মঞ্জীরা সাহা
যে মেয়েটির কথা দিয়ে গল্পটির সূত্রপাত তার বয়স তখন বারো তেরো হবে৷ ফাইভে না সিক্সে পড়ে৷ এরকম রোগা তামাটে চুলের মেয়ে এ ইস্কুলে অনেক আছে৷ নামটাও অনেকের সঙ্গে একই৷ নাম চেহারা আরও অনেকের সঙ্গে গুলিয়ে যেত৷ অংকের ক্লাস চলছে তখন৷ দেখি মেয়েটি খাতার উপর মুখ গুঁজে রেখে একটা কেমন গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে চলেছে৷ চলছিল লাভ ক্ষতির অংক৷ কতোতে কতো লাভ আর কতোতে কতো ক্ষতি এ হিসেবের মাঝে ওর গোঁ-গোঁ আওয়াজটা ক্লাসরুমে কেমন একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার তৈরি করছিল৷ দু-একবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম৷ উত্তর নেই৷ কেবল গোঙানি৷ আওয়াজটা ক্রমে এতো বেড়ে চলেছিল যে লাভ ক্ষতির কতোতে কতো লাভ আমারই সব গুলিয়ে যাচ্ছিল৷
বিরক্ত হয়ে উঠলাম৷ ততক্ষণে লাভ ক্ষতি সব গুলিয়ে পুরো ক্লাসে হৈ-হৈ শুরু হয়ে গেছে৷ অংক ক্লাসের ভয়-ভীতি লাটে উঠে সবাই সবার মতো বলে চলেছে৷ কী যে সব বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না৷ কিছুতেই ওকে দাঁড় করানো সম্ভব হলো না৷ অন্য একটি মেয়েকে দিয়ে ওকে বেঞ্চ থেকে টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলল৷ যে মেয়েটির গল্প হচ্ছে তার নাম গোলাপি খাতুন৷ এ নাম ওর ক্লাসেই গোটা চার মেয়ের৷ উঠে দাঁড়ালো অনেক ঠেলাঠেলির পর৷ মুখের চেহারাটা অন্য রকম দেখাচ্ছে৷ ঝুটি বাঁধা চুল থেকে গোছা গোছা চুল বাইরে৷ পুরো চেহারাটাই কীরকম এলোমেলো৷ ঘামে ছোপ ছোপ ভেজা সাদা সার্টের ভেতর থেকে ছাপা ছাপা টেপজামাটা ফুটে উঠেছে৷ রোগা কালো শুকনো মুখে চোখের জলে নাকের জলে একেবারে মাখামাখি৷ চোখদুটো অসম্ভব রকম ঘোলা ওর৷ সেই ঘোলাটে চোখদুটো লালচে হয়ে ফুলে উঠেছে৷ মুখ থেকে লালা পড়ে অংক খাতার লাভ-ক্ষতির সংখ্যাগুলো ভিজে থেবড়ে গেছে৷
গা গুলিয়ে উঠল দেখে৷ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? এরকম করছিস কেন? কেঁদে কেঁদে পুরো ক্লাসটা নষ্ট করে দিচ্ছিস৷ পরীক্ষায় লাভ-ক্ষতির অঙ্ক এলে কী করবি? এই রকম কাঁদবি পরীক্ষার হলে বসে? কী হবে কেঁদে তখন?
কথাগুলো বলতে গিয়ে ভ্রু-দুটো কুঁচকে গেল আমার৷
ওর মাথাটা আরও কিছুটা ঝুঁকে গেল৷ এক চোখ ডান হাত দিয়ে মুছে নিয়ে বলল, আমরা আর এইখানে থাকবো না৷ চলে যাবো৷ চোখদুটো কচলাতে শুরু করল৷
—কোথায় যাবি? কেন যাবি? এই স্কুলে আর পড়বি না?
