অচিন পাখি

পূর্বা দাস

এই জন্যেই, ঠিক এইজন্যেই আমি অল্প পরিচিত কারো সঙ্গে কোথাও যাই না৷ বেড়ানোর জন্য না, কাজের জন্য তো একেবারেই না৷ কিন্ত্ত এই মেয়েটা একেবারে ‘নেই আঁকড়া’৷ এমন ঝুলোঝুলি করল, সঙ্গে না নিয়ে উপায় নেই৷ এদিকে বিকেল না হতেই ফেরার তাড়া৷ এরা আবার মিডিয়ায় কাজ করে ভবিষ্যৎ বানাবে! একটু গরম সহ্য করবে না, যেখানে সেখানে জল খাবে না, হিশু পটি পেলেও চেপে থাকবে৷ ঝকঝকে টয়লেট চাই৷ তা যা পারিস কর, তার ওপর আবার ঘ্যানঘ্যান৷ মাথা ধরিয়ে দিল মাইরি৷ ওর তাড়ায় শুকদেব ভাস্করের বাডি়তে চা-টুকু খাওয়াও হল না৷ এই লাইনে ট্রেন একটু কম৷ লাইনে কিছু কনস্ট্রাকশন চলছে বলে রেগুলার ট্রেনও একটু দেরিতে চলছে৷ তাতে কি! হাওড়া একবার পৌঁছতে পারলে তো কেল্লা ফতে৷ বারোটা রাত্তির হলেও ক্ষতি নেই৷ অফিসের গাড়ি থাকবে৷
এখানে এসেছিলাম একটা মেলা কভার করতে৷ UNESCO থেকে গ্রামীণ আর্টিজানদের সাহায্য করার জন্য মেলা করে প্রতিবছর৷ জায়গাটা বেশ রিমোট৷ কাছাকাছি শহর বলতে দাঁইহাট৷ রেল রাস্তা থেকে বেশ দূর৷ এরা খড়, মাটি, কাঠের গুঁড়ো দিয়ে একটা পাল্প মত বানায়৷ তার থেকে নানারকম জিনিস তৈরি করে৷ ছোটখাটো মেয়েদের গয়না থেকে ওয়াল ডেকরেশন পর্যন্ত৷ আশেপাশের গরিবগুর্বো মানুষ শিল্প বোঝে না, তারা সাহেব মেম দেখতে ভিড় জমায়৷ ছবি তোলে ওদের সঙ্গে মোবাইল ক্যামেরায়৷
মেলা চলবে রাত ন’টা পর্যন্ত৷ রিঙ্কুর তাড়ায় ফিরতে হল অনেক আগে৷ UNESCO-র লোকেরা মাঠেই টেন্ট খাটিয়ে থাকবে৷ রিঙ্কু না এলে আমি হয়ত থেকেই যেতাম ওদের সঙ্গে৷ মীর্জা নামের ইজরায়েলি মেয়েটা দারুণ হিন্দি বলে৷ বহুদিন কাজ করছে ভারতে৷

শুকদেবদের বাডি় থেকে টোটো ভাড়া করে দিল৷ স্টেশন প্রায় পাঁচ কিলোমিটার৷ পড়ন্ত গ্রীষ্মের বিকেলে এসব গ্রামগঞ্জের রূপ না দেখলে বোঝা যায় না৷ দু’পাশে শস্যক্ষেতের একদিকে গঙ্গা থেকে টেনে আনা জলধারা এতই সরু যে একে খাল বলা চলে না৷ কিন্ত্ত জল আছে৷ তাই আদিগন্ত ক্ষেতের মধ্যে প্রচুর পাখি৷ সন্ধের আগে ওদের ব্যস্ততা পুরোদমে৷ তিন চার ফুটের মধ্যে বিরাট বিরাট শামুকখোল উড়ছে, বসছে, জল থেকে কীসব বেছে বেছে খাচ্ছে৷ আমার ফিরতে ইচ্ছে করছে না একদম৷ এসব সময়ে আমাদের টালিগঞ্জের বাডি়টা কেমন অন্য দুনিয়ার হয়ে যায়৷ সঞ্জয়দের বাডি়র বিষাক্ত স্মৃতি, ডিভোর্স, তিন বছরের অটিস্টিক মেয়েকে নিয়ে বাবার কাছে ফেরা, চাকরির হাজারটা ডামাডোল— সব ফিকে হয়ে আসে৷ আমার এই ঘোরাঘুরির চাকরি নিয়ে মা’র মুখে আজকাল যেমন কথা শুনতে হয়, সেগুলো আমাকে আবার সঞ্জয়দের কথা মনে পড়ায়৷ দূরে তাল সুপারির সারির মধ্যে আধ ডোবা সূর্য, সবুজ ক্ষেত আর পাখিগুলোর কর্কশ ডাক আমায় নতুন এক মায়ের কোল পেতে দেয়৷


