• facebook
  • twitter
Wednesday, 27 November, 2024

একা একা

অবনী মাস্টার সে কথা শোনেননি। বরং জোর করে নিজের ইচ্ছেটাকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা, সন্তানকে তারা ছেলে বা মেয়ে বড় পার্থক্যের চোখে দেখে।

ছেলেরা থাকলে পুরো বাড়িটা বেশ গমগম করে। ওরা চলে যেতেই একদম ফাঁকা হয়ে যায়। ফাঁকা বলতে একদম ফাঁকা। বাড়ি ঘিরে তখন আর টুঁ-শব্দটি হয় না।

রিটায়ারমেন্টের পর প্রায় সাত বছর হল ছাত্র পড়াচ্ছেন অবনী মাস্টার। বাড়ির কাছাকাছি স্কুলটায় হেডমাস্টার ছিলেন। দাপটের সঙ্গে স্কুল চালিয়েছেন। তার আগে আরও দুটো স্কুল ঘুরে এখানে এসেছিলেন একদিন। আর কোথাও জাননি। চাকরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সফলভাবে দায়িত্বভার সামলে অবসর নিয়েছেন এখান থেকে। পাটভাঙা সাদা ধুতির সঙ্গে পাঞ্জাবি পরতেন। স্কুলে আসতেন পায়ে হেঁটে। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সহ-শিক্ষক, স্কুল কমিটি, অবনী মাস্টারকে সমীহ করতেন সকলেই।
তবু চাকরি জীবনের শেষ দিকে এসে অবনী মাস্টার কেমন চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই দাপুটে চেহারাটা কেমন ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। ভেতর থেকে টের পাচ্ছিলেন স্কুলের সঙ্গে তাঁর এত দিনের সম্পর্কটা ঘুচে যাওয়ার সময় আসছে। এবার মায়ায় বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে। শেষে যেদিন সবাই মঞ্চে তুলে ফুল-মালা পরিয়ে, নানা উপহার, মানপত্র হাতে ধরিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাল, অবনী মাস্টারের ভেতর থেকে চোখ ভরে উঠছিল বিচ্ছেদের জলে।

সেদিনের পর আর স্কুলমুখো হননি অবনী মাস্টার। হয়তো অভিমান করে। হয়তো স্কুলটাকে ভুলে যেতে। কিন্তু এত দিনের সম্পর্ক কি এভাবে ভুলে যাওয়া যায়! অবনী মাস্টার স্কুল ছাড়লেও, ছাত্ররা ওঁকে ছাড়তে চায়নি। একদিন দল বেঁধে এসেছিল সবাই। পড়তে চাওয়ার দাবি নিয়ে। সেই থেকে সকাল-বিকাল বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছেন অবনী মাস্টার।

ছেলেগুলো চলে গেলে ফাঁকা বাড়িটাও একা হয়ে যায়। পুরোপুরি একা হয়ে যান অবনী মাস্টার। এত দিন তবু অলকানন্দা ছিল। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে, সুখে-দুঃখে দু’জনে দু’জনের পাশে থাকতেন। ভরসা পেতেন স্ত্রীর সঙ্গে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করতে গিয়ে। গত বছর হঠাৎই অলকানন্দা চলে যাওয়ার পর এখন আরও একা হয়ে গেছেন তিনি। যে রাতে অলকানন্দার হাতটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, মাস্টার বুকের কাছে টেনে নিয়ে টের পেয়েছিলেন অসাড়। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। হয়তো সময় হয়ে গেলে কারোরই কিছুই করার থাকে না। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বডিটাকে দেখে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে এতটুকু বিচলিত হননি। যতটা বিচলিত হয়েছিলেন সেই মুহূর্তে অবনী মাস্টার। একমাত্র মেয়ে মিলি দুর্গাপুর থেকে এসে পৌঁছেছিল ভোর নাগাদ। আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্মশান থেকে বাড়ি ফিরে এই জীবন সম্পর্কে আরও বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল অবনী মাস্টারের মন। মিলি অবশ্য তার পর থেকে মাঝে মধ্যে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সেও বা কত দিন। ওর তো নিজের ঘর-সংসার আছে। সন্তান আছে। মিলি চলে গেলে অবনী মাস্টার এত বড় বাড়িটায় আবার একা হয়ে পড়েন।