—কাল রাত্তির বেলা বাবা আরেকটা মেয়েছেলেকে নিয়ে এসেছে৷ বৌটা সকালবেলা বলে কি আমাদের আর থাকতে দেবে না৷ আমাকে, আমার মাকে আর বোনকে৷ বলে, মাগীরা ভাগ আমার বাড়ি থেকে৷
নিকা করে এনেছে তো আমার বাবা ওই বৌটাকে৷ ওইটারও একটা মেয়ে আছে৷ আমার চেয়ে একটু ছোটো৷
এরকম অদ্ভুত একটা কথা কোনও এক ছাত্রীর মুখে এরকম কোনও স্কুল বিল্ডিঙের ক্লাস রুমে ঘরভর্তি স্টুডেন্ট বই খাতা বোর্ড চকের মাঝে গম্ভীর দিদিমণি অবস্থায় যে কোনোদিন শুনতে হবে কল্পনাও করিনি৷ প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম৷ ওখানে দাঁড়িয়ে ওকে সান্ত্বনা দেব নাকি সুদ কষার অঙ্ক করব সব তাল গোল পাকিয়ে গেল৷ ভাবছি, কী করতে যে ওর কাছে জানতে চাইলাম! জিজ্ঞাসা করেই ভুল করে বসলাম৷ আবার পুরো ঘটনাটা জানার কৌতূহলও চাপতে পারছি না৷
এসব যখন ভাবছি চারিদিক থেকে মেয়েদের গলায় ইসসস… ই মা… ফিস ফাস শব্দ আসছে কানে৷ খিলখিল… ফিকফিক… জোরে আস্তে হাসির আওয়াজ৷
সকলকে একটু রাগ দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, তোর মা সত্যি চলে যাবে নাকি?
মেয়েটি সে প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, কাল রাতে ওই বৌটা ঘরে ঢুকেই মাকে কী খিস্তি! মাও খিস্তি দিয়েছে ওর বাপের নাম তুলে৷ আমরা চিনি তো ওর বাপটাকে৷ ওই বড়ুই পাড়ায় বৌটার বাপের বাড়ি৷
এসব বলতে গিয়ে একটু আগের কান্না মেশানো গলার স্বর কেমন বদলে গেল৷ গলা খাঁকরে নিয়ে জোর কদমে শুরু করল বলা৷ আস্তে আস্তে গলার স্বরে কাঁদো কাঁদো সুর মিলিয়ে যেতে লাগল৷
ঝুঁকে পড়া মাথাটা এবার পুরোটা উঁচু হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ গলার স্বর চড়তে শুরু করল আরও৷
চোখের জল গালের উপর শুকিয়ে গিয়ে গাল দুটোর ওপর চ্যাটচ্যাটে কাদাটে আস্তরণ পড়ে গেছে ততক্ষণে৷ দু’হাত দিয়ে ওর ঢিলে হয়ে যাওয়া কোঁকড়া চুলের ঝঁুটি থেকে গার্ডারটা খুলে সজোরে চুলগুলো এক হাতে চেপে নিয়ে অন্য হাতে গার্ডারটা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিতে নিতে বলল, আমরা ওর আগের বরটাকেও চিনি৷ ওই তো স্টেশনের পাশের দোকানটায় সাইকেল সারায়৷
আমার মাও দিয়েছে ওর চুলের মুঠি ধরে টান৷ ও মেরেছে মার পিঠে ক’টা কিল৷ আমার মাকে যখন পেটাচ্ছিল আমিও দিয়েছি ওর পিঠে ক’টা৷ আমার বাবা মাকে মাটিতে ফেলে লাথি মেরেছে৷ মাও বৌটাকে উলটে দুটো কিল দিয়েছে পিঠে৷
তারপরের দু-চার দিন গোলাপির দেখা নেই৷ সারা সপ্তাহ স্কুল কামাই৷ তারপর আবার দেখা গেল ওকে৷ কয়েক মাস পর আবার মনে পড়ে গেল একদিন৷ সেদিন কন্যাশ্রীর ফর্ম জমা নিচ্ছি৷ মেয়েটি লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে৷ ওকে দেখেই কেন যেন মনে পড়তে শুরু করেছিল সেই ওর কান্নাকাটি, ওর রাগ, ওর সেইসব কথাগুলো৷ মনের মধ্যে তখন অনেক প্রশ্ন৷