কতক্ষণ এভাবে চলেছি খেয়াল নেই৷ মেঠো রাস্তা ফুরিয়ে এলেও আমি যেন ওই দৃশ্যগুলোর মধ্যেই থেকে গিয়েছিলাম৷ কথা বলছি না দেখে রিঙ্কু ভাবল রাগ করেছি৷ নিজেও তাই চুপচাপ৷ চারপাশে কিছু বাডি়, দোকানপাট— বোধহয় স্টেশন আর বেশি দূরে নয়৷ ঘ্যাচাং করে ব্রেক মারলো দেব৷ অন্যমনস্ক ছিলাম বলে একটু চমকে উঠেছি৷ তাঁতের শাডি় পরা এক মহিলা এই সমাপতনের কারণ৷ হাতে দুটো বড় বড় কাপডে়র ব্যাগ৷ দুটোতেই লেখা আছে ‘তারা মা বস্ত্রালয়’৷ গলায় একটা সিল্কের কাপডে়র বটুয়া ঝোলানো৷ ঠিক মোবাইল রাখার মত যেমন থাকে তেমনি নয়, আরেকটু বড়৷ মহিলা বোধহয় স্টেশনে যাবেন৷ দেব ইতস্তত করছে৷ একশ টাকা কবুল করে ও আমাদের ট্রেনটা ধরিয়ে দেবে বলেছে৷ অন্য ভাড়া নেবে না এরকমই কথা৷ ওর সংকোচের কারণটা বুঝে আমি মুখ বাডি়য়ে বললাম,
—উঠে আসুন৷ জায়গা আছে তো৷ আমরাও স্টেশনে যাব৷
ব্যাগ শাডি় গুছিয়ে বসতে না বসতেই স্টেশন এসে গেল৷ আমাদের রিটার্ন টিকিট কাটা আছে৷ দেব দেখি মহিলার সঙ্গে কাউন্টারের দিকে গেল৷ রিঙ্কু পডি়মডি় করে দৌডে়ছে৷ দেব হাসছে৷
—এখনো কাটোয়া ছাডে়নি, দিদি৷ আস্তে ধীরে যান৷ দশ মিনিটের আগে ট্রেন আসবে না৷ গোপালের মা ও তো এই ট্রেনেই যাবে৷
‘গোপালের মা’ তবে মহিলার নাম৷ এদিকে এখনো এভাবে ডাকাডাকি চালু আছে৷ ইস! আমাকে যদি কেউ ‘তিয়ার মা’ বলে! ভাবতেই হাসি পেল৷ আমি আর রিঙ্কু চোখে চোখে তাকিয়ে হাসলাম৷ গোপালের মা! আহা রে!

স্টেশনে মেলা ফেরত মানুষজন কম না৷ তার মানে ট্রেনে ভিড় হবে৷ আসার সময় ভিড়টা টের পেয়েছি৷ হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ার সময় দিব্যি ফাঁকা ছিল৷ কিন্ত্ত দু’-চারটে স্টেশনের পর থেকেই পিল পিল করে মানুষ উঠতে শুরু করল৷ দরজা জানলা আটকে মানুষ দাঁডি়য়ে৷ সকাল দশটায় মনে হচ্ছিল চৌরাশিটা নরকের কুণ্ডের মধ্যে বসে আছি অভাগা পাতকি৷

উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্ম কিন্ত্ত একদম ফাঁকা৷ তার মানে ওদিকে যাবার কোনো ট্রেন নেই এখন৷ খাঁ খাঁ প্লাটফর্মটার শেষে বিদায়ী সূর্যের আলো ঘাসজমির উপরে ছাপ রেখে গেছে৷ ‘মহিলা কামরা’ লেখা জায়গাটাতে এসে দাঁড়ালাম৷ একটু পরেই গোপালের মা এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে৷ মুখে একটা অপ্রতিভ হাসি৷ শাডি় আর হাতে কানে গলায় অল্প সোনার সাজের সঙ্গে এই হাসিটার কোনও মিল নেই৷ বরং ওপাশের নির্জন প্লাটফর্মটার সঙ্গে কোথাও যেন একটা আত্মীয়তা আছে ওই হাসির৷
মহিলা জানালেন, এই ভিড় মাত্র দু-একটা স্টেশন পর্যন্ত থাকবে৷ নবদ্বীপের আগেই খালি হয়ে যাবে৷ তারপর নিত্যযাত্রী দু-একজন৷ একথায় কি বা আসে যায় আমাদের৷ ফিরতে হবে, আর এতটা রাস্তার মধ্যে কোমরটা ঠিকই কোথাও একটু নামিয়ে রাখতে পারব৷