বিশেষ করে সন্ধের পর। সারা দিন তবু ছেলেরা পাশে থাকে। চার দিকে শব্দ, কোলাহল। পড়াতে পড়াতে ওদের সঙ্গে দিব্যি কেটে যায়। তখন অন্য চিন্তা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পায় না। কিন্তু ওরা চলে যাওয়ার পর, যখন হাতে আর কোনও কাজ থাকে না, পুরো বাড়িটা ঘিরে আবার সেই একাকিত্ব। ভেতর থেকে শরীর মন খাঁ-খাঁ করে বেড়ায়। সেই অবলম্বনহীন সময়ে সামান্য আশ্রয়ের খোঁজে মরিয়া হয়ে ওঠেন অবনী মাস্টার। প্রবলভাবে বাড়িময় হাতড়ে বেড়ান।

তার এই প্রবল অস্থিরতার মধ্যেই গুটিগুটি পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েন। আলমারি থেকে পছন্দের বই বের করে আনেন। তার পর পড়ার চেষ্টা করেন। যদিও বইয়ের পাতায় এখন আর বেশি ক্ষণ চোখ রাখতে পারেন না। অক্ষর অল্প সময়েই ঝাপসা হয়ে ওঠে। চোখ ভরে যায় জলে। তবুও প্রতি দিন ঘুমোবার আগে অভ্যাসটা বদলাতে পারেন না। শেষে পড়া বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দেন। চোখ বুঁজে ঘুমোতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। বিছানাময় শরীরটাকে এপাশ-ওপাশ করে বেড়ান। এক বার জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরে চোখ রাখেন। লাইট পোস্টের আলো জানলা ঠেলে তার দিকে ছুটে আসে। এত তীব্র সেই আলো, তবু যেন তাঁকে ছুঁতে পারার মত নয়।

অবনী মাস্টারের মনে আছে গৃহপ্রবেশের দিন, এই জানালার পাশে অলকানন্দাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দু’জনের শরীর ছাপিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল চার পাশে। সে আলো লাইট পোস্টের আলো নয়। সামনের রাস্তায় ওসব তখনও বসেনি। এ দিকটা এত জমজমাটও হয়নি। ঝোপজঙ্গল ঘেরা বাড়িটা আর নারকেল পাতার ফাঁক গলে ঠিকরে বেরিয়ে আসা ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে গিয়েছিল চার দিক। সেই মিষ্টি আলোর সৌরভে গাছের পাতাগুলি দুলে উঠেছিল কয়েক বার। হাওয়ার দোলায় বাতাসে কেমন এক অজানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল কোথা থেকে। আর জানালা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি শরীর মন সেই প্রথম ভিজেছিল। সেই অন্তহীন আলো মেখে, সেই সুবাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে এক হয়ে গিয়েছিল।

সেসব কি খুব বেশি দিনের কথা! একদিন মিলি এলো পুরো বাড়িটাকে আলো করে। আকাশে-বাতাসে হাসি-আনন্দ ছড়িয়ে দিতে। অবনী মাস্টারের ভেতরটাও খুশিতে ভরে উঠেছিল সেদিন। শুধুমাত্র দু’জনের সংসার বেড়ে তিন হওয়ার জন্য নয়। এই ঘর-সংসার, চাকরি, উপার্জন, সব কিছু যার জন্য, সেই নতুন প্রজন্মের, প্রিয় সন্তানের আগমনের খুশিতেই। মিলি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বাড়িটারও কিছু রদবদল হয়েছে। দোতলায় নতুন ঘর বেড়েছে। আলো-বাতাস ঠিকমত খেলার জন্য বারান্দায় বড় কাচের জানালা বসেছে। অলকানন্দা প্রথমটায় অবশ্য আপত্তি করেছিল। এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে এত বড় বাড়িটার আর কি দাম থাকবে! উল্টে মাস্টারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার চেয়ে টাকা-পয়সাগুলি জমিয়ে রাখলে প্রয়োজনের সময় কাজে আসবে।