কোথায় থাকে এখন? বাসা কি বদল হয়ে গেল? ওদের ওই বাসার মানুষগুলো কি বদলে গেল? সেইদিনের পর ওকে খেলার মাঠে অঙ্কের ক্লাসে জলের কলপারে যেখানেই দেখেছি বারবার মনের মধ্যে ওই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে থাকত৷
আর কখনও প্রশ্নগুলো করতে পারিনি৷ উত্তরে কী শুনব? যা শুনব সেরকম রাখঢাক ছাড়া কোনো ঘটনার বিবরণ শুনতে আমি অভ্যস্থ কি? রাগ ঝাল তার সঙ্গে আরও কিছু বাইরে বেরিয়ে আসবে আবার৷ কোনো আড়াল নেই৷ ওদের বাড়ির ভিতরের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো হাট হয়ে খুলে যাবে আবার সকলের সামনে৷ যে কথাগুলো উত্তরে শুনব শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে শপিংমলে এরকম রাখঢাক ছাড়া কথা আমি শুনছি কি কোনোদিন? আমার আশপাশের মানুষগুলোর সুখী সুখী জীবনগুলোর অন্তরালে যেসব অন্ধকারের গোপন কথা থাকে সেগুলো এভাবে কোনোদিন শুনেছি সরাসরি? সেই আগাম অস্বস্তির ভয়ে আর জানতে চাইনি৷
ওর কন্যাশ্রীর ফর্ম হাতে তুলে নিয়ে প্রথমেই ঠিকানার দিকে চোখ চলে গেল৷
হঁ্যা৷ ঠিকানায় সেই একই পাড়ার নাম৷ বড়ুই পাড়া৷ বদলায়নি কিছু৷ একই ঠিকানা৷
সুদ কষার অঙ্ক না শিখেই হাসতে হাসতে ও পরপর তিন-চারটে ক্লাস উঠেও গেল চোখের সামনে৷ আর কোনোদিন সুদ কষার অঙ্ক শিখেছিল কিনা জানা হয়নি৷ তবে ওকে কোনোদিনও আর কাঁদতে দেখিনি৷ মেয়েদের ভিড়ে তারপর থেকে ওর সেই ক্লাসরুমের কথাগুলো আর আমার মনেও পড়েনি বিশেষ৷
শেষ যেদিন ওকে স্কুলে দেখেছিলাম একটা স্লিভলেস ছাপা চুড়িদার পরে দাঁড়িয়ে ছিল স্কুলের করিডরে৷ মেয়েটি তখন ইলেভেনের ছাত্রী৷ সেই ওর ফাইভ সিক্সে পড়ার সময়ের আঁশ ওঠা তামাটে রঙের এলোমেলো চুলগুলো তখন আর তেমন নেই৷ সেই আঁশটে চুলগুলি ব্রাউন কালার করা৷ লক্স কেটে সামনে ঝোলানো৷ রোগা মুখ আর রোগা নেই, বেশ ভরাট৷ চোখের সেই রাগটাও কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে৷ গোলাপি আড়চোখে ফিকফিক করে হেসে যাচ্ছিল কোনো ছেলেকে যেন দেখে৷ কোনো একটা ফর্ম ফিলাপ করতে এসেছিল সেদিন বান্ধবীদের সঙ্গে৷
একটি ছাত্রীর সঙ্গে চলেছিলাম৷ সম্ভবত টাটকা সবজি কিনতে৷ ভ্যানটি ওদের পাড়া ক্রস করছে তখন৷ ওদেরই ক্লাসের একটি মেয়ে আমার সঙ্গী৷ আমার পাশে বসে ফিকফিক করে দেখি হাসছে৷ বুঝতে পারছি না হাসির কারণ কী৷ হঠাৎ আঙুল তুলে দেখাচ্ছে একটি বাড়ি৷ বাড়িটি যে গোলাপিদের সেকথা বলেই আবার ফিকফিক করে হাসি৷ বেশ কিছু বছর আগেও একবার এসেছিলাম এদিকে৷ কী কারণে