অনুরাগ

কল্পিত চিত্র

অণিমা এষ

আলমারির পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। সুন্দর করে সাজানো তাকগুলোয় একের পর এক শুয়ে আছে ওর প্রিয় শাড়িগুলো । অনামিকা বাঁদিক থেকে দেখতে শুরু করল। একদম ওপরে রয়েছে একটা হলুদ মেরুণ কাতান। কী অদ্ভূত ট্র্যাডিশনাল লুক এটার! অনামিকা তন্ময় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হলে কী হয়। এটা তো কদিন আগে ফুলপিসির ছেলের বিয়েতে পড়েছিল। আর একগাদা ফটো তুলে পোস্টও করে ফেলেছে। এটা বাদ। ওর ঠিক নীচে রয়েছে রয়াল ব্লু গাদোয়ালটা। আহ! ছটা বেড়োচ্ছে এখনো। তবে এখন এটা প্রায় আউট অফ ফ্যাশন। তারপর দুধে আলতা পচমপল্লী, রামা গ্রিন আর ব্ল্যাকের কম্বিনেশনের মাদুরাই, বাংলাদেশি ঢাকাই আরো কত কী। এদিকে ডানপাশে শুধু পিওর সিল্ক। লাল কালো বিষ্ণুপুরীটা একবার ট্রাই করবে নাকি? এটা ব্রাইট অথচ সোবার। পরক্ষণেই না-না থাক, এটা ঠিক রাতে পরার জন্য নয়। নাকটা কোঁচকায় ও। বরং ম্যাজেন্টা তসরটাই পরা যাক। শাড়িটা টেনে বের করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে অনামিকা। সত্যি দারুণ লাগছে। কিন্তু… কিন্তু এর সঙ্গে তো ম্যাচিং গয়নাই নেই। তাহলে? তখনই ছেলের চিৎকার ভেসে এল ওঘর থেকে— ‘খেতে দাও। আর কতক্ষণ লাগবে তোমার?’
—‘আসছি বাবা। এই তো হয়ে এল’ —বলতে বলতে হাত রাখে মাঝের তাকে। এই তাকে সযত্নে রাখা, অনামিকার ডিজাইনার শাড়িগুলো। কোনোটা প্রগলভ ট্রান্সপারেন্ট। কোনোটা ফিনফিনে রোমান্টিক। কোনোটা আবার পোষা বেড়ালের মতো লেপ্টে থেকে শরীরের উত্তল অবতল প্রকট করে। এই শাড়িগুলো আসলে বিশেষ বিশেষ পার্টির জন্য। তাহলে কি নীল ঘিচা? সিলভার ব্লাউজ দিয়ে ফাটাফাটি লাগবে। ম্যাচিং গয়নাও আছে। সুদীপার চোখ তো পুরো ট্যারা হয়ে যাবে। নীচের তলার তাক থেকে টেনে তাকে বের করে নিয়ে আসে অনামিকা। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল রঙটা একটু ডাল লাগছে না? হ্যাঁ তো। একটু এজেড মনে হবে পড়লে। কী ভুলটাই না হয়ে যাচ্ছিল? আবার আলমারির তাক হাতড়ায় ও । নাহ কোনোটাই মনমতো হচ্ছে না। কোনোটার জেল্লা নেই তো কোনোটা বেশি পরে ফেলেছে। কোনোটার রঙ আবার বেশি ক্যাটক্যাট করছে। একটা শাড়িও ঠিক যুতসই হচ্ছে না। ছেলে এবার হুঙ্কার দিতে শুরু করেছে— ‘তুমি খেতে দেবে? নাকি বিগাটো থেকে অর্ডার করবো?’