অবনী মাস্টার সে কথা শোনেননি। বরং জোর করে নিজের ইচ্ছেটাকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা, সন্তানকে তারা ছেলে বা মেয়ে বড় পার্থক্যের চোখে দেখে। তাছাড়া মিলির বিয়ে হলেও, এবাড়িটা তো ওরই থাকবে নাকি! স্বামী-সম্তান নিয়ে তখন বেড়াতে এলেও তো আলাদা ঘরের প্রয়োজন হবে। সহজ অঙ্কের নিয়মেই হিসেব কষেছিলেন অবনী মাস্টার। কিন্তু অলকানন্দা যে চিরদিন তার ছায়া হয়ে থাকবে না, এমন কী তিনিও যে বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে এক দিন এই বাড়িতে আর থাকবেন না, এই হিসেবটা কষেননি।

অবসরের পরে কর্মময় জীবনের ইতি টেনে যে যে পরিবর্তনগুলি আসে, সেই পরিবর্তনগুলি অবনী মাস্টারের ক্ষেত্রে যেন বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। তবু নিজেকে ব্যস্ততার মধ্যে ডুবিয়ে রেখে সেই প্রকটতাকে পরাজিত করতে চান। ভুলে যেতে চান এই পৃথিবীর যাবতীয় শোক-তাপ-মৃত্যু ভাবনাকে। তারপরও মাস্টারের সচল মনে কোনও কোনও মুহূর্তে সেই ভাবনাগুলি এসে আঘাত মারে। আরও একা করে দিতে চায়। এই ঘুমতে যাওয়ার সময়টায়ও যেমন। তখন বিছানা জুড়ে শুধু মাত্র তার বয়স বেড়ে যাওয়া শরীরটা থাকে। চার পাশে আর কেউ থাকে না। এমনকি অলকানন্দার জায়গাটা আরও ফাঁকা, আরও বেশি শূন্যতার সৃষ্টি করে। তখন ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলিকে আরও বেশি করে জাপটে ধরে।

ঘটনাটা প্রথম প্রথম কয়েক বার ঘটেছিল। সেই অলকানন্দা চলে যাওয়া পর পর। মাঝে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিলেন। ইদানিং আবার শুরু হয়েছে। সেই ঘুমতে যাওয়ার মুহূর্তেই। বুক জুড়ে ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা। সঙ্গে হাত-পা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে গিয়ে শীতল হয়ে যাওয়া। গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়া। এমনকি সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে শরীরটাকে কেমন বিছানার সঙ্গে লেপ্টে দেওয়া। ঠিক যেন অলকানন্দার মত। সচল শরীরটা নিস্তেজ হয়ে প্রাণ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। মাস্টারের ঘুম আসে না। অস্থির হয়ে ওঠেন। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসেন। হাত বাড়িয়ে গ্লাস তুলে জল খান। একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে চান। এই দুর্বিষহ অস্থিরতাকে পাশ কাটিয়ে অন্য ভাবনায় প্রবেশ করতে চান। গভীর রাতে কিছু একটা ঘটলে বড় বিপদ। তখন কাউকেই ডেকে পাবেন না। হাসপাতালে তো অনেকটা দূরের পথ, এই মফস্বল পৌর শহরে রাত-বিরেতে একটা ওষুধের দোকান পর্যন্ত খোলা পাবেন না তিনি।

তাই যে ভাবেই হোক রাতটাকে পেরোতে চান। রাত পেরিয়ে ভোর হলে, দিনের আলো ফুটলে, একে একে ঘর-বাড়ির দরজা-জানালা খুলে, রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে মানুষ। সচল হবে বাসের ইঞ্জিন, ট্রেকার, অটো, ভ্যান-রিক্সা, সাইকেলের চাকা। সচল হবে স্টেশন চত্ত্বর, চায়ের দোকান, ওষুধের দোকান, ডাক্তারবাবুদের চেম্বার। তখন মাস্টারের বাড়িটাকে ঘিরে একে একে ভিড় জমাবে প্রিয় ছাত্রছাত্রীর মুখ। কেউ কেউ ধরাধরি করে নিতে চাইবে ডাক্তারখানায়। অনুরাগীদের ফোন আসতে শুরু করবে একের পর এক। স্থানীয় কাউন্সিলর, এমন কি স্বয়ং চেয়ারম্যানও সশরীরে ছুটে আসবেন তাঁকে দেখতে। বাড়িটাকে ঘিরে তখন একটা ভিড় উপচে পড়বে। অজস্র চোখ, অজস্র হাত, মাস্টারের অজস্র গুণমুগ্ধরা সবাই তখন ঘিরে ফেলবে তাঁকে।

