শ্রীময়ী রায়
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩। ওইদিন আজীবন কবিতাযাপন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য আদম পত্রিকা ও প্রকাশনার পক্ষ থেকে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়ামে উত্তর-জীবনানন্দ যুগের অন্যতম প্রধান কবি জয় গোস্বামীকে জ্ঞাপন করা হয় আদমসম্মাননা ২০২৩। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি ঢাউস আকারের প্রামাণ্য সংখ্যা। আদম জয় গোস্বামী সংখ্যা। কিন্তু সত্যিই কি এর প্রয়োজন ছিল? আছে? এর উত্তরে সম্পাদক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, ‘এর উত্তর না, আবার হ্যাঁ-ও। না, তার কারণ, জয় গোস্বামী লেখালেখির শুরু থেকেই একজন খ্যাতিমান কবি। তিনি নানাভাবে নানা দিক থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আলোকিত হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন।
স্রোতের বিপরীতে থাকা একটি লিটল ম্যাগাজিন কেন এইরকম বহুল প্রচারিত একজন কবিকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে একটা সিরিয়াস সংখ্যা প্রকাশ করবে? আর হ্যাঁ বলার কারণ? জয় গোস্বামী একজন খ্যাতিমান কবি হলেও, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, তাঁকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত সম্ভবত সেরকম প্রামাণ্য কোনো কাজই হয়নি।’ ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ সম্পাদকীয়র শেষ অনুচ্ছেদে সম্পাদক নিজের অবস্থান আরও স্পষ্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আরও একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন, আমাদের পত্রিকার এই সংখ্যার আলোচ্য বিষয় কিন্তু কবি ও ভাবুক জয় গোস্বামী, ব্যক্তি জয় গোস্বামী নয়। ব্যক্তি জয় গোস্বামীকে নিয়ে যেমন অনেকের আবেগ রয়েছে, তেমনি কারো কারো সমস্যাও রয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে কেউ কেউ সমর্থন করেন না। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিভিন্ন সংকটের সময়ে নীরবতা পালনের দায় ও দায়িত্ব একান্তভাবেই তাঁরই, এর সঙ্গে পত্রিকার কোনো সম্পর্ক নেই।’
আলোচ্য সংখ্যাটিতে সবমিলিয়ে মোট দশটি বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগগুলোতে পৃথকভাবে আলোচিত হয়েছে জয় গোস্বামীর সৃজনের নানান দিক। প্রতিটি বিভাগের আগে রয়েছে সম্পাদকের প্রয়োজনীয় কথামুখ।
প্রথম বিভাগ ‘মুখচ্ছবি’তে রয়েছে রৌণক চৌধুরী, সুমন কবিরাজ, কৌশিক সরকার, অনুশ্রী দাস, সুজিত মণ্ডল প্রমুখ শিল্পীর আঁকা জয় গোস্বামীর মোট ১৪ টি পোট্রেট।
‘আলাপচারিতা’ বিভাগে রয়েছে চিরন্তন কুণ্ডু ও শুচিশ্রী রায়ের নেওয়া জয় গোস্বামীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। চিরন্তনের নেওয়া সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে জয়ের কবিতাভাবনার নানান প্রসঙ্গ। অপরপক্ষে শুচিশ্রী রায়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি পাঠ করে বোঝা যায় জয় রাগসংগীতের কতটা সমঝদার। শুচিশ্রীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের একজায়গায় জয় বলেছেন, ‘দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যাশিতের চমক আছে। তার সীমাও আছে। কিন্তু শিল্পের মধ্য দিয়ে যে যায় অজানার মধ্য দিয়ে যায় সে।’
পত্রিকার ‘ডাকবাক্স’ বিভাগে রয়েছে শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ভাস্কর চক্রবর্তীকে লেখা জয় গোস্বামীর যথাক্রমে ১২টি, ১টি ও ৩ চিঠি। জয়ের লেখা এই চিঠিগুলো নিছক চিঠি নয়, এগুলোতে পাওয়া যায় শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মতামত। নিজের নানারকম সংকটের কথাও এসেছে কোনো কোনো চিঠিতে। শঙ্খ ঘোষকে লেখা জয়ের ১২ টি চিঠির আগে শঙ্খ ঘোষের লেখা ছোট একটি গদ্যও রয়েছে। শ্যামকল্যাণ। শঙ্খ ঘোষকে লেখা একটি চিঠির এক অংশে জয় গোস্বামী লিখছেন: ‘এর ভেতর আপনার সঙ্গে বছরে সামান্য দু-একবার যে দেখা হয় তাতে মন অন্যভাবে দীপ্তি পায়। এমন একটা আনন্দ ঘিরে থাকে কয়েকদিন যার তুলনা অন্য কোথাও নেই।’
