পাহাড় থেকে মেয়ে পাচার, পর্ব-৪

‘এগারোটা মেয়ের একখানা মেয়ে’

দার্জিলিঙের পথে যেসব সবুজ চা বাগানকে পেছনে রেখে টু্যরিস্টরা ছবি তোলেন, সেই চা বাগানের ভেতর থেকে মেয়েরা উধাও হয়ে যেত৷ আজও যায়৷ কোথায় যায় তারা! উত্তর ছিল না বাড়ির লোকের কাছে৷ জানা ছিল না পুলিশেরও৷ খোঁজ চালিয়েছিলেন দার্জিলিঙের সাহসী মেয়েটি— রঙ্গু সউরিয়া৷ আশপাশের ছেলেদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র৷ ফিরিয়ে এনেছেন নকশালবাড়ি, কালিম্পং, বিজনবাড়ি, মিরিকের হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের৷ হয়তো-বা পারেননি কখনও পাচার হওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে৷ কিন্ত্ত কীভাবে ফিরিয়ে এনেছেন, এ নিয়েই ধারাবাহিক ‘পাহাড় থেকে মেয়ে পাচার’৷ লিখছেন মঞ্জীরা সাহা

সবুজ লেয়ারে লেয়ারে চা বাগান৷ মেঘ কেটে রোদ দেখা যাচ্ছে একটা ফাঁক দিয়ে৷ রোদটা ফাঁক দিয়ে পড়ায় সেই বড় গোল অংশটায় সবুজ পাতার রঙটা বদলে কেমন হাল্কা সবুজ হয়ে গেল৷ আবার বদলে যাচ্ছে৷ কালো ধূসর একটা বড় সাইজের মেঘ কার্শিয়াং পাহাড় ছেড়ে তিরহানার দিকে এগিয়ে এলো৷ শিশু গাছগুলোর তলায় ঢালা চা পাতার রঙগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে৷ ঠিক একটু আগের সবুজটাতো নয়৷ এখন যেন কেমন কালো ঘন গাঢ় সবুজ হয়ে উঠছে৷ কী একটা পাখি এক নাগাড়ে সকাল থেকে ডেকে যাচ্ছে৷ গাছগুলোর পেছন দিয়ে আকাশটা ছাই হয়ে আসছে৷ বৃষ্টি নামছে৷ টপ টপ টপ৷ বড় দু-চার ফোঁটা৷ বাগানের পাতাগুলো নড়ে উঠছে৷ বেশি নড়ে নড়ে উঠছে৷ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল৷ ভিজিয়ে দিচ্ছে শিশু গাছের ডালগুলো, পাশের ওই মাটির দেয়ালটা৷ ভিজছে কালো পাখির পাখনা৷ বৃষ্টি হতে হতে বিকেলের আলো চলে গিয়ে বাগানটাতে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে…৷


ওই ঘরগুলো অন্ধকার হয় না কখনও৷ সব কিছু দেখা যায়৷ ঘরের ভেতর হাওয়া ঢোকে না৷ ভোরের আলো এসে পড়ে না৷ বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দেয় না৷ অন্ধকার নেই কোথাও৷ জায়গাটা দিল্লির জিবি রোডে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিং৷ সেই রেডলাইট এরিয়ার কোনও এক ঘর৷ আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেক মেয়ে৷ চা বাগানের মেয়েদের মুখগুলো থেকে আলাদা৷ পোশাকগুলো আলাদা৷ রঙচঙে পোশাক৷ অনেক লোক৷ লোকগুলোর মুখগুলো নানান রকম৷ অনেক শব্দ এখানে৷ অনেক লাইট৷ ঝলমলে লাইট৷ রঙচঙে লাইট৷ দাঁড়িয়ে আছে বসে আছে মানুষ৷ মানুষের সামনে পেছনে মানুষ৷