যেন এসেছিলাম! না! মনে পড়ছে না কী কারণে যে এসেছিলাম৷ সেই আগের বারই গোলাপিকে দেখেছিলাম বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে৷ টিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গোটা আম খাবলে ধরে খাচ্ছিল৷ হাতে মুখে আমের রসে মাখামাখি৷ তখন ওদের সেই কয়েক বছর আগে যেমন ছিল এখন বদলায়নি৷ মাঝের কতগুলো বছর কেটে গেছে৷ বাড়িটি আকারে আয়তনে বদলায়নি একটুও৷ টিনের দেয়াল৷ মাথাটাও টিনের৷ দেয়ালগুলো তেলের টিনের ড্রাম পিটিয়ে পিটিয়ে সোজা করে তৈরি৷ মনে পড়ছে দূর থকেই তেলের ড্রামের গণেশ সূর্য হাতি মার্কা ছবিগুলো দেখা যাচ্ছিল সেবার৷ রঙিন রঙিন ছাপা ছবি সব মিলিয়ে গেছে এখন৷ সব একইরকম দেখতে লাগছে৷ শুধু জং৷ ঘন জংয়ের আস্তরণ সবটাকে ঢেকে দিয়েছে৷ দু’চালার একটি চওড়া ঘর৷ সামনে একটি বেড়া দেওয়া দু’দিক ঢাকা রান্নার যায়গা৷ আগের মতোই৷ শুধু বেড়ার রং গেছে বদলে৷ খুব সম্ভবত বেড়ার ওপারে রান্না হয়৷ বেড়ার বাঁশের রং উনোনের ধোঁয়ায় কালো মিশমিশে হয়ে গেছে৷ আরও অনেক কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে নীচ দিয়ে৷ বেড়ার নীচের অংশ অনেকখানি গেছে ক্ষয়ে৷ ভেতরে আড়ালে আবডালে থাকা জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে রাস্তা থেকেই৷ হাঁড়ি কড়াই খুন্তি সরষের তেলের শিশি ফুলকপি বেগুন৷ সঙ্গে কোনও এক মহিলার হাঁটু অব্দি শাড়ি তোলা পা দু’খানা৷
আমাকে যে মেয়েটি পথ চিনিয়ে নিয়ে চলেছে ওদের ক্লাসেরই ছাত্রী৷ আমাদের ভ্যান যখন ওদের বাড়ির রাস্তা ছেড়ে গিয়ে পরের মোড়ে উঠেছে পাশের মেয়েটি শুরু করলো বলা৷ এবার কথা বলার সুর খানিক বদলেছে৷ যেন বেশ বড়সড় এক গল্পের শুরু করতে চলেছে৷ প্রথমে বেশ কিছুটা ভূমিকা৷ তারপর যেন মূল গল্প৷ গল্পের নায়িকা এই শ্রোতাটির বেশ চেনা বলেই বোধ হয় বক্তার গল্প বলায় এতো আগ্রহ৷
—জানেন ম্যাডাম, গোলাপিদের বাড়ি আমরা কেউ যাই না৷ দাদা একদম মানা করেছে ওদের বাড়ি ঢুকতে৷ আমার মাও মানা করেছে৷ বাড়ির লোকেরা চোখ গরম করে বলে, ওই বাড়ি গেলে খারাপ হয়ে যাবি৷
হঠাৎ এমন এক ভূমিকা শুরু হওয়ায় আমার পক্ষে এ গল্পের শুরুটা বোঝা বেশ কঠিন হলো৷ কারণটা অনুমান করলাম৷ ভাবলাম বোধ হয় গোলাপির বাবা হামিদুল এক স্ত্রী থাকতে আরেক স্ত্রীকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছিল বলেই বোধ হয় এই মেয়েটির বাড়ির আপত্তি এই বাড়িতে আসতে দিতে৷ কিন্ত্ত এ অনুমানে খুব বেশি সময়ে চুপচাপ শ্রোতা হিসেবে না থেকে কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, কেন রে? আসতে দেয় না কেন? ওর বাবার দুটো বৌ বলে?