‘কবিতার জয়’ বিভাগে কবিতা সংগ্রহ-র প্রতিটি খণ্ড এক বা একাধিকবার আলোচিত তো হয়েইছে, পাশাপাশি পৃথকভাবে আলোচিত হয়েছে জয় গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের কবিতা। কবিতাসংগ্রহ-র বিভিন্ন খণ্ডগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন অভীক মজুমদার, সুমন গুণ, দেবজ্যোতি রায়, হিন্দোল ভট্টাচার্য, পার্থজিৎ চন্দ, পঙ্কজ চক্রবর্তী, তন্ময় ভট্টাচার্য এবং গৌতম মণ্ডল। কবিতাসংগ্ৰহ-প্রথম খণ্ড আলোচনা করতে গিয়ে গৌতম লিখেছেন, ‘জয় গোস্বামী এমন একজন কবি, যিনি নিজের তৈরি করা সিগনেচারের মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি, বেশিরভাগ কাব্যগ্রন্থে তিনি নিজেকে ভাঙতে চেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে, অস্বীকার করার উপায় নেই, এই দুরূহ কাজে তিনি সফলও হয়েছেন।’ দেবজ্যোতি রায় লিখেছেন, ‘জয় গোস্বামীর কবিচৈতন্য এক আশ্চর্য গ্রাহকযন্ত্র। নিজের সমগ্র জীবনের আলো-অন্ধকারের অভিজ্ঞতা তিনি কবিতায় গ্রহণ করেন। অন্য মানুষের জীবন, চারপাশের ঘটনাসমূহ, অন্তহীন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য, বিস্তার, বিস্ময় আত্মসাৎ করতে থাকে তাঁর কবিঅস্তিত্ব।’ জয় গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য কিছু কাব্যগ্রন্থ নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়, প্রসূন মজুমদার, হিমালয় জানা, প্রদীপ কর, উজ্জ্বল ঘোষ, পৌষালী চক্রবর্তী, জিৎ মুখোপাধ্যায়, অমৃতা ভট্টাচার্য, বর্ণালী কোলে প্রমুখ। জয়ের যে কাব্যগ্রন্থগুলি আলাদাভাবে আলোচিত হয়েছে সেগুলো হল ‘ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’, ‘প্রত্নজীব’, ‘আলেয়া হ্নদ’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা?’, ‘এক’, ‘বজ্রবিদ্যুৎভর্তি খাতা’, ‘সূর্য পোড়া ছাই’,
‘দু দণ্ড ফোয়ারামাত্র’, ‘প্রণাম’, ‘ঔরস’ প্রভৃতি। কবিতাসংগ্রহ-র ষষ্ঠ খণ্ডের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন রাহুল দাশগুপ্ত। জয় গোস্বামীর কবিতায় রতির প্রসঙ্গ নিয়ে একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন অভিরূপ মুখোপাধ্যায়।
‘জয়ের কথাসাহিত্য’ বিভাগে জয়ের লেখা উপন্যাস নিয়ে লিখেছেন তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃষ্ণা বসাক। জয় গোস্বামীর ছোটগল্প ও কাব্যোপন্যাস নিয়ে লিখেছেন যথাক্রমে সম্বিত বসু ও অঙ্কনা বেতাল।
কবিতা ও কথাসাহিত্যের পাশাপাশি জয় ‘গোসাইবাগান’, ‘রৌদ্রছায়ার সংকলন’, ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষে’ সহ অসাধারণ কিছু প্রবন্ধগ্ৰন্থ লিখেছেন। ‘ভাবুক জয়’ বিভাগে জয়ের প্রবন্ধসাহিত্য আলোচিত হয়েছে। ‘গোঁসাইবাগান’ নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন সুতপা মুখোপাধ্যায় ও রুবাইয়া জুঁই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে জয় গোস্বামীর লেখা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘আমার জীবনানন্দ’। গ্রন্থদুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন যথাক্রমে শম্পা ভট্টাচার্য ও মুহম্মদ মতিউল্লাহ। জয়ের সংগীতভাবনা ও ক্রিকেটমনস্কতা নিয়ে লিখেছেন শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী ও সব্যসাচী মজুমদার। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে অরিত্র স্যান্যল, কুন্তল মুখোপাধ্যায়, চন্দন বাঙ্গাল, নীলাঞ্জন দরিপা, তুষার বিশ্বাস প্রমুখের।
আদম-এর এই সংখ্যার দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে জয় গোস্বামীর যাবতীয় তথ্যপঞ্জি। শুরুতেই রয়েছে ‘জীবনপঞ্জী’। এই বিভাগে সন ও তারিখসহ কোন প্রকশনা থেকে