এসব কল্পনা করছি বসে রঙ্গুর কথাগুলো শুনতে শুনতে৷ যে বড় বাড়িটায় ওকে বিক্রি করে দেওয়া হল সেটা কেমন জানি না! জানা সম্ভবও নয় আমার পক্ষে৷ কোনও সত্যিকারের রেড লাইট এরিয়ার ঘর কেমন হয় দেখিনি কোনোদিন৷ সিনেমায় দেখেছি৷ বসে বসে কল্পনা করছি পাহাড়ি এক চা বাগানের মাঝে কোনও এক নির্জন বাড়িতে বসে রাজধানী শহরের রেডলাইট এরিয়ার কোনও বাড়ি৷ চা বাগানের উনিশ কুড়ি বছরের মেয়েটা গিয়ে পড়েছে৷ যে এতোদিন কোনও এক বৃদ্ধ লোকের থেকে ছাড়া পেতে চাইছিল৷ রোজ বেরিয়ে যেতে চাইছিল সেই লোকটার কবল থেকে৷ সে আবার আটকা পড়ে গেছে৷ এখানে রোজ রোজ এবেলা ওবেলা নতুন লোক৷ অনেক ঘর৷ সকাল সন্ধ্যা রাত দুপুর লোক ঢোকে৷ আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বসে থাকা শুয়ে থাকা মেয়েদের মুখে রঙ মাখানো৷ চড়া লিপস্টিক ঘষে দেওয়া ঠোঁট৷ ইমিটেশনের গয়না৷ চুলের ক্লিপ৷ ফুল৷ সেন্টের গন্ধ৷ চকচকে ড্রেস চারপাশে৷ ড্রেস থেকে আলো ঝলমল করছে৷

কীরকম জিবি রোডের রেড লাইট এরিয়া? রঙ্গুকে জিজ্ঞাসা করলাম৷
রঙ্গু উত্তর দিলেন, ‘অনেক বড়৷ রোডের উপরেই অনেকগুলা বড় বড় বিল্ডিং৷ সেখানে অনেকগুলো ঘর আছে৷ শুধু একটা করে বিছানা আছে৷ আর কিছু নাই৷ কিন্ত্ত কী হল জানো, মেয়েটা ওখানে গিয়ে খুব ঝামেলা লাগায়ে দিল৷ কিছুতেই শুনবে না ওদের কথা৷’

—ওদের কথা না শুনে পারছিল?
—‘খুব ঝামেলা করেছে৷ রোজ রোজ খুব ঝামেলা করতে লাগল৷’
—কীরকম?
—‘কখনও হাত কাটতে নেয়৷ ভাঙা বোতল ঠোতল যা পায় তাই দিয়া হাত কাটে৷ কখনও জাম্প দিয়ে পালাতে চায়৷ কিচ্ছুতেই ওকে রাজি করাইতে পারছিল না ওরা৷ কিচ্ছুতেই শুনবে না ও রেডলাইট এরিয়ার মালকিনের কথা৷ ওকে দিয়া মালকিনটা কিছুতেই কাস্টোমার এটেন্ড করাতে পারছিল না৷ ও কিছুতেই করবে না ওসব৷ ওদের তো একখানা রুলস আছে৷ ওরা সেইভাবে সাজায়ে গোছায়ে মেয়েদের রুমে পাঠায়ে দেবে৷ সে কিছুতেই সাজবেও না৷ সাজালে মুছে দেয়৷ খেতে দিলে খাওয়া দাওয়া করে না৷ কান্নাকাটি করে চিৎকার করে৷ ওরা ওকে নিয়ে একদম পাগল হয়ে যাচ্ছিল৷’

মেয়েটির জিবি রোডের ওই বিল্ডিংয়ের ভেতর এই না মানার গল্প রঙ্গু নিজে দেখেনি৷ রঙ্গুর কাছে মেয়েটি তখন অচেনা৷ মেয়েটির বাড়ির লোক এসে মেয়েটির ছবি দিয়ে গিয়েছিল৷ রঙ্গু সেই শীতের বিকেলে যা যতটুকু বলে চলেছেন সবটাই পরবর্তী কালে মেয়েটির কাছে শোনা৷