সারা দুপুর অনামিকা ছটফট করেছে। কোনোরকমে রান্না সেরেই মোবাইল নিয়ে উপুড় হয়েছে বিছানায়। ছেলে গেছে টিউশান। শাশুড়ি ঘুমোচ্ছে অন্য ঘরে। একটা কল করবে নাকি সুমনাকে? নাকি বাড়িই চলে যাবে ওর? একটু দূর অবশ্য। দুটো অটো পাল্টাতে হয়। অনেকদিন ধরে অনামিকা শাড়ি নেয় ওর থেকে। সেদিন বলছিল কয়েকটা অর্গানিক লিনেন আর মসলিন এসেছে। মসলিন গুলো নাকি এক্সক্লুসিভ। একবার দেখলে হয় কিন্তু। ভাবে অনামিকা। সুমনা যদিও হাজার কয়েক পায় ওর থেকে। তবু আর একটা নেওয়াই যায়। সামনের মাসে একটু বেশি দিতে হবে এই যা। পরিমলের কাছ থেকে এটা সেটা বলে না হয় একটু বেশি বের করে নেবে। তাছাড়া পকেট হাতড়েও মন্দ হয় না। বেখেয়াল বলে পরিমল খুব একটা বুঝতেও পারে না। একটাই শুধু সমস্যা সেটা হল ব্লাউজ। কালকের মধ্যে কে বানিয়ে দেবে? মলিকে একটা ফোন করবে নাকি? মলি অনামিকার ছোটোবেলার বান্ধবী। ও এইসব ব্যাপারে দারুণ চৌখস। চেনাশোনাও অনেক। ফোনটা করেই ফেলে অনামিকা। রিং হচ্ছে ওপাশে— ‘মলি আছে বিধান দা?’— ফোন ধরেছে ওর বর।
—‘ও মলি নেই? ভালো আছি দাদা। আপনি তো আসেনই না একদম।’
—‘না না সেরকম কোনো দরকার নেই… আসলে একটা অ্যাড্রেস জানার দরকার ছিল। ঠিক আছে রাখছি কেমন।’
মলি ছেলেকে নিয়ে সাঁতারের ক্লাসে গেছে। মোবাইলটাও আজ ভুল করে রেখে গেছে বাড়িতে। ধুস। ভাল লাগছে না। হঠাৎ মাথায় এল কথাটা। দিদির ব্লাউজের কালেকশনটাও তো দারুণ। দিদির আর অনামিকার সাইজও এক। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোনটা করেই ফেলে দিদিকে— ‘অ্যাই দিদি তোর কাছ থেকে একটা ব্লাউজ নেব বুঝলি।’
—‘কী রং? আরে সেটা এখনো জানিনা…
—‘মানে আবার কী? শাড়িটা তো এখনো কিনিনি…’
—‘উফ তোর এত কালেকশন… একটা না একটা মিলবেই। আমার মোটেও মাথা খারাপ হয়নি। রাতে যাব তোর বাড়ি। এখন রাখি বুঝলি।’
ফোন রাখতে রাখতেই ভাবে সুমনাকে ধরতে হলে এটাই ঠিক টাইম। কিন্তু হুটোপাটিতে শাড়ি পরার সময় নেই আর। কোনোরকমে একখানা কুর্তি গলিয়ে দৌড় দিল অনামিকা। যাবার সময় চিৎকার করে বলে উঠল— ‘মা একটু দরজাটা লাগিয়ে দিন। আমি বেরোচ্ছি।’
সত্যিই শাড়িটা দারুণ। যেমনটা বলেছিল সুমনা তার থেকেও বেশি। ইউনিক একেবারে। হলুদ গা রানী পাড়। সুদীপা তাকে দেখে সত্যিই জ্বলবে আর লুচির মতো ফুলবে। মনে মনে সুদীপার ভেট্‌কে যাওয়া মুখটা কল্পনা করে নিজেই হেসে উঠল ও। সুদীপা আর অনামিকার ছেলে বহুদিনের বন্ধু। তা থেকে দুই মায়েরও বন্ধুত্ব। প্রায় সব ওকেশনেই দুই পরিবার একসঙ্গে। তাছাড়া বেড়াতে যাওয়া, পিকনিক করা এগুলো তো থাকেই। তবু দুই মায়ের মধ্যে টেক্কা দেওয়াটাও চলে নিয়মিত। তবে খুব সূক্ষ্মভাবে। ছেলেরা বা ছেলেদের বাবারা অবশ্য মাথাই ঘামায় না এসব নিয়ে। কাল যেখানে ইনভিটিশান আছে সেখানে সুদীপারাও যাবে। আসলে ওদেরই এক কমন ফ্রেন্ড মালবিকার ম্যারেজ অ্যানিভারসারি। গঙ্গার ধারে কোনও এক বাগান বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। দারুণ নাকি আয়োজন। সবই অবশ্য শোনা কথা। এখন দেখা যাক শেষ পযর্ন্ত কী হয়। খুব খুশি খুশি লাগছে আজ অনামিকার। সুমনার বাড়ি থেকে ফেরার সময় কেজি খানেক চিকেন কিনে এনেছিল। সঙ্গে ধনেপাতা। মাংসটা আগেই ম্যারিনেট করে রেখেছিল। এখন হোয়াইট অয়েলে পেঁয়াজ কুচো নাড়াচাড়া করে ঢেলে দিচ্ছে ধনেপাতা মাখা মাংস। এই রেসিপিটা ছেলে, ছেলের বাবা দুজনেই ভালো খায়। শাশুড়িও ভালোবাসে। শুধু খান দশেক রুটি করে নিলেই রাতের খাবার রেডি। তারপর পরিমল এলেই দিদির বাড়ি ঢুঁ মারতে হবে।
অনামিকা নিজেই নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আয়নায়। সত্যি এখনো তাকে দেখলে ত্রিশ বত্রিশের বেশি লাগে না। পাকা গমের মতো রঙ তার। আলোও যেন পিছলে যায়। মাঝে মাঝে পরিমল যা পাগলামো করে সামলানো যায় না তখন। কে বলবে এত বড় ছেলের বাবা। তখন ছদ্মরাগে অনামিকা বলে —‘কী যে করো তুমি!’