মাস্টার উঠে বসবেন। তিনি তো আর একা নন তখন। অজস্র হাতের শক্তি তার শরীরে, অজস্র চোখের স্বচ্ছ দৃষ্টি তার চোখে, অজস্র অনুরাগী-শুভানুধ্যায়ীদের সমর্থন তার বুকে। রাতের দুর্ভাবনাগুলি মাথা থেকে মুছে যাবে। জানালা দিয়ে সকালের নরম রোদ এসে পড়বে তার পায়ের পাতায়। তার পর ছড়িয়ে যাবে সারা শরীরে। মাস্টার কি আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবেন! দ্রুত উঠে পড়বেন। বাজারের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে বারান্দা টপকে, কোলাপসিবল গেট পেরিয়ে বেরিয়ে আসবেন বাইরের জগতে।
বরাবরই বাজার করতে ভালোবাসেন মাস্টার। বিশেষ করে অলকানন্দার পছন্দের জিনিসগুলি কিনতে। নিজের হাতে সে সব বেছে বেছে কিনবেন তিনি। লাউ চিংড়ি খেতে ভালোবাসে অলকানন্দা। বাজার ঘুরে ঘুরে কচি লাউ আর গলদা চিংড়ি নেবেন। সঙ্গে শোল মাছের ঝোল। মাছটা এখনও ভালোই চেনেন মাস্টার। ক্লাসের আর দশটা ছেলের মধ্যে খুঁটে খুঁটে ভালোটাকে বেছে নেওয়ার মত। আর শেষ পাতে কৎবেল। অলকানন্দার বড় পছন্দের জিনিস। মাস্টারেরও। ওর হাতে সে-মাখার স্বাদটাই আলাদা।
অলকানন্দা এত ক্ষণে স্নান সেরে, পুজো দিয়ে, ভাত চাপিয়ে দেবে উনোনে। মাস্টারের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে যাবে সোজা রান্না ঘরের দিকে। গুনগুনিয়ে একটা সুর তুলবে।

ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সাড়ে ন’টায় খেতে বসবেন মাস্টার। থালা ভর্তি গরম ভাতের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে চার দিকে। তার মধ্যে একে একে উঠে আসবে লাউ চিংড়ি, শোল মাছের ঝোল। অলকানন্দার রান্নার হাতটা এত চমৎকার যে আরও দু’বার ভাত নেবেন মাস্টার। শেষে হাত-মুখ ধুয়ে এসে কৎবেল। এত অল্প সময়ে সব কিছু কীভাবে যে গুছিয়ে করে ফেলবে অলকানন্দা! ভেতরে ভেতরে বিস্ময় জাগবে মাস্টারের। তবু ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁলেই পাটভাঙা ধুতির উপর পাঞ্জাবিটা গলিয়ে বেরিয়ে পড়বেন সোজা স্কুলের দিকে। দরজায় দাঁড়িয়ে অলকানন্দা দুগ্গা-দুগ্গা বলে কপাল ঠুকবে কয়েক বার মাস্টারের শেষ ছায়াটুকু সরে না যাওয়া পর্যন্ত।