—‘মেয়েটাকে দিয়ে ওরা করাবেই কাম৷ ওই লোগগুলো শুনবেই বা কেন বলেন? ওরা টাকা দিয়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়েছে৷ তো ওরা তো ওকে দিয়ে ইনকামটা করাবেই৷ তারপর শুরু হল ওর ওপর ফিজিকাল টর্চার৷ মানে মারধোর৷ খুব মারধোর করেছে৷ আর ও পালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ লাস্টে কিছুতেই লেড়কিটা রাজি হল না দেখে ওরা ভাবল কি অতো ঝামেলা কে নেবে! কিনেছি একে দিয়ে তো কোনও কামে লাগানো যাচ্ছে না তো ওকে একটা ল্যাড়কাকে দিয়ে ওখান থেকে বার করে দিল৷’

—ছেড়ে দিল মেয়েটাকে?
—‘আরে শোনেন না! ওরা নিয়ে এলো ডেল্লি স্টেশনে৷ সোজা ট্রেনে উঠায়ে নিল৷’
আবার যেন কীরকম হাল্কা লাগছে৷ মনের ভেতর কীরকম যেন আশার ভাব জাগছে৷ কী হবে… কী হবে! চা দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ৷ বিকেলের ঠাণ্ডা ঘরটাকে কামড়ে ধরেছে৷ চায়ের কাপে যে অনেকক্ষণ চুমুক দেওয়া হয়নি মনে ছিল না৷ এক ফাঁকে চুমুক দিয়ে ফেললাম কাপে৷
—‘মেয়েটাকে আবার বিক্রি করে দিল৷’
চমকে উঠলাম৷ জিভটায় ঠাণ্ডা বরফের মতো তরলটার ছোঁয়া বিস্বাদ করে দিল৷ রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললাম, কোথায়?
—‘পুনেতে নিয়ে এসেছিল মেয়েটাকে৷ পুনের রেড লাইট এরিয়াতে বিক্রি করে দিল৷’
—পুনের রেড লাইট এরিয়ার জায়গাটা কোথায়?
—‘বুধওয়ারপেট৷’
এই বুধওয়ারপেট নামটা সেই প্রথম শুনলাম রঙ্গুর মুখে৷ তারপর এ নামটা রঙ্গুর মুখে শুনে শুনে মুখস্থের মতো হয়ে গিয়েছিল৷ রঙ্গুর বেশিরভাগ রেসকিউ স্পট হল পুনের বুধওয়ায়রপেট৷
—একটা রেড লাইট এরিয়া থেকে আরেকটা রেড লাইট এরিয়াতে বিক্রি হয়ে গেল?
—‘হ্যাঁ৷ ওই জিবি রোডের রেড লাইট এরিয়ার ওর মালকিনটা বুঝতে পারছিল কি একে কিছুতেই গ্রিপে আনা যাবে না৷ অনেক ঝামেলা করছিল না! তো সে তো টাকাই লাভ করতে চাইবে না! তো ও ভাবল কি সেল করিয়ে দিয়ে ঝামেলা খতম করে দি৷’
—ওই দিল্লির রেড লাইট এরিয়াতে তো ওকে কাস্টমার অ্যাটেন্ড করতে হয়নি?
—‘হ্যাঁ সে তো স্টার্ট হইয়েই গেছিল৷ কিন্ত্ত ওরা চায় একটা মেয়ে চুপচাপ সে যাবে কাস্টোমার এটেন্ড করবে৷ আর ওদের কথা সব মেনে নেবে৷ তো এ লেড়কিটা তো সেটা কিছুতেই করছিল না৷ তাই এই বুধওয়ারপেটে এনে সেল করে দিয়ে চলে গেল ডেল্লির জিবি রোডের লোগ৷’
রাজধানী শহরের রাস্তা দিয়েই থানা পুলিশ পার্লামেন্ট পার হয়ে এক রেড লাইট এরিয়া থেকে তুলে আনা হচ্ছিল আস্ত একটা মেয়েকে বিক্রি করতে৷
—মেয়েটা এই বুধওয়ারপেটে এসে রাজি হয়ে গেল?
—‘মেয়েটা আসলে ডিপ্রেশনে চলে গেছিল৷ ও মেনে নিয়েছিল কি ওর নাসিবটাই খারাব আছে ওকে এই কাজ করতেই হোবে৷’