—‘তুমি এখনো যা সুন্দরী! পাগলামো না করে পারি বলো?’ –বলে পরিমল।
শাড়িটা তাকেই মানিয়েছে। এমনকি দিদির ব্লাউজটাও অদ্ভুতভাবে ফিটিংস হয়ে গেছে। দিদির বাড়ি থেকে ফেরার পথে মিনতির বাড়ি গেছিল কাল। শাড়ির ফলস পিকো করতে দেবার জন্য। ওর বাড়ির গলিতে ঢুকেই মনে হল দিদির মতোই একখানা রানী রঙের ব্রোকেডের ব্লাউজ কিনে নেবে। এতে লুকটাও অন্যরকম হবে।
—‘কিগো হল তোমার?’ পরিমল হাঁক পাড়ছে। গাড়ি বের করে ফেলেছে বোধ হয়। আজ সুদীপারা ডাইরেক্ট চলে যাবে। গঙ্গার ওদিকটায় ওর বাপের বাড়ি। মায়ের সঙ্গে দেখা করবে বোধ হয়। একদিকে ভালোই হয়েছে। একটু চমকে দেওয়া যাবে সুদীপাকে। ও কী শাড়ি পরবে কে জানে! সেদিন তো বলছিল বোমকাই। ধুস! ওর বোমকাইটা একদম সেকেলে। তার ওপর কী ভারি! এই গরমে শাড়ি সামলাতে গিয়ে না হিমশিম খায়। ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে আবার।—‘মা তোমার পারফিউমটা দাও না একটু… আমারটা শেষ।’
নিজে গন্ধ মেখে, ছেলেকে মাখিয়ে তারপর যখন বেরোলো ততক্ষণে একটু দেরিই হয়ে গেল।
আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে বাড়িটা। বিশাল খোলা জায়গা বাড়ির সামনে। সুন্দর করে সাজানো বাগান। আর ঠিক মধ্যেখানে একটা রঙিন ফোয়ারা। অপূর্ব লাগছে। অনেকদিন এরকম অনুষ্ঠান বাড়িতে আসা হয়নি অনামিকার। হাতে গিফটের প্যাকেট নিয়ে সে ধীর পায়ে হাঁটছে ভিতরে যাবার জন্য।
—‘আরে এত দেরি করলে কেন? পরিমলদা কই? আমার কর্তাটিতো একা একা বোর হচ্ছে তখন থেকে…’ সুদীপা এসে হাত ধরছে ওর।
অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তো সুদীপা! একদম অন্যরকম। অনামিকা নিজেই চোখ ফেরাতে পারছে না ওর থেকে। তার ওপর গজদন্তের হাসিটা… উফ্আ রো মোহময়ী হয়ে উঠেছে। এক-গা গয়নায় ঝলমল করছে ও। এত সুন্দর করে খোঁপা বাঁধতে শিখল কবে সুদীপা? আর শাড়িটা! সেটার দিকে তাকিয়ে তো অনামিকার মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হল। সেই পুরোনো বোমকাইটাই বটে! কিন্তু এত অসামান্য লাগছে যে অনামিকার কথা সরছে না। কোনোরকমে আমতা আমতা করে বলল— ‘ওই তো… ওদিকে গেছে সব। তোমরা কখন এলে?’