আমার কথাটা শুনে আবার সেই কিছুক্ষণ আগের হাসি ফিরে এলো মেয়েটির মুখে৷ খিকখিক আওয়াজ করে হাসতে হাসতেই বলে চলল, এই রকম এইখানে হয় ম্যাডাম৷ এইখানে অনেকেই দুই বৌ নিয়ে ঘর করে৷ থেমেই আবার খানিক হেসে নিয়ে, তাতে কী? মিলেমিশে থাকে, ঝগড়া অশান্তিও হয়, মারপিট করে, বৌকে পেটায়, চুলের মুঠি ধরে টান মারে, খিস্তি খামারি দেয়, আবার একঘরেই থাকে৷ এরকম কত্ত ঘর আছে এইখানে, দুইখানা করে বৌ৷ কত্ত ঘরে কত্ত ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি৷ কিন্ত্ত এই বাড়িটাতে তো অন্য ব্যাপার ম্যাডাম৷
বলেই মেয়েটা খানিক চুপ৷ জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার?
ওদের ঘরে অনেক ব্যাটাছেলে ঢোকে ম্যাডাম৷ এই পাড়ার পিছনেই তো ক্যাম্প ম্যাডাম৷ বিএসএফ ক্যাম্প৷ তার পিছনেই বর্ডার না!
একথা বলার আগেই বর্ডার রোডে এসে উঠে পড়েছে আমাদের ভ্যান৷ মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে বলতে শুরু করল, ওই দেখেন ম্যাডাম, ওই আম বাগানটার পিছনেই তো ক্যাম্প৷ দেখতে পাচ্ছেন? পেছন ঘুরে যা যতটুকু চোখে পড়ল আম বাগানের ফাঁক দিয়ে একখানা হলুদ বাড়ির দেয়াল৷ ভ্যান চলতে চলতে আবার ঢাকা পড়ে গেল সব৷ শুনলাম ওর মুখে ওটাই বিএসএফ ক্যাম্প৷ ও বলে চলল একনাগাড়ে৷
এই ক্যাম্পের সামনেটাই তো ওদের পাড়া৷ দেখলেন না! এই পেছন দিয়ে ক্যাম্পের সব বিএসএফ-গুলো বলে ঢোকে ওদের বাড়ি৷ রাতের বেলা ঢোকে ম্যাডাম৷ ওর বাবারে আমরা হাসিবুল চাচা বলে ডাকতাম৷ ওই চাচা তো এই তিন না চার বছর হল কাতার চলে গেছে৷ সেন্টারিং এর কাজে গেছে শুনেছি৷ আগে ইরাক গেছিল৷ এখন বলে আর ইরাক থাকে না৷ ওইখান থেকে অন্য কোন দেশে বলে কাজ করাতে নিয়ে গেছে৷ পাড়ার মানুষের কাছে শুনেছি৷ জানি না৷ ওই এখানেও তো জন-খাটার কাজ করত৷ ওই দেশে গিয়ে ওই সিমেন্ট বালির মিস্ত্রি সেন্টারিংয়ের কাজের জন খাটে শুনতাম আগে৷ ছোটো বৌটার পেটে যখন চার পাঁচ মাসের বাচ্চা তখনই চলে গেছে৷ প্রথম কয় বছর টাকা পয়সা বলে পাঠাতো৷ এখন আর খোঁজ নেই৷ টাকাও পাঠায় না, ফোনও করে না বলে৷ কি জানি বেঁচে আছে না মরে গেছে! একবার এসেছিল৷ আর তো কোনোদিন আসেওনি৷
ভ্যান চলছে তখনও৷ সব কিছু শুনে কীরকম থমকে বসে আছি আমি৷ এক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীর মুখ থেকে যে গল্প শুনছি এমন কোনো গল্প শুনব এরকম আদৌ কল্পনা করতে পারতাম যদি এই সীমান্ত এলাকায় চাকরি করতে না এসে পড়তাম! বিস্ময়টা এরপর এই কিশোরীর থেকে অন্য দিকে গিয়ে পড়ল৷ যাদের নিয়ে এই সত্য গল্পটি শুনছি বিস্ময়টা এবার সেই গল্পের মুখ্য-গৌণ চরিত্রগুলির দিকে সাঁ-সাঁ করে রওনা দিল৷ ভাবলাম, যে হাসিবুলকে নিয়ে দুই যুবতীর মধ্যে ওই টিনের চালার নিচের ঘরখানা একদিন রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সেই হাসিবুলই এখন সেই ঘর থেকেই বিদায় নিয়েছে৷ হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে উঠল৷ জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে ওই বাড়িতে থাকে কারা এখন?