মেয়েটার দিল্লির জিবি রোডে কয়েকমাস কেটেছে৷ আবার বিক্রি হয়ে বুধওয়ারপেটেও এক বছরের কাছাকাছি কেটে গেছে৷ এর মাঝে রঙ্গুর কাছে অনেক অনেক মেয়ের মিসিং কেস জমা হয়ে গেছে৷ ডোমেস্টিক কাজে গিয়ে আটকে পড়া মেয়েদের উদ্ধার করেছে৷ রেড লাইট এরিয়াতে বিক্রি হওয়া মেয়েদেরও রেসকিউ করতে শুরু করে দিয়েছে৷ মিটিং করছে বারবার৷ পুলিশকে গিয়ে বোঝাচ্ছে যে এভাবে মেয়েগুলো হারিয়ে গিয়ে কীভাবে বিক্রি হয়ে যায়৷ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে বারবার রওনা দিয়েছে ট্রেন ধরে কোনও এক অচেনা অজানা মেয়েকে উদ্ধার করতে অচেনা শহরগুলোর দিকে৷

মেয়েটার বাড়ির গায়ে লাগা চা বাগানে কত বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ কত নতুন নতুন চা পাতার জন্ম হয়েছে৷ কত গাছ শুকিয়ে গেছে৷ কত পুরনো গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে৷ পাড়া থেকে কত মেয়ে কাজে চলে গেছে৷ ঘরে মাসকাবারি মাল শেষ হয়েছে৷ এই মেয়েকে ছাড়া ঘরের ভিতর দিনের পর দিন রাতের রাত পর রাত কেটে গেছে৷ বাড়ির লোক ভেবেছে আসবে ফিরে৷ আর কয়েক মাস…৷

—লোকাল এজেন্টের সাথে দেখা করেনি ওরা?
—‘আসলে এসব লোকাল এজেন্টকে এসব জায়গায় ম্যাক্সিমাম কেসে খুঁজেই পাওয়া যায় না৷ একবার কোনও সোর্স মারফত হয়ত মেয়েটার সাথে দেখা করে কাম দিয়েছিল তারপর সেইখানে আর তার দেখা নাই৷ ফোন চেঞ্জ সিম চেঞ্জ৷ আর যদি জান পাহেচানের মধ্যে হল তো এটা সেটা বলে পেরেন্টসকে বুঝায়ে ভাগায়ে দেয়৷ কিছু টাকাও হয়ত দিয়া দিল৷ ব্যাস গায়েব হয়ে গেল৷ আর ম্যাক্সিমাম এজেন্ট লোকাল না৷ ম্যাক্সিমাম নেপালের ঝাড়খন্ড বিহারের৷’
রেডলাইট এরিয়া থেকে আস্ত একেকটি মেয়েকে রঙ্গুর দুঃসাহসিকভাবে বার করে আনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তখন মাথায় ঘরাঘুরি করছে৷

রঙ্গু বলে চলেছেন— ‘মিসিং মেয়েটাকে অনেক প্ল্যানিং করে খুঁজতে হয়৷ রেডলাইট এরিয়াতে গেলাম, ফটো দেখালাম আর মালিক এসে দিয়া দিল মেয়েটাকে, তেমন তো হয় না৷ ক্লু দিয়া দিয়া আস্তে আস্তে খুঁজে বার করতে হয় কি কোন রেড লাইট এরিয়াতে মেয়েটা সেল হয়েছে৷ তাও এখানে বসে বসে কনফার্ম খবর পাওয়া খুব ডিফিকাল্ট৷ আগে এখানে খোঁজ খবর নিয়ে স্পটে রিচ করে গিয়ে সব ডিটেইলস্টা তো জানতে হয়৷ তারপর অপারেশন চালাইতে হয়৷ আমার গ্রুপের ছেলেদের প্রথমে পাঠাই কাস্টোমার সাজায়ে৷ কিন্ত্ত প্রবলেম যেটা আমার এখানের ছেলেরা সব মঙ্গোলিয়ান ফেসের৷ মঙ্গোলিয়ান ফেসের ছেলেদের বুধওয়ারপেটে এলাউ করতে চায় না৷’