ট্রেনে উঠে বুঝলাম, ওর কথাই সত্যি৷ প্ল্যাটফর্মে যে ক’জনকে দেখেছিলাম তার থেকে হয়ত দু-একজন বেশি মানুষ রয়েছে গোটা কম্পার্টমেন্টে৷ রিঙ্কু একগাল হাসল আমার দিকে চেয়ে৷
—তুমি জানলায় বসো, তিস্তাদি৷

যেন না বললে বসতাম না৷ সব জানলাই তো ফাঁকা৷ ও নিজে বসবে না৷ হাওয়ায় চুল রুক্ষ হয়ে যাবে না! ওরে তোর রাস্তা আমি অনেক আগে পেরিয়ে এসেছি রে৷ মনে মনে একটা খিস্তি করে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলাম৷ মাকে ফোন করতে হবে৷ তিয়া সন্ধ্যার টিউশনটা যেন মিস না করে৷ প্রচণ্ড হাওয়ায় অবশ্য কথাগুলো শোনা গেল না তেমন৷ তবে মা নিশ্চিন্ত সেটা গলার স্বরে বুঝলাম৷ আমি ফিরছি এবং ইতিমধ্যেই ট্রেনে উঠেছি, এই খবরে মা’র চেয়ে বেশি খুশি আর কে হবে? না, তিয়া ঝামেলা করেনি আজ৷ ইমনদের ফ্ল্যাটে মা পৌঁছে দিয়েছে৷ ওখানেই ওদের টিচার আসেন৷ আরো দু’জন আসে ওদের মত বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চা৷ কিছুটা সময় ওরা পড়া-খেলা নিয়ে খুব খুশিতে থাকে৷
গোপালের মা খুব সংকুচিতভাবে ঠিক আমাদের সামনের সিটটাতে বসেছে৷ ভারী ব্যাগ দুটো পাশে রেখেছে৷ ফোনটা সেরে এবার গোপালের মাকে ভালো করে দেখলাম৷ কম দামের ক্যাটক্যাটে হলুদ ঢাকাই শাডি়টাতে কিন্ত্ত বেশ লাগছে ওকে৷ পাতলা গড়ন আর চর্বিহীন মুখখানার জন্য হিংসা হল একটু৷ শাঁখা-পলা, চুড়ি, সিঁদুর সব মিলে বধূত্ব জ্বলজ্বল করছে সারা অঙ্গে৷ মুখখানায় এমন একটা সরল ভাব যাতে ওর বয়সটা ধরতে পারছিনা৷ লাজুক চিবুকে লেগে থাকা হাসিটা বলছে ওর বিয়ের বয়স বেশি নয়৷ আবার চোখের বিষণ্ণতা এবং হাঁটাচলার ভঙ্গিতে ওর জীবন যে খুব সহজ পথে চলেনি সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ এত কথা তখন হয়ত ভাবিনি, কিন্ত্ত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ছিল৷