রাস্তায় বেরিয়ে মাস্টার কেমন ধাঁধিয়ে যাবেন। তাঁর প্রতিদিনের চেনা স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটা আজ কেমন পাল্টে যাবে। স্কুল মাঠ পেরিয়ে উঁচু দোতলা বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াবেন। মাস্টার অপলক বিস্ময়ে দেখতে পাবেন তাঁর নিজের গ্রাম, তাঁর শৈশবকে। প্রথমটায় চমকে উঠবেন। প্রবল টানে ছুটে যাবেন সেদিকে। আতা গাছটা পেরিয়ে সামনে এসে থমকে দাঁড়াবেন। দুরন্ত সেই কিশোরের দল ডাল বেয়ে একে একে ঝাঁপিয়ে পড়বে টলটলে জলে। তার পর সাঁতার কাটতে কাটতে ছড়িয়ে যাবে আনেক দূরে। মাস্টার সেই কিশোর দলে নিজেকে খুঁজে পাবেন। স্পষ্ট দেখবেন ছেলেবেলার বন্ধু হাসান, তমাল, সঞ্জয় আর পালশকে। মাস্টারের বিস্ময়ের সীমা থাকবে না। সেই জলের পাড় ধরে তিনি এগিয়ে যাবেন আরও সামনের দিকে। সেই ছোট্ট মতন বাজার। শাক-সবজি, মশলা-পাতি, হাঁস-মুরগি আর মাছ নিয়ে বসা দোকানদার। ঝুড়ি মাথায় লোকজনের আনাগোনা। কেউ কেউ নৌকায়। আরও এগিয়ে কলাবাগান, সবুজ মাঠ। এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইমারি স্কুলের ঘর। ক্লাস নিচ্ছেন পণ্ডিত-স্যার।

বাচ্চারা মনোযোগ দিয়ে স্লেট-পেনসিলে নামতা লিখছে। একটু পরেই ছুটির ঘণ্টা পেটাবে বুড়ো জগন্নাথ। ছেলেরা তখন বই-খাতা তুলে যে যার মত ছুট লাগাবে বাড়ির দিকে। মাস্টার দাঁড়িয়ে দেখবেন একা। পণ্ডিত-স্যার ফিরে গেলে তাঁর পিছু পিছু বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। অচেনা শব্দে এক বার পিছন ফিরবেন পণ্ডিত-স্যার। মাস্টারের বাড়ানো হাত পায়ের পাতা ছুঁতেই একটু নড়ে উঠবেন তিনি। সেই অচেনা স্পর্শে অবাক হবেন। মাস্টারের অস্পষ্ট মুখটাকে দেখবেন। কিছুক্ষণ থমকে থেকে বিস্ময় গলা জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করবেন, অবনী না? মাস্টারের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়বে। গলা ধরে আসবে। তার সমস্ত কথা থমকে যাবে। শুধু শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় পণ্ডিত-স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন তিনি। পণ্ডিত-স্যার হাত তুলে মাস্টারের গায়ে হাত বুলিয়ে দেবেন। তার পর প্রিয় ছাত্রের মাথায় হাত রাখবেন একবার।

মাস্টারের মনে হবে, এই ক’দিনে কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছেন তিনি। তার সেই দেশ, তার সেই গ্রাম, যেখানে কেউ একা নয়, সবাই একে অন্যের পরিপূরক, সেই দেশ ফেলে কিনা তিনি চলে এলেন এই মফস্বল শহরের এক নির্জন ঠিকানায়? এই জনশূন্য বাড়িটায়? যে দেশের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি সংসার প্রতিনিয়ত টুকরো হতে হতে, ভাঙতে ভাঙতে, ছোট হতে হতে, এখন প্রতিটি মানুষই বড় ক্ষুদ্র, বড় ছোট, বড় অসহায় এবং সর্বোপরি বড় একা। পণ্ডিত-স্যার তো কখনও এমন দেশ গঠনের শিক্ষা দেননি, এমন সমাজ গঠনের কথাও বলেননি। মাস্টারও কি চেয়েছিলেন এমন ঘর, এমন সংসার নিয়ে এমন দেশে বেঁচে থাকতে?
মিলি খবর পাঠিয়েছে গতকাল। মাস্টারকে দুর্গাপুরে নিজের কাছে ক’দিন রাখতে চায়। নাতিটাও বড্ড একা থাকে সেখানে। বুড়ো দাদুটাকে পেলে তবু খেলার সঙ্গী পাবে একজন।

বুকের ভেতরে একটা চাপা ব্যথা টের পান মাস্টার। ব্যথাটা কি বাড়ছে এখন?