—কেন? কী প্রবলেম?
—‘কেন কি মঙ্গোলিয়ান ফেসের ছেলেরা একটু কাইন্ড হার্টেড হয় কিনা জানিনা! ওইসব রেড লাইট এরিয়াতে এতো এখানকার মেয়েগুলা আছে, একজন মঙ্গোলিয়ান ছেলে একটা মঙ্গোলিয়ান ফেসের মেয়েকে দেখলে কাইন্ড হার্টেড হয়ে যায়৷ তার খবর বাইরে এসে দিয়ে দেয়৷ কি মেয়েটা রিকোয়েস্ট করে যাতে ছেলেটা রেসকিউ করে বাইরে নিয়ে আসে৷ এরকম বলে অনেক হয়েছে কি এরকম মঙ্গোলিয়ান ছেলে গেল আর কোনও মঙ্গোলিয়ান ফেসের মেয়েকে বার করে নিয়ে এলো কায়দা করে৷ তাই ওরা খুব সন্দেহ করে মঙ্গোলিয়ান ফেসের ছেলে দেখলে৷ আমি কি করি ওই রেড লাইট এরিয়াতে যারা ডেইলি কাস্টোমার এরকম লোকাল ছেলেদের ওখানে গিয়ে হায়ার করে নেই৷’

—তার মানে আপনাকে তো কিছুদিন আগেই পৌঁছাতে হয়?
—‘হ্যাঁ, বললাম না এটা তো এমন প্রসেস না যে যাবো আর মেয়েটা কোথায় সব জানা থাকবে আর তুলে নিয়ে চলে আসব৷ গিয়ে নিয়ার-বাই কোনও হোটেলে উঠি আমরা৷ সেইখানে থেকে আস্তে আস্তে কাস্টোমার ঢুকায়ে আমরা খবর নিয়ে নেই কি মেয়েটা সাচমুচ ওই রেড লাইট এরিয়াতে আছে কিনা! যাকে পাঠাচ্ছি তাকে মেয়েটার ফোটো চিনায়ে দেই৷ আমার ছেলেদের যদি পাঠাই একটু অন্য রকম সাজায়ে পাঠাই৷’
—কীরকম সাজান?
—‘একটু মোটা গোঁফ লাগায়ে দিলাম৷ একটু দাড়ি লাগায়ে দিলাম৷ হ্যাট পরায় দিলাম মাথায়৷ ছেলেদের দিয়ে খবর আনতে তিন দিন চারদিন অনেক সময় বেশি দিনও লাগে৷ কেন কি যখন ঢুকছে আমার ছেলে তখন হয়ত মেয়েটা কোনও রুমে কাস্টোমার এটেন্ড করছিল৷ দেখাই হল না৷ তো ফিরে এলো৷ আবার দুসরে দিন ট্রাই করল৷’
—এই মেয়েটার বেলা একবারে খবর পেয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটি বুধোয়ারপেটেই আছে?
—‘না না৷ সেবার পুনে গিয়েছিলাম অন্য একটা মেয়েকে রেসকিউ করতে৷’
—সেই মেয়ে কোথাকার?
—‘গরুবাথানের মেয়ে ছিল সেটা৷ খবর পেয়ে গেছিলাম মেয়েটা ওখানে আছে৷ সব ডেটা কনফার্ম হয়ে নিয়ে অপারেশন করতে হয়৷ সেই সব জেনে নিয়ে মেয়েটার ফেস আইডেন্টিফাই করে বার করে নিয়ে আসতে হয়৷ আর পুলিশ শুধু সাপোর্ট দেবে৷ পুলিশের আর্মস আছে৷ তো সেদিন সন্ধ্যাবেলা ঢুকছি অপারেশন চালাইতে৷’
—কীভাবে ঢুকলেন?
—‘ওখানকার পুলিশ ছিল৷ আমি মাঝখানে৷’
—এরকম রেড লাইট এরিয়াতে এলাউ করে কোনও মহিলাকে?
—‘আমি তো মেয়েদের মতো সেজে যাই না, না! প্যান্ট সার্ট টুপি জ্যাকেটটার মতো গায়ে থাকে৷’
—আর চুলগুলো?
—‘চুল তো এতোদিন ছোট ছিল৷ বয়েজ কাট করে কাটা ছিল৷ এখন ইদানিং একটু বড় হয়েছে৷’
বলে চলেছেন রঙ্গু সেই রেসকিউ অপারেশনের কথা৷ রেড লাইট এরিয়ার সিঁড়ি৷ সিঁড়ি থেকে কোনও ঘর৷ ঢুকে পড়ছেন কোনও এক মেয়েকে বার করে এনে বাড়িতে পৌছে দিতে৷