—কতদূর যাবেন? ওকে তুমি বলতে অস্বস্তি হল৷
—গুপ্তিপাড়া৷ তোমরা?
এই দেখো, ও কেমন সহজে তুমি বলে ফেলল৷ ছোট চুল, জিন্স টপ দেখে কি ও বয়সটা বোঝেনি? নাকি গ্রাম্যতা? একটু গম্ভীর হতে হয়৷
—আমরা ব্যান্ডেল নামব৷ ওখান থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরব৷ এই ট্রেনটা তো ব্যান্ডেল অবধিই যায়৷
—এমনভাবে আসা কেন? বেশ আন্তরিক গলা৷ এদিক পানে আসলে যখন, নবদ্বীপ মায়াপুর ঘুরে গেলে হত না? গেছ কখনো? এবার এলে ছুটির দিনে আসবে৷ নবদ্বীপে কত মন্দির আছে জানো? সারাদিন দেখেও শেষ করতে পারবে না৷
—ছুটির দিন মানে! কার ছুটি?
—তোমাদের গো৷ তোমাদের ছুটির কথা ভাবছি৷ খবরের অফিসে রবিবার ছুটি দেয় না? এভাবে কাজ করতে এসে ঘুরতে পারবে না৷ বকা খাবে সাহেবের কাছে৷
হেসে ফেললাম৷ এ যে দেখি জ্ঞানের নাড়ি টনটনে৷ মজা করার গলায় বললাম,
—তা আমাদের ছুটিতে নয় এলাম৷ এত মন্দির আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে কে? তুমি?
—দুদিন আগে বলে রেখো, আসব নে৷ সারাদিন নবদ্বীপ ঘুরে বৈকালে মায়াপুর নিয়ে যাব৷ রাতটুক থাকবে ওখানে৷ বড় ভালো জায়গা৷ পরদিন আবার এপারে এসে নবদ্বীপের মেসোর হোটেলে দুপুরের খাওয়া খেয়ে তোমরা ট্রেন ধরে নেবে৷
আচ্ছা গায়ে পড়া মানুষ তো৷ আমি নবদ্বীপ যাচ্ছি মন্দির দেখতে৷ খেয়েদেয়ে কাজ নেই৷ তাছাড়া মায়াপুরের ওই সাহেব মেমদের ন্যাকা ন্যাকা কৃষ্ণ প্রেম… অসহ্য! অফিস থেকে এত সৌখিন কাজে আমায় পাঠাবে না কখনো৷ যে ক’দিন ছুটি পাই বাডি়র কাজ, ব্যাঙ্ক, ডাক্তার আর মেয়েকে সময় দেওয়া ছাড়া আর কোনও কথা ভাবার সময় নেই এখন৷ কথা ঘোরানোর জন্য বললাম,
—তোমার বিয়ে হয়েছে কতদিন?
—বাইশ বছর৷
ও বাবা! এই ঢলঢলে সোহাগী মুখটার বয়স বাইশ! আবার একবার ভালো করে দেখলাম ওর দিকে৷ সোহাগের নিচে কোথাও একটা কালি রয়েছে৷ নিশ্চয়ই রয়েছে৷
—তা এখন যাচ্ছ কোথায়? গুপ্তিপাড়ায় তোমার বাপের বাডি়?
—না না শ্বশুরবাডি়৷ নবদ্বীপ, বিষ্ণুপ্রিয়া এসব জায়গা আমাদের ভাতঘর গো৷ গুপ্তিপাড়ায় আমার বাপের বাডি়ও আছে৷ তবে বাবা নেই৷ আর মা বৃন্দাবনেই থাকে বেশিরভাগ৷ আমরা দাঁইহাটে থাকি৷ ওখানে আমাদের জমি আছে অনেকটা৷ চাষবাস করে স্বামী৷ আবার ব্যবসাও আছে৷ আটখানা রিকশা আর দুটো টোটো আছে আমাদের৷
বাহ্! মনে মনে বাহবা দিই৷ বাংলার গ্রামে অবস্থাপন্ন চাষী দেখলে আনন্দ হয়৷
—টোটো দুটো লকডাউনের পরে কেনা৷ পাড়ার দুটো ছেলে কলকাতায় কাজ করত৷ কাজ চলে গেলে আমার স্বামীকে বলল, ‘দাও না কিনে৷ ধীরে ধীরে শোধ দেব চালিয়ে৷’ মানুষটার মনটা দরাজ৷ কেউ কিছু দুঃখ জানালে না করতে পারে না৷ এদিকে ওকে সবাই এক ডাকে চেনে৷
স্বামী গর্বে ফেটে পডে় প্রায়৷
চেষ্টা করে সৌজন্য আনি গলায়৷
—কি নাম তোমার স্বামীর?
—রফিকুল৷ হাসি মুখে তাকালো আমাদের দিকে৷

এবার ক্যাবলা হবার পালা আমাদের৷ শাঁখা সিঁদুর পরা মুসলমানের বউ এই প্রথম দেখছি আমরা৷ আমাদের সার্কলে এমন বিয়ে আকছার হয়৷ এসব ক্ষেত্রে দু’রকম ঘটনা ঘটে৷ মেয়েটি বা ছেলেটি হিন্দু হলে তাকে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে৷ অথবা কোনও ধর্মের তোয়াক্কা না করে দিব্যি সামাজিক জীবন যাপন করছে৷ কিন্ত্ত এ তো দেখি উলটপুরাণ৷ আমার হাঁ করা দৃষ্টির সামনেই ও বলে চলল— শ্বশুরবাডি়র লোকেরা খুব ভালবাসে আমায়৷ বাবা নেই, মা থাকে না, বাপের বাডি়তে খুব একটা যাই না৷ ওবাড়ির লোকেরাই আমার সব৷ কাল ছোট ভাগনাটার বিয়ে৷ আমার হাতের মোচার ডালনা আর বড়ির টক খুব ভালো খায় ছেলেটা৷ এই ব্যাগটাতে খাবার আছে৷ রাতে ওকে আইবুড়ো ভাত খাওয়াবো৷ এই ভাগনাটাকে জন্মাতে দেখেছি৷ কাছাকাছি বাডি় তো… যখন ওর মাইমা হলাম, ওর কি খুশি… সারাদিনে কতবার যে আমাকে ডাকতো, মাইমা… ও মাইমা…আবার কবে খাওয়াতে পারবো কে জানে! বিয়ে হলে তো শ্বশুর বাডি়ই সব৷

