফুটে ছেলে পরির কোলে৷ রানি-মার হাতে ছেলেকে দিয়ে পরি চলে গেল৷ ওকে পেয়ে রানি-মার মনের একটা সাধ পূর্ণ হল৷ কোলে পিঠে করে ছেলেকে বড়ো করে তুলল৷ ছেলের সঙ্গীসাথি হল বনের পশুপাখি৷ ওদের সঙ্গেই ছেলে খেলে খেলে দিন কাটাতো৷
দেখতে দেখতে বছর দশেক কেটে গেল৷ ছেলে মাকে বলে একদিন বনের বাইরে বেড়াতে গেল৷ ছেলের ফিরতে দেরি দেখে মায়ের খুব চিন্তা হল৷ কেউ কি ওকে ধরে নিয়ে গেছে? আবার কোন বিপদ ঘনিয়ে আসছে! এমন সময় দেখল ওর ছেলে একটা সাদা বাচ্চা ঘোড়া নিয়ে আসছে৷
রানি-মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করল—‘কোথায় পেলি এ ঘোড়াটাকে?’

ছেলে বলল—‘যখন ফিরছি তখন এক দুধসাদা পরি সামনে এসে দাঁড়াল৷ সঙ্গে এই ঘোড়াটা৷ আমাকে বলল, তোমাকে উপহার দেব বলে নিয়ে এসেছি৷ তুমি নিতে পার৷ তাই তো নিয়ে এলাম ঘোড়াটাকে৷’
ঘোড়ার সঙ্গে খেলতে খেলতে ওর বেশ কিছুদিন কেটে গেল ৷ এখন সে ঠিকমতো ঘোড়ায় চড়তে পারে৷ বনের মধ্যে অবাধে ছুটোছুটি করে বেড়ায়৷

হঠাৎ একদিন ছেলেটি দেখলো, এক তোতাপাখি বুনো পথের ধারে একটা গাছের নিচু ডালে বসে আছে৷ পাখিটাকে ওর ধরতে ইচ্ছে হল৷ ছুটে কাছে যেতেই পাখিটা উডে় গেল পাশের ডালে৷ বারবার ফাঁকি দিয়ে সে পালায়৷ একডাল থেকে অন্যডালে, এক গাছ থেকে অন্য গাছে৷ আর আপনমনে শিস্ দিচ্ছে৷
ব্যর্থ হয়ে ছেলেটি ঘোড়া নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে এল৷ মাকে সব বলল৷ পরদিন ছেলেটি দেখলো গুহার সামনে একটা গাছে পাখিটা বসে বসে গতদিনের মতো একই সুরে শিস্ দিচ্ছে৷ তখন মাকে ডেকে এনে পাখিটাকে
দেখাল৷
মা বলল— ‘ওরে এ পাখি ধরা যায় না৷’

পাখিটা তখন শিস্ দিতে দিতে বলে উঠল— ‘মা ঠিক বলেছে৷ মা ঠিক বলেছে৷ কি মজা, কি মজা৷’
ছেলে ও মা পাখির বুলি শুনে অবাক হয়ে গেল৷ তারপর পাখিটা হুস করে পাখা মেলে হারিয়ে গেল বনের মধ্যে৷ পরদিন একই ঘটনা ঘটল৷ সকালবেলায় পাখিটা এসে আবার শিস্ দিতে লাগল গুহার সামনে একটা গাছের ডালে বসে বসে৷ ছেলেটা বেরিয়ে এল গুহা থেকে৷ ওকে দেখা মাত্রই পাখিটা বলে উঠল— ‘আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি৷ আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি৷’
ছেলেটা পাখির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল৷ মাথা নেডে় বলল— ‘হঁ্যা যাব৷’ বলেই মাকে বলে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল৷

পাখিটাও উডে় উডে় যেতে লাগল ঘোড়াটার আগে আগে ৷ কিছুদূর যাওয়ার পর পাখিটা একটা গাছের ডালে এসে বসল৷ ছেলেটাও ঘোড়া থামিয়ে দাঁড়াল৷ এমন সময় একদল লোক ঢ্যারা পেটাতে পেটাতে ওদের সামনে এগিয়ে এসে বলল— ‘পাশের রাজ্যের রাজামশাই আগামীকাল ভিন্ রাজ্যের রাজপুত্রদের এক ঘোড়দৌডে়র আয়োজন করেছেন৷ এই দৌডে় যে রাজপুত্র জিতবে, তাকে রাজামশাই পুত্র বলে মেনে নেবেন ও অর্ধেক রাজত্ব দেবেন৷’