গা টা শিউরে উঠছে৷ অন্ধকার হয়ে এসেছে বাইরে৷ পুলিশের টিম৷ মাঝে রঙ্গু৷ ওয়েটিং রুমে বসে আছে মেয়েগুলো৷ গায়ে মিনি স্কার্ট৷ ছোট ছোট টপ৷ শরীরের অনেকখানি অংশ বাইরে৷ আঢাকা৷ চোখে কাজল৷ মুখে চড়া করে মেক আপ৷ চুল আঁচড়ানোর কায়দাগুলো নানারকম৷ কাস্টমার ঢুকছে পরপর৷ সন্ধের মেজাজ৷ ওয়েটিংরুমে ‘চয়েস’ হচ্ছে মেয়েদের৷ রুমে নিয়ে ঢুকে পড়ছে একে একে৷ কেউ রুম থেকে বেরিয়ে আসছে৷ এর মধ্যে একটা দল ঢুকছে ভেতরে৷ বেশ স্পিড৷ আচমকা একদম ভেতরে ঢুকে পড়েছে দলটা৷ ওয়েটিং রুম ক্রস করতে গিয়ে হঠাৎ একটা মুখ চোখে পড়ে গেল মাঝের জ্যাকেট পরা লম্বা চওড়া মানুষটার৷ তারপরেই হনহন করে হাঁটা লাগাচ্ছে ওখান থেকে৷ কোন রুমে যেন আছে গরুবাথানের মেয়েটা সিগনালে জানিয়েছিল ওর সঙ্গের ছেলেরা৷ পৌঁছে গেল সেই রুম অবধি৷ লাথি দিল দরজায়৷ হাট হয়ে খুলে গেল দরজা৷ ভীষণ রকম অস্বস্তিকর দৃশ্য৷ কিচ্ছু করার নেই৷ মেয়েটার ফেস আইডেন্টিফাই করতে হবে৷ মিলে গেলে বার করে নিয়ে আসতে হবে৷ হ্যাঁ খবর ঠিক৷ সেই গরুবাথানের মেয়েটা৷ হ্যাঁ ফেসে মিল আছে৷ টেনে বার করে নিয়ে আসছে মেয়েটাকে৷