বেশ মিষ্টি হাসি গোপালের মা’র৷ ওর হাসিতে আমাদের হাসিও মিশল৷ কিন্ত্ত ‘বিয়ের পর ছেলেরা অন্যরকম’ এ কথাটা একটা জ্বালা ধরিয়ে গেল আমার শিরায়৷ হাসিটা তাই বোধহয় ভালো ফুটল না আমার৷ রিঙ্কুই বলল,
—তোমার বর এল না? বাচ্চারা?
—বর ব্যবসা ছেডে় রাতে আসতে পারল না৷ কাল সকালে জমির কাজ সেরে আসবে৷ এখন বৈশাখী ধান রোয়া হচ্ছে তো৷ ভোর-ভোর কাজে বেরোয়৷ ন’টার ভেতর ঘরে৷
—ছেলেমেয়ে ক’জন তোমার? তাদের আনলে না?
—নেই৷
ওঃ! তাই বলো! বাইশ বছরে ছেলেমেয়ে হয়নি মানে বেশ ঝাড়া হাত-পা৷ ওই জন্য সেজেগুজে এমন পটের বিবিটি হয়ে বিয়েবাডি় চলেছে৷
—নেই তো নেই৷ বেঁচেছ৷ একশো কোটির দেশে ছেলেপুলে হওয়াটাই পাপ৷ সপাটে বলি আমি৷
একটু আগের কথাটা এখনো ভেতরের ঘায়ে খোঁচা দিচ্ছে৷ নোনতা হাসি হেসে আবার বললাম,
—এই যে কী সুন্দর সন্ধেবেলায় সাজুগুজু করে বিয়ে বাডি় চললে চারটি আন্ডাবাচ্চা থাকলে পারতে? রেখে আসলেও জ্বালা৷ সঙ্গে থাকলে তো আরো৷ খাওয়াও রে, শোওয়াও রে…
এবারেও হাসছে গোপালের মা৷ এই হাসিটা যেন কোথায় দেখেছি! বহু পুরনো কালের হাসি৷ বহু যুগ ধরে শুধু মেয়েরাই এমন হাসি হাসতে পারে৷
—সে ঝক্কি তো আছেই৷ এই যে গলার মাদুলি গোপাল দেখছো না… গলায় বাঁধা বটুয়াটা দেখায়৷ এর বায়নাক্কা কম? ঠিক সময়ে খাওয়া, ঠিক সময় শোয়া, একটু এদিক-ওদিক হবার জো নেই৷
ও হরি! গলায় গোপাল নিয়ে মোচ্ছবে চলেছে৷ রিঙ্কু আর সামলাতে পারে না৷
—তোমার শ্বশুরবাডি় তো মুসলমান৷ গোপাল নিয়ে যাচ্ছ? এ বাবা! ওদের তো সব…
এবারে সত্যিকারের হাসি হাসছে মেয়েটা৷
—বললাম না, ওরা আমায় খুব ভালোবাসে৷ গোপালের কোনো অসুবিধা হয় না৷ ও তো আমার কাছেই থাকে৷ এখন শয়ান দিয়েছি৷ ওখানে আমার একটা ঘর আছে৷ গিয়ে খালি বিছানায় শুইয়ে দেবো৷ আমার পাশেই ঘুমায় তো৷ এমনিতে লক্ষ্মী৷ কিন্ত্ত আমি যেই একটু গল্পসল্প করতে বসব জা-ননদদের সঙ্গে, অমনি ডাকবে, ‘মা…’ ঠিক আমার মেয়েটা যেমন ছোটবেলায় করত৷
—তোমার মেয়ে আছে? তা বলছ না তো তার কথা?
—ছিল৷ এখন নেই৷ দু’বছর হল…
এসব মুহূর্ত চুপ করে থাকার৷ তাও একসময় সেই সময়টাও পেরোতে হয়৷
—কত বড় হয়েছিল মেয়ে? কী হয়েছিল ওর?