উত্তর দেওয়ার আগে মুখটা হাসিতে ভরে উঠল৷ তারপর হাসিমুখেই খুব উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল, সবাই৷ সবাই ওই বাড়িতেই থাকে৷ হাতটা মুখের কাছে তুলে নিয়ে হঠাৎ মুখটা একটু গম্ভীর করে নিয়ে কর গুনতে গুনতে বলে চলল, বড় ঘরের ওরা দুই বোন, বড় চাচি, ছোটোটার দুটো, আগের পক্ষের ওই বড় মেয়েটা আর এ বাড়িতে এসে ছোটো বৌটার আর একটা মেয়ে হয়েছে৷ সব কয়জন তো ওই ঘরটাতেই থাকে৷
—আর ঝামেলা হয় না আগের মতো? সেই যে গোলাপি বলেছিল, চুলের মুঠি ধরে মারামারি হয়েছিল৷ ওরকম হয় না আর? তোরা শুনতে পাস না আর ওদের ঝামেলা?
মেয়েটি এ প্রশ্নে আবার হেসে ফেলল৷ বলল, গালাগালি মারপিট এসব? এমন ভাবে উলটে আমাকেই প্রশ্ন করতে লাগল যেন আমি হঠাৎ কী একটা অবুঝের মতো প্রশ্ন করে ফেলেছি৷
তা হয় না? এখনও হয়৷ মাঝেমাঝেই হয়৷ হঁ্যা তাই বলে আগের মতো রোজ রোজ ঝগড়া ঝামেলা হয় না৷ এখন এই রকম কি কেউ একটু ডাল বেশি খেয়ে নিল, কি কেউ একেবারে হাঁড়ি উবুড় করে ভাত খেয়ে নিল তখন হয়৷ জোর হয়৷ বৌগুলো ঝগড়া করে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে৷ মেয়েগুলো কি খিস্তি মারে! কাঁচা খিস্তি একেবারে৷ আর যা করে না ওরা! ওই ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে দেখলেন না সরু গলিটা, ওটাই তো বর্ডার রোডে উঠেছে৷ ওই গলিটা যেখানে রোডে উঠেছে ওইখানটাতেই তো ওই বিএসএফ ক্যাম্প৷ দেখলেন না! ওই ক্যাম্পে বড় চাচি ছোটো বৌটা দুধ বেচতে যায়৷ এখন গরু পোষে তো একটা৷ ঘরের পিছনেই গরুটা ছিল৷ দেখেন নাই আপনি৷ শীতকালে ওপার থেকে বড় বৌটা গুড় আনে শুনেছি৷ ওই ক্যাম্পে গিয়ে গুড় বেচে আসে ক্যাম্পের ওই বিএসএফ গুলোকে৷ কিন্ত্ত কী বলেন তো যারা এপাশ দিয়ে সাইকেল করে, ভ্যানে করে যায় তারা সব বলে, বিএসএফ-এর এই লম্বা লম্বা লোকগুলি বলে রাতের বেলা এই বাড়িতে আসে৷ দুপুরবেলা মাঝেমাঝে আসে দুধ নিতে৷ এই বাড়িতে বলে খাওয়া দাওয়াও হয়৷ স্টেশনের পাশের বিলে এই বিকালবেলা বড় বড় শোল রুই ল্যাটা মাছ ওঠে৷ ভালো ভালো সাইজের মাছগুলো ওই ক্যাম্পের বাবুগুলো জেলেদের থেকে নিয়ে এ বাড়িতে চলে আসে৷ আবার মাংসও আনে শুনেছি৷ চাচিদের দিয়ে ভাজায়, মেয়েগুলোকে দিয়ে ভাজায়৷ আবার ওপারের ইলিশ বর্ডারে ধরা পড়লে সব এ বাড়িতে নিয়ে আসে৷ রান্না করে দেয় বৌগুলো৷ খায় দায় ঘরে বসে মজা তামাশা করে৷ আর যা হয় এই বাড়িতে শুনেছি৷ আবার ফিকফিক করে হেসে ফেলল৷ বলে চলল, এই সব নিয়ে পাড়ায় কতো লোকে কতো কথা বলে! হাসাহাসি করে! সবাই তো বলে এই করেই তো ওদের ওই অত্তগুলোর পেট চলে, জামাকাপড় জোটে৷ সবাই জানে এ কথা৷