জিজ্ঞাসা করলাম— এভাবে ঢুকতে গিয়ে কোনও দিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েননি?
—‘হ্যাঁ৷ হোতো৷ প্রথম প্রথম খুব লজ্জা করত৷ সঙ্গে পুলিশগুলা ছেলে৷ রুমে ঢুকে মেয়েটাকে কি অবস্থায় দেখব জানি না৷ দেখেওছি কয়েকবার খুব খারাব অবস্থায়৷ কিন্ত্ত আস্তে আস্তে ভাবলাম আমি যদি লজ্জাটা পাই তাহলে রেসকিউ করবে কে? মেয়েটাকে রেসকিউ তো করতে হবে৷ তো সেই সব ভেবে আর লজ্জা করি নাই পরে৷’
গরুবাথানের মেয়েটা হাতে ধরা৷ ওয়েটিং হলে সেই মঙ্গোলিয়ান ফেসের চেনা চেনা মেয়েটা এখনও বসা৷ একদম কাছে চলে গেল৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তোমার বাড়ি কোথায়?
উলটো দিক থেকে কোনও উত্তর নেই৷ চুপ৷
আবার জিজ্ঞাসা একই প্রশ্ন, না এবারেও উত্তর নেই৷ হাতে ধরা গরুবাথানের মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল, এই দেখো এই মেয়েটাও পাহাড়ের, ওকে রেসকিউ করে নিয়ে যাচ্ছি৷ তাড়াতাড়ি বলো তোমার বাড়ি কোথায়? নাম কী?
এবার উলটো দিকের মেয়েটা মুখ খুলল, শিলিগুড়ি৷
—‘শিলিগুড়ি? শিলিগুড়ির কোথায়? ঠিক সে বোলো… ঠিক সে বোলো৷ দেখো আমার বাড়ি পাহাড়ে৷ পানিঘাটা৷ আমার নাম রঙ্গু সউরিয়া৷ এই মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেব৷ তোমার ফেসটা খুব চেনা চেনা লাগছে৷ জলদি বোলো…’
—‘তিরহানা৷’
—‘আসলে লেড়কিটার যে ফটোটা আমার কাছে ছিল সেটা অনেকটা আগের ছবি৷ তখন অনেক ছোটো৷ প্রথম সন্দেহ হয় মঙ্গোলিয়ান ফেস দেখে৷ তখনই মনে হল হতে পারে মেয়েটা আমার কোনও কেস৷ তখনও আমার ফাইলের ফেসটা পুরো মনে করতে পারছি না৷ ওকে আরও প্রশ্ন করে চলেছি৷ ঠিক করে বলো তোমার এড্রেস৷ লেড়কিটা খুব ভয়ে পেয়ে গেছে৷ কথা বলতে চাইছে না৷ তোমাকে ছাড়ায়ে নিয়ে যাবো চলো আমার সাথে৷ এই দেখো আমার সাথে পুলিশ আছে৷ তাড়াতাড়ি চলো৷’

মেয়েটার হাতটা ধরে নিল শক্ত হাতটা৷ শক্ত করে ধরে নিয়ে হনহন করে হাঁটছেন৷ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে পা হাত৷ পুরো শরীরখানা৷ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? ওয়েটিং হল থেকে সিঁড়ি৷ সিঁড়ি থেকে গেটের দিকে৷ রোড৷ একদম বাইরে৷ রাতের খোলা আকাশ৷ ভয়৷ এরা কারা? কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবার?
একবার দিল্লির বাড়ি, দিল্লির বাড়ি থেকে জিবি রোড৷ জিবি রোড থেকে বুধওয়ারপেট৷ অনেকবার এর আগে ঠগেছে৷ হাত বদল হয়েছে না! তাই লেড়কিটা খুব ভয়ে পেয়ে গেছিল৷

গাড়িতে উঠিয়ে নিল দলটা৷ গাড়ি এসে থামল থানায়৷ রঙ্গু ফোন করে চলেছে নকশালবাড়ি থানায়৷ ফাইল থেকে খুঁজে বার করছে মেয়েটার ছবি৷ অ্যাড্রেস৷ নকশালবাড়ি থানায় লোকাল পুলিশ নিয়ে এসেছে তার বাবাকে৷ মেয়েটিকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছেন রঙ্গু৷ চা বাগানের পাশের থানায় একটা কাঁপা কাঁপা বৃদ্ধ গলা থেকে শব্দ বেরোচ্ছে, হ্যালো… হ্যালো…
একটা বড়সড় নিঃশ্বাস পড়ল ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া পাঁজরের ভেতর…৷ (ক্রমশ)