—‘এই আধ ঘন্টা হল। তুমি খুব মিস করলে। যা সব ফোটোসেশন হল! কী বলবো। মনে হল বিয়েটাই হচ্ছে বুঝি আবার একটু থেমে সুদীপা আরো যোগ করে— ‘মালবিকারা মনে হয় মলদিভস যাবে, জানো। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমার কর্তাকে বলে বলেও আর পারছি না।’
—‘হাবিজাবি কত কথা বলে যাচ্ছে সুদীপা। কিন্তু এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না অনামিকার। কীরকম যেন শূন্য লাগছে সবকিছু। পারফিউমের গন্ধটায় কেন যে গা গোলাচ্ছে! শাড়িটাও কী ভীষণ পাকে পাকে ধরে রেখেছে তাকে। মসলিনের রংটা বড্ড ক্যাটক্যাটে লাগছে এখন। তাছাড়া ফুলে ফুলে আছে বলে আলুথালু হয়ে যাচ্ছে ও। রানী ব্লাউজটাও সেভাবে ফুটছে কই? দূর! শাড়িটা বরং দিদির মেয়ে টুসকিকেই দিয়ে দেবে। আর এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না এখানে। তাড়াতাড়ি খেয়ে বাড়ি যেতে পারলে হয়। খেতে বসে ফিস ফ্রাইয়ে কামড় দিয়েই রেখে দিল। কুলচাটাও কেমন ছিবড়ে লাগছে। একপিস মাটন আর একহাতা প্রণ ফ্রায়েড রাইস খেয়েই উঠে পড়ল অনামিকা। একহাতে আইসক্রিম আর অন্য হাতে ছেলের হাত ধরে এসে বসল গাড়িতে। পরিমল তখনও গল্প করছে সুদীপার বরের সঙ্গে।
গাড়ি চলছে শ্লথ গতিতে। যদিও রাস্তা ফাঁকা এখন। ফুরফুরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। –‘খাওয়াটা জম্পেশ হল, কী বলো?’ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে পরিমল।
—‘হুঁ’ বলে চুপ করে যায় অনামিকা।
—‘কী হয়েছে বলতো তোমার’ —পরিমল জিজ্ঞেস করে। অনামিকা এখনো চুপ। কিছু ভালো লাগছে না ওর। যতবার ও সুদীপার দিকে তাকিয়েছে ততবারই নিজেকে ফেল করা স্টুডেন্ট মনে হচ্ছিল। আর সুদীপা একরাশ গয়না আর ওইরকম একখানা আশ্চর্য শাড়ি পরে প্রজাপতির মতো উড়ে চলেছিল। সবার নজর ছিল ওর দিকে। এমনকি পরিমলও হাঁ করে তাকিয়ে ছিল সেইদিকেই। অনামিকা দেখেছে সবটা। তখন থেকে মনটা শ্রাবণের আকাশের মতো গুড়গুড় করছে।
বাড়ি ফিরে পোশাক পাল্টে সবার আগেই আজ শুয়ে পড়ল অনামিকা। অন্যদিন সব গুছিয়ে বাগিয়ে দরজা টরজা লক করে তবে এসে শোয়। আজ কিছুই করতে ইচ্ছে হল না ওর। শাশুড়ি খেয়েছে কিনা সেটা জানতেও চায়নি আজ। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ও। পরিমল কাছে টানতেই কী যে হয়ে গেল অনামিকার! পরিমলের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল ও— ‘তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না’। —পরিমল তো অবাক। মাথাটাও শেষে গেল নাকি! সত্যি মেয়েদের বোঝা দায়। আকাশে একফালি কুমড়ো-চাঁদ কখন থেকে যেন আড়ি পেতে আছে বিছানায়। পরিমল দু-হাতে বুকের মধ্যে টেনে নেয় অনামিকাকে। তারপর আলতো করে চুমু খায় কপালে। চোখ মুছিয়ে গালে গাল রাখে। পরিমলের বুকের ওমের মধ্যে অনামিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকে– ‘আমাকে এবার একটা বোমকাই দিও প্লিজ।’