ফেরার সময় আবার ওই টিনের ঘরটার দিকে চোখ গেল৷ তাকিয়ে মনে হল এই দোচালার তেলের ড্রামের তৈরি টিনের ঘরটা, একদিন এর নায়ক ছিল হামিদুল৷ একটু ঝুঁকে পড়া রোগা চেহারার মুখে একগাল কাঁচা পাকা দাড়ির হামিদুল৷ হামিদুল রহমানকে আমি দেখতাম আমাদের স্কুলের মাঠে৷ মানে যেখানে আমি চাকরি করি৷ লুঙ্গির উপর একটা লালচে হয়ে যাওয়া ফুটো ফুটো স্যান্ডো গেঞ্জি৷ ঝুঁকে পড়া পেটের উপর দিয়ে একটা গামছা আঁট করে বাঁধা৷ একমনে বিড়ি টানতে টানতে কুঁজো হয়ে বসে হেঁসো চালাতো৷ ইস্কুলে গজিয়ে ওঠা জংলা গাছ কাটার কাজ ছিল ওর৷ সারাদিনের হিসেব বুঝে নিয়ে বিকেলে চলে যেত৷ সেই হামিদুল রহমানকে নিয়ে কতগুলো মেয়েমানুষের মধ্যে ঝগড়া, চুলের মুঠি ধরে টানাটানি লাথালাথি কত কী ঘটে গেছিল এই দশ-বারো ফুটের ফুটো হওয়া টিনের চালটুকুর নীচে৷ কিন্ত্ত সেদিনের সেই ঝামেলা ঝগড়া মারামারি চুলোচুলি লাথালাথি আসলে কী নিয়ে ছিল? হামিদুলকে নিয়ে? নাকি খেজুর গাছের নীচের জংধরা ওই টিনের ঘরটাকে নিয়ে? ভেবে দেখিনি৷ এই গত পাঁচ বছরে একদিনও ভাবার ফুরসৎ হয়নি ওই গোলাপি, ওর বাবা হামিদুল, ওর মা, মা’র সতীন, তার মেয়ে, ওর নিজের বোন, ওদের ঝগড়া মারামারি, ওদের ওই তেলের ড্রাম দিয়ে তৈরি বাড়ি যে বাড়িতে থাকা নিয়ে ওর কান্নাকাটি, সে বাড়ি থাকলো না গেলো সেসব নিয়ে৷
এই টিনের দোচালার নীচে তেলের ড্রামের চার দেওয়ালের ভেতর হামিদুলের সংসার বা হামিদুলের বাড়ি৷ পাড়ায় সবাই এ নামেই চিনত বহুকাল ধরে৷ সেই সংসার এখনো আছে, কিন্ত্ত সেটা আর এখন হামিদুলের সংসার নয়৷ হামিদুল, এই প্রধান চরিত্রটির বিদায় হয়েছে অনেককাল আগেই৷ সেই কাতার থেকে টাকা আসা বন্ধ হওয়ার সময় থেকেই৷ এখন পাড়ায় আর হয়তো কেউ হামিদুলের বাড়ি বলে না৷ চালাটুকুর নীচের জায়গাটুকু নিয়ে এখন পাড়ার লোকের হাসাহাসি চলে৷ ওই চালের নীচের জায়গাটুকুতে যাওয়ার কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয় ভালো মেয়েদের উপর৷ এই টিনের ঘরের চালের নীচে এখন শুধু কতগুলো শরীর থাকে, রোগা মোটা বেঁটে লম্বা কালো ফর্সা অল্পবয়সী বেশিবয়সী মেয়ে শরীর৷ তারা একসঙ্গে রাঁধে একসঙ্গে খায়, মাছ ভাজে, ঝগড়া করে দুধ বেচে, একসঙ্গে খিস্তি মারে দর কষাকষি করে একসঙ্গে শোয়৷