—বিয়ে দিয়েছিলাম৷ আঠারো পুরতে তখনও দু’মাস বাকি৷ এগারো ক্লাসে পড়তো মেয়ে৷ সেবার ফসল খুব ভাল হল৷ ওর বাপের হাতে কাঁচা টাকা৷ জানো তো, চাষির হাতে কাঁচা টাকা এলে থাকে না৷ তাই সাতপাঁচ ভেবে মেয়েটার বিয়ে দেওয়াই ঠিক হল৷ চেনাশোনার মধ্যেই৷ ছেলেকেও আমি কোলেপিঠে করেছি ছোটবেলায়৷ মেয়েটার জানো, একদম ইচ্ছে ছিল না৷ খুব ফাইট দিয়েছিল বাবার সঙ্গে৷ ‘দাঁড়াও না, জেল খাটাবো তোমাদের৷ বয়সের আগে বিয়ে দিচ্ছো আমার…’ তা কি আর পারে! মেয়ের মন…বাবা মাকে কষ্ট দেবে…

দু’ফোঁটা জল গডি়য়ে নামছে ফিনফিনে শ্যামলা রঙের গালে৷ শান্ত গলা৷ মুখেও কোনও বিকৃতি নেই৷ কার কোন কবেকার শোকের কথা শুধু ওর কথকতায়৷ আমার ভেতরের জ্বালাটা আবার ছিটকে বেরোনোর জন্য পাখসাট মারছে৷ তার আগেই রিঙ্কু গলায় অনেকটা অ্যান্টিসেপটিক ঢেলে প্রশ্ন করল,

—কী নাম ছিল গো মেয়ের?
—দুর্গা৷ দুর্গার মতই গড়ন, বরণ৷ খুব তেজালো মেয়ে৷ আমার মতো একদম হয়নি৷ বাপের মতই হাট্টাকাট্টা চেহারা৷ কাবাডি খেলত… কী বলে? ওই স্টেট লেভেলেও যেত৷ লোকে বলে বাপের ধারা পেলে মেয়েরা নাকি সুখী হয়৷
—হয়েছিল কী মেয়েটার? সুইসাইড নাকি?
রিঙ্কুর জিভ শুলোচ্ছে৷
হতেও পারে, আমি ভাবলাম৷ অমন স্বাধীন বন্য জীবকে খাঁচায় পুরলে তার আর কী গতি!
—পুডি়য়ে দিয়েছিল শাশুডি়৷ যখন খবর পেয়ে গেছি, দেখি মেয়ে নেই, শুধু আংরা৷
আরো ফোঁটাকতক জল গাল গডি়য়ে ওর হাতে টুপটাপ৷