ছেলেটা এই বার্তা শুনে ফিরে এল মায়ের কাছে৷ মাকে বলল— ‘আমি রাজপুত্র হলে ঘোড়দৌডে় যোগ দিতে পারতাম৷’ মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল— ‘তুমি যেতে পার৷ তুমিও রানির ছেলে৷’
মায়ের কথায় ছেলের উৎসাহ বেডে় গেল৷ পরদিন সকাল সকাল ছেলে রওনা হল ঘোড়া নিয়ে৷ পথে দ্যাখে তোতাপাখিটা ওদের সঙ্গে সঙ্গে উডে় উডে় যাচ্ছে ৷ রাজদরবারে পৌঁছে রাজাকে বলল— ‘আমি এই দৌডে় অংশ নেব৷ আমি রানির ছেলে৷’ রাজা ওর বেশভূষা দেখে রেগে গিয়ে বলল— ‘এখানে রাজপুত্র ছাড়া কাউকে দৌডে় যোগদান করতে দেওয়া হবে না৷ তুমি চলে যেতে পার৷’
ছেলেটির দু’চোখ জলে ভরে উঠল৷ মুখ কাচুমাচু করে রাজদরবার থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার গলা ধরে কাঁদতে লাগল৷

তখন রাজদরবারের এক থামের মাথা থেকে তোতাপাখিটা বলে উঠল— ‘রাজা দুষ্টু, রাজা দুষ্টু৷’ রাজা পাখির কথা শুনে ভীষণ চটে গেল৷ মন্ত্রী ও পেয়াদাদের ডেকে পাখিটাকে ধরার হুকুম দিল৷
পাখিটা ফুড়ুত করে উডে় অন্য থামের মাথায় বসে বলতে লাগল— ‘রাজা দুষ্টু৷ ছেলেটার সঙ্গে ঘোড়দৌডে় কেউ পারবে না তাই রাজা তাডি়য়ে দিচ্ছে৷ রাজা দুষ্টু৷’
রাজা রেগে আগুন৷ কিন্ত্ত পাখিটাকে ধরার সাধ্য কারো নেই৷

পাখিটা আবার বলে উঠল— ‘ও রানির ছেলে৷ ওর সঙ্গে কোনো রাজার ছেলে পারবে না৷ রাজা দুষ্টু৷’
বাধ্য হয়েই রাজা ছেলেটিকে ঘোড়দৌডে় দৌড়ানোর অনুমতি দিল৷ ছেলেটা নিজের ফুটফুটে ঘোড়া নিয়ে মাঠে গেল সকল রাজপুত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে৷ সময়মতো ঘোড়দৌড় শুরু হল৷ ছেলেটা সকলকে হারিয়ে ঘোড়দৌডে় বিজয়ী হল৷

রাজা মুগ্ধ হয়ে গেল ছেলেটির ঘোড়দৌড় দেখে৷
পাখিটা ঠিক সেই সময় আবার বলে উঠল— ‘রাজা হল জব্দ৷ কেমন মজা, রাজা হল জব্দ৷’
ছেলেটি মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে জানালো তার ঘোড়দৌডে় বিজয়ী হবার সংবাদ৷

রানি-মা ভাবল, অর্ধেক রাজ্য পেলে আর গুহার মধ্যে থাকতে হবে না৷ এদিকে সেখানে যেতে মনও চাইছে না৷ বনের মধ্যেই থেকে যাবে ভাবছে৷ ভাবতে ভাবতে রাত হয়ে এল৷ রানি-মার চোখে ঘুম নেই৷
বনপরি ফের এসে হাজির হল৷ রানি-মা তাকে জানালো মনের কথা৷ বনপরি সব শুনে রানি-মাকে বলল— তুমি ছেলের সঙ্গে যাও৷ তার অভিষেকে তোমার উপস্থিত থাকা প্রয়োজন৷ বলেই বনপরি উধাও হয়ে গেল ৷
বনপরির কথামতো পরদিন ছেলের সঙ্গে রানি-মা ছেলের অভিষেক দেখতে গেল৷ মা ও ছেলে দেখল— তোতাপাখিটাও উড়তে উড়তে যাচ্ছে ওদের সঙ্গে৷

রাজদরবারে ছেলেটির অভিষেক হল৷ অর্ধেক রাজত্বও পেল ছেলেটি৷ প্রজারা বিপুল করতালির মধ্যে ছেলেকে সম্বর্ধনা জানাতে লাগল৷ ছেলেটি তখন সকলের সামনে মা-কে ডেকে নিয়ে নিজের আসন ছেডে় দিল৷ রাজা তাকে দেখে চমকে উঠল৷ এমন বীর পুত্রের জননীকে একদিন তাডি়য়ে দিয়েছে রাজপ্রাসাদ থেকে৷ নিজের ভুল বুঝতে পেরে রাজা ক্ষমা চেয়ে নিল৷ রানি-মাকে ফিরে পেয়ে প্রজারা খুবই আনন্দিত৷
তোতাপাখিটা আর একবার সকলের মাঝে বলে উঠল— ‘রাজা বড়ো দুষ্টু৷ রাজা হল জব্দ৷’ তারপর বনের পাখি আবার বনের মধ্যে  ফিরে গেল৷