রেখা ও জলরঙে সুদক্ষ এক অনন্য শিল্পী

রণেন আয়ন দত্ত (২৪ নভেম্বর ১৯২৭ – ৩ মার্চ ২০২৪)
আধুনিক বিজ্ঞাপন শিল্পের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রণেন আয়ন দত্ত ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন সম্প্রতি৷ প্রচ্ছদচিত্র অঙ্কনে, শিল্পনির্দেশনায় এবং মণ্ডপ-সজ্জাতেও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে৷ গত আশি এবং নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞাপনের ভাষাকে তিনি দিয়েছিলেন এক ভিন্নতর মাত্রা৷ তাঁর তৈরি বোরোলিন, শালিমার নারকেল তেল বা জবাকুসুম তেলের বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ একটি সিগারেটের বিজ্ঞাপনে তাঁর লেখা ‘মেড ফর ইচ আদার’ তো খুব সাড়া ফেলেছিল৷ এসবের বাইরেও গ্রাফিক্স, সিনেমার পোস্টার থেকে মু্যরাল— শিল্পের এমন বহুবিধ ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল বহুমাত্রিক৷
রণেন আয়ন দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ২৪ নভেম্বর, শ্রীহট্ট বা সিলেটে৷ তাঁর পিতা রজনীমোহন দত্ত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী৷ কিছুটা দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছিল তাঁর শৈশব৷ কলকাতায় চলে আসার পর ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪২ সালে ভর্তি হন সরকারি আর্ট কলেজে৷ এই কলেজের সঙ্গে নাম জড়িয়ে আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, মুকুল দে থেকে পার্সি ব্রাউন বা ই বি হ্যাভেলের মতো শিল্পব্যক্তিত্বের, যাঁরা ভারতীয় শিল্পকলার ক্ষেত্রে এনেছিলেন নবজাগরণ৷ তাঁরা তখন এই কলেজের অভিভাবক৷

মূলত তাঁর বাবার উৎসাহেই তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল৷ এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অতুল বসু, আনোয়ারুল হক, মাখনলাল দত্তের মতো শিক্ষকদের৷ ফিগার ড্রয়িংয়ের পাশাপাশি জলরঙেও দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে কলেজের পরীক্ষা পাশ করেন৷

প্রধানত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং যামিনী রায় তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল৷ পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে শিক্ষা নিয়েও অবনীন্দ্রনাথ প্রাচ্য শিল্পরীতিকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে গিয়েছেন৷ যামিনী রায়ও অনেকটা সেরকমই পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্পচর্চা করলেও বাংলার নিজস্ব লোকশিল্পের ধারাকে তুলে আনলেন৷ অবনীন্দ্রনাথ এবং যামিনী রায় প্রবর্তিত এই দুই ধারায় অনুপ্রাণিত হয়েও খানিকটা পাশ্চাত্য শিল্পধারাকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন রণেন আয়ন৷


কলেজ পাশ করার সময়ই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় চিত্রশিল্পী অন্নদা মুন্সীর৷ রণেন আয়নের রেখা এবং জলরঙের কাজ তাঁর ভালো লেগেছিল৷ তাঁর হাত ধরেই বিজ্ঞাপনের জগতে প্রবেশ ঘটল রণেন আয়নের৷ অন্নদা মুন্সীর বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘প্রবেশিকা’য় যোগ দিলেন তিনি৷ পরে বোম্বাইয়ের ‘স্টোন অ্যাকস’ সংস্থায় কাজ করার সময় তিনি যুগান্তকারী সব বিজ্ঞাপনের নিদর্শন তৈরি করেন৷ কলকাতায় এসে যোগ দেন জে ওয়াল্টর থমসন কোম্পানিতে, পরে যা ‘হিন্দুস্তান থমসন’ নামে পরিচিত হয় এবং সেখানে প্রধান আর্ট ডিরেক্টর হন তিনি৷ পরের প্রজন্মের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা তাঁকে বলতেন ‘ডিজাইন গুরু’৷
শিল্পের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করতে ভালোবাসতেন রণেন আয়ন৷ মণ্ডপসজ্জাতেও খ্যাতি ছড়িয়েছিল তাঁর৷ ১৯৭২ সালে দিল্লিতে ‘এশিয়া-৭২’-এর মেলায় তাঁর তৈরি মণ্ডপসজ্জা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তিনি নিজে গিয়ে আলাপ করেছিলেন শিল্পীর সঙ্গে৷ রাশিয়া, ফ্রান্স, লন্ডনের ভারত উৎসবে খ্যাতি পেয়েছে তাঁর তৈরি করা মণ্ডপসজ্জা৷ তাঁর পরিকল্পনাতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সংগ্রহশালা৷ কলকাতায় রামমোহন সংগ্রহশালা এবং স্টেট ব্যাঙ্কের সংগ্রহশালাও তৈরি করেছিলেন তিনি৷

১৯৭৪ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজের সংস্থা ‘RAD Associates’৷ কলকাতার এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং, এক্সাইড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কোল ম্যানেজমেন্টের মতো বিখ্যাত সংস্থাগুলি সজ্জিত হয়েছিল তাঁরই শিল্প এবং স্থাপত্য ভাবনায়৷ ইলাস্ট্রেটর বা শিল্পনির্দেশক হিসেবেও তাঁর ছিল বিশেষ খ্যাতি৷ সুভো ঠাকুরের ‘সুন্দরম’ এবং হুমায়ুন কবীর প্রতিষ্ঠিত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকাতেও তাঁর কাজ অনেকের স্মরণে আছে৷

বইয়ের প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে তাঁর অাঁকা প্রবোধকুমার সান্যালের ‘অগ্নিসাক্ষী’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নাম’ প্রভৃতি আরও কিছু প্রচ্ছদ ইতিহাস হয়ে আছে৷ তিনি বদলে দিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার পোস্টারের ভাষাকেও৷ তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’, অজয় করের ‘হারানো সুর’, ‘অরুন্ধতী দেবীর ‘ছুটি’ ইত্যাদি সিনেমার পোস্টারগুলিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ ইলাস্ট্রেটিভ বিজ্ঞাপনের জগতে রণেন আয়ন দত্ত তাঁর সময়ে হয়ে উঠেছিলেন প্রায় কিংবদন্তীপ্রতিম এক শ্রেষ্ঠ শিল্পী৷

কিন্ত্ত পরিতাপের বিষয়, এরকম একজন শিল্পীর প্রধান কাজগুলি দেখার তেমন কোনও সুযোগ এই কলকাতা শহরে আর নেই৷ কিংবা থাকলেও তা এই প্রজন্মের সামনে তুলে ধরবে কে! নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ছবি এঁকে গিয়েছেন৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট দিয়ে সম্মানিত করেছিল৷ কিন্ত্ত তাঁর যে ইচ্ছে ছিল, তাঁর শিল্পকর্মের নিদর্শনগুলো একসঙ্গে সাজিয়ে রাখার৷ সে কাজ আর করবে কে!