একটা লজেন্সওয়ালা আর একটা ঘুগনি-ওয়ালার বেশ কিছু বিক্রিবাটা হয়েছে এই কামরাটায়৷ এখন প্রায় খালি এই ডিব্বা৷ ঘুগনি খেয়ে বাটিগুলো ভেতরেই ফেলেছে গেঁয়ো মেয়েগুলো৷ ট্রেনের গতির সঙ্গে হওয়ার দাপটে ওগুলো উডে় বেড়াচ্ছে কামরা জুডে়৷ কাগজের একটা বাটি উডে় রিঙ্কুর হাতে এসে পড়তেই ও একদম আরশোলা বসার মত করে আঁৎকে উঠে হাতটা ঝাড়ল৷ বাটিটা গিয়ে পড়ল মেয়েটার শাডি়তে৷ ও আলতো করে তুলে জানলা গলিয়ে ফেলে দিল বাটিটা৷ রিঙ্কুর চোখ মুখ কুঁচকে গেছে৷ ওয়াক্! বমির আওয়াজ করে ও৷
—ইস! এঁটো পাতাটা ধরলে? হাত ধোও হাত ধোও৷ তোমার গোপাল আছে না?
—ওমা এঁটো ফেললে গোপাল রাগ করে, কে বলল তোমাকে? তবে হাতটা ধোব৷ ঘুগনির ঝোল ছিল পাতাটায়৷ হাতে লেগেছে৷
আমার জ্বালাটা ঠিকরে উঠছে৷ ওর বৈষ্ণবী ভাব একটুও জল ঢালছে না আমার ঘায়ে৷ আমার আট বছরের তিয়া… যাক বাবা! ওর অন্তত কখনো বিয়ে দিতে হবে না…
—এই গোপাল কি তোমার আগেই ছিল? নাকি মেয়ে মারা যাবার পর স্বপ্ন টপ্ন পেলে?
কথার ঝাঁজটা ভালই বুঝেছে৷ কেমন একরকম ভাবে দেখল আমায়৷ গায়ে মাখলো না যদিও৷
—না গো৷ খুব কান্নাকাটি করতাম তো৷ পাগল পাগল লাগত৷ পাড়ার কয়েকজন ওকে দিয়ে গেল৷ সেই থেকে…
—মুসলমানের ঘর, বর… তোমার আত্মীয়রা কিছু বলে না?
—বরই তো সব এনে দেয় ওর ভোগের৷ পাঁচবার তো পারে না, এশার নামাজটা করে৷ তারপর মালপো আর কাটা ফল খেয়ে জল খায়৷ ও একদম অভ্যাস হয়ে গেছে৷
—তাহলে এই হল তোমার দুর্গার মা থেকে গোপালের মা হবার কাহিনী? লজ্জা করে না তোমার, জ্যান্ত মেয়েটাকে বিসর্জন দিয়ে পুতুল নিয়ে খেলা করতে?
এতক্ষণে সবটা বিষ উজাড় করার সময় এসেছে৷
—মেয়েটাকে মেরে ফেললে সবাই মিলে৷ শ্বশুরবাডি় তো ভালো৷ তোমরা মা বাবা, তোমাদের ধরে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত৷
ওর দৃষ্টি জানলার বাইরের অন্ধকারে৷ মুখে রেখারা তৈরি হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে৷ রিঙ্কু আমার মত ঝাঁঝালো নয়৷ ও নরম করে বলে,
—কাউকে ধরেনি পুলিশ? তোমরা মামলা করোনি? ডায়েরি তো করেছিলে?
—বিয়ের দু’মাসও গড়ায়নি৷ মাঝে একবার এল গুপ্তিপাড়া থেকে৷ মায়ের চোখ তো… দেখেছিলাম মেয়ের চোখের তলায় কালি৷ কিছু বলিনি৷ নতুন বিয়ে এমন একটু হয়৷ নিজের কথা মনে করে বরং লুকিয়ে হেসেছিলাম৷ মেয়েও এমন চাপা৷ আমাকে না, ওর বাবাকে না, একটা কথাও বলল না৷ রোজ ফোন করতাম৷ বিয়েতে নতুন মোবাইল দিয়েছিলাম৷ জামাই বেশি বলত কথা৷ ও দু-একটা কথা বলে ছেডে় দিত৷ আমি ভাবতাম, লজ্জা পাচ্ছে বুঝি৷ এখন…
—এত কষ্ট পাচ্ছ তাও শাস্তি দেবে না ওদের? একটা মেয়ের জীবন, এতো সস্তা?
—কাকে দেবো শাস্তি? সব নিজেদের লোক৷ জামাই তো আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু৷ আর ওর তেমন দোষও ছিল না৷ মেয়ে পড়ার জন্য জেদ করেছিল৷ শাশুডি় নাকি একটুও রাজি ছিল না৷
—তা বলে মেরে ফেলবে! আর তোমরাও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে! ছি! ছি! আমায় দেখো৷ আমার বরের কাছ থেকে আমি খোরপোষ আদায় করে ছেডে়ছি৷ এক মাস জেল খেটেছে শ্বশুরবাডি়র লোকজন৷ সত্তর বছরের বুড়ো শ্বশুরকে পর্যন্ত ছাডি়নি৷ আমি মামলা তুলে নিতে তবে ছাড়া পেয়েছে ওরা৷ তাও তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেনি কখনো৷ যে পরিমাণ টাকা দিতে হয় এখন, লোকটার মাজা ভেঙে দিয়েছি একদম৷
গোপালের মা গোল গোল চোখ করে শুনছিল আমার কথা৷ রিঙ্কু ওর পাশে গিয়ে বসলো৷ ওর হাতের উপর একটা হাত রাখল৷ বলল,
—এই যে তুমি হিন্দু হয়ে মুসলিম ঘরে বিয়ে করেছ. ওদের সঙ্গে থাকছ, খাচ্ছ— কর্মফল বলে তো কিছু একটা আছে, না?
দু’জনের মুখের দিকেই ও হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকালো৷ যেন একটা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পডে়ছে৷
—প্রথম প্রথম কেউ কেউ এমন কথা বলত৷ নিজের ধর্ম ছাড়লে নাকি পাপ লাগে৷ কিন্ত্ত আমি তো প্রতি বেস্পতিবার লক্ষ্মী পুজো করি, শাঁখ বাজাই৷ মুসলমানের ঘরে এসব করা কি পাপ? আমার পাপেই কি মেয়েটা?
আমি কড়া চোখে রিঙ্কুর দিকে তাকালাম৷ এরা কি কোনোদিন বড় হয় না?
একটা চা-ওয়ালা উঠল এই স্টেশন থেকে৷ কোথায় এলাম রে বাবা! কতদূর আর ব্যান্ডেল?
—শোনো না, কর্মফল বলতে ওই যে তোমরা মেয়েটাকে তাড়াতাডি় বিয়ে দিলে, তারপরও তেমন কিছু খোঁজখবর করলে না, সেটাই৷ তোমার পুজোটুজো এসব কিছু না৷ এসব যার যার মনের ব্যাপার৷ বুঝলে গোপালের মা?
—না না তোমরা আর আমাকে গোপালের মা বোলো না৷ আমার নাম মালতী৷ নার্গিস বলে ডাকে ওরা৷
—চা খাবে? আমরা একটু খাব৷
—দাও৷ বিকেলে তো ও ঘরে ফেরার আগেই বেরিয়ে পরেছি৷ চা খাওয়া হয়নি৷
নিঃশব্দে চা খাই আমরা৷ চা খাবার আগে গোপালের মা জল চাইল রিঙ্কুর কাছে৷ আবার একবার হাত ধুলো দরজার কাছে গিয়ে৷ গলার বটুয়াটা খুলে একটা ব্যাগের উপর রেখেছে৷ ওর সরল মনটাকে বেশ ধাক্কা দিয়েছি আমরা৷
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই৷ বিটিপিএস-এর চাকবাঁধা আলো৷ বাঁশবেডি়য়া ছেডে় গেছে৷ ব্যান্ডেল ঢুকছে তার মানে৷ রিঙ্কু কিচ্ছু চেনে না এদিককার৷ ওকে বললাম, ক্যামেরার ব্যাগটা ঠিক করে নিতে৷ গোপালের মা’র হাতে এখনো কাগজের কাপ৷ মনে পড়ল, ওর তো গুপ্তিপাড়ায় নামার কথা৷ বললাম ওকে৷ খুব একটা হেলদোল দেখলাম না৷
রাত ন’টার কাছাকাছি সময়ে জংশন স্টেশনের ব্যস্ততা তুঙ্গে৷ পাশের প্লাটফর্মে দাঁডি়য়ে রয়েছে ডাউন ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস৷ ওপাশে আপে আরো কোন একটা এক্সপ্রেস গাডি়৷ পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে নৈহাটি লোকাল রয়েছে৷ দূরপাল্লার যাত্রীদের হাতে কাঁধে ব্যাগ সুটকেস, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, কুলিদের ছুটোছুটি৷
নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম৷ মাথা তুলে দেখি গোপালের মা নেই৷ চোখ গেল দরজার দিকে৷ সেখানেও না৷ কামরার এধারে ওধারে কোথাও নেই৷ ব্যাগগুলো, এমনকি গোপালের বটুয়াও তেমনি রাখা সিটের ওপর৷ ব্যাগগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে রিঙ্কুকে বললাম, গেল কোথায়?
—হ্যাঁ তাইতো৷ আমি তো পেছন ফিরে ব্যাগের স্ট্র্যাপটা টাইট করছিলাম৷ কখন উঠে গেছে টের পাইনি৷ ব্যাগট্যাগগুলো কী হবে গো? আমাদের ট্রেন ছেডে় দেবে তো৷ চলো চলো৷ এখন এসব পাহারা দিতে গেলে…
—হ্যাঁ চল৷ তবু দুজনের চোখই প্ল্যাটফর্মের ভীড়ে খোঁজে ওকে৷ রিঙ্কুই প্রথম দেখতে পায় হলুদ শাডি় অনেক লোকের ভিড় সামলে আলগোছে হেঁটে চলেছে৷
—ডাকি ওকে? ও তিস্তা দি…
ডাকা তো যায়ই৷ এক ছুটে গিয়ে ওকে ছুঁয়ে ফেলাও যায়৷ কিন্ত্ত কাকে ডাকবো? গোপালের মা, নাকি নার্গিস? নাকি ও এখন শুধুই মালতি?
বললাম,
—থাক খুঁজিস না ওকে৷ ও নিজেকে খুঁজতে গেছে৷