সৈয়দ হাসমত জালাল
২০২০ সালের মার্চ মাসে হঠাৎ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। সে বছর কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল সারা বিশ্বের মানুষ। এই রোগ যে প্রচণ্ড সংক্রামক, স্বাভাবিকভাবেই তাই আতঙ্কও ছড়িয়েছিল সারা পৃথিবীতে। ২০২০ সালে ২০ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল লকডাউন। আর তার পাঁচদিন পর থেকেই লকডাউন শুরু হয় সারা দেশজুড়ে। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক সবুজবরণ সরকার তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশেষ সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৯ মার্চ ২০২০ থেকে তিনি রোজনামচার মতো প্রতিদিন লিখে রেখেছেন সেই দিনকার করোনা সংক্রান্ত ঘটনাগুলি। তখনকার এক একটি দিন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত এবং বিশ্বের কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং করোনা প্রতিরোধে কোন কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকার, তার ধারাবাহিক বিবরণ লিখিত হয়েছে এই গ্রন্থে। এক অর্থে এই গ্রন্থটিকে করোনাকালের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস বলা যেতে পারে। কোন দেশে কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত এবং কত মানুষের মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন, সেই পরিসংখ্যানও তিনি তলিকাবদ্ধ করেছেন।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চিনের উহান শহরের দু-একটি করে মানুষের দেহে করোনার জীবাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তারপর তা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। ২০২০ সালের ২৯ মার্চেই জানা যায়, আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ১২ হাজার ৪৬৮ জন আর মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৪১। ইতালিতে আক্রান্ত ৯২ হাজার ৪৭২ আর মৃত ১০ হাজার ২৩। চিনে আক্রান্ত ৮১ হাজার ৯৯৯, মৃত ৩ হাজার ২৯৯, স্পেনে আক্রান্ত ৭২ হাজার ২৪৮, মৃত ৫ হাজার ৮১২। এইভাবে জার্মানি, ইরান, ইংল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশের পরিসংখ্যানও দেওয়া হয়েছে। ভারতে তখন আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৩৭ এবং মৃতের সংখ্যা ২৫।
ভারতে প্রথম পর্যায়ে ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে ঘোষিত হয়েছিল নানান বিধিনিষেধ। যেমন লকডাউনের প্রথম ২৪ দিনে প্রতিটি মানুষকে ঘরের মধ্যেই বসবাস করতে হবে, বাইরে বেরোনো চলবে না। অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না এবং শারীরিক দূরত্ব রাখতে হবে অন্তত ৬ ফুট, যাকে তখন ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ বলা হচ্ছিল। যদিও পরে এই শব্দটি নিয়ে কিছুটা আপত্তি দেখা গেলে তাকে সামাজিক দূরত্বের বদলে শারীরিক দূরত্ব বলা হয়। সে সময় অনিবার্য প্রয়োজনে বা অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করতে হত। এছাড়া ঘরে ফিরে ধুয়ে ফেলতে হত জামাকাপড়। দু’হাতও ধুয়ে ফেলতে হত সাবান-জল দিয়ে। বিদেশ থেকে কেউ এদেশে এলে তাকে অবশ্যই ১৪ দিন থাকতে হত কোয়ারেন্টাইনে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সমস্ত যানবাহন। আমরা দেখেছি, পরিযায়ী শ্রমিকদের সেসময় কাজ না থাকায়, তাঁরা ফিরছিলেন নিজেদের গ্রামে। রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মৃত্যুও তাঁদের কম ঘটেনি।
সে বছরই ২৩ মার্চ ইউরোপের শেয়ার বাজারে রেকর্ড পতন হয়। একদিনে মুছে যায় প্রায় ১৪.২২ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ। পৃথিবীর প্রায় ২০% অংশে শুরু হয় লকডাউন। ভারত সহ বিভিন্ন দেশের রাস্তাঘাট, কলকারখানা, আদালত, বাজার, স্কুল, কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সমাবেশ ঘটেছে বিচ্ছিন্নভাবে। তা নিয়ে টেলিভিশনে কম সংবাদ প্রচারিত হয়নি। সেইসব সংবাদ এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধের বিশ্লেষণের কথা এই গ্রন্থে আলোচনা করেছেন লেখক, যা সেই সময়কার পরিস্থিতি বুঝতে ভবিষ্যতে সাহায্য করবে।
তিন দফায় আমাদের দেশে করোনার ঢেউয়ে সারাদেশে মৃত্যু, খাদ্যাভাব এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। ২০২০ সালে ২৯ মার্চ থেকে ১২ মে, ২০২৩— এই সময়কালের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। সে সময় দেশে অর্থনীতির অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছিল, তার পরিচয় আমরা এখান থেকে পেতে পারি। যেমন, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে লেখক জানাচ্ছেন— ‘করোনাকালে সারা বিশ্বে বিত্তবানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে মানুষের সুখ।’ এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে তিনি জানাচ্ছেন, ‘২০২১ সালে দেশে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা
২০২০-র তুলনায় ১১% বেড়েছে। মুম্বইয়ে এমন পরিবারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি—২০ হাজার ৩০০। দিল্লিতে ১৭ হাজার ৪০০। আর কলকাতায় ১০ হাজার ৫০০। ২০২৬ সালে এইসব বিত্তশালীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হল, বিশ্বের নতুন দরিদ্রের প্রায় অর্ধেক বাস করেন ভারতে। দেশবাসীর নিচের ৫০ শতাংশ মানুষ জাতীয় সম্পদের মাত্র ৬%-এর মালিক।
করোনার প্রভাব যখন শেষ হয়ে এসেছে, সেই সময় জানা যাচ্ছে, কোভিডের তৃতীয় পর্বে চিনের জনজীবন বিধ্বস্ত হলেও ভারতে তার প্রভাব সিকি ভাগও নয়। তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভারতীয়দের মধ্যে হাইব্রিড ইমিউনিটি বা মিশ্র রোগ প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে, যা করোনার যে কোনও প্রজাতিকেই রুখে দিতে সক্ষম। তাছাড়া টিকাকরণের কাজও ভালোভাবে হয়েছে ভারতে। মানুষের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেকটাই বেড়েছে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার জন্য।
প্রসঙ্গত, করোনার টিকা এবং তার প্রতিষেধক আবিষ্কার ও মানুষের উপরে তার ব্যবহারের কথাও বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। ভারতের মধ্যেও প্রতিটি রাজ্যের তখনকার অবস্থা পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এরকম একটি গ্রন্থ শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসে প্রভাবিত বিশ্বের ও সেই সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আর লেখা হয়েছে কিনা, জানা নেই। বলা যায়, একটি অসাধারণ ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন লেখক সবুজবরণ সরকার অত্যন্ত সহজ ভাষায় ও বিশ্লষণে। প্রতিটি দিনের ঘটনাবলী দিনলিপির আকারে তিনি লিখে রেখেছেন। ৫৫৬ পৃষ্ঠার এরকম একটি গ্রন্থ রচনা— এ এক অসামান্য কাজ। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের উপযোগিতা অস্বীকার করা যাবে না।
করোনা অতিমারিতে ভারত ও বিশ্ব।
সবুজবরণ সরকার।
চেতনা প্রকাশনী। মূল্য: ৪৫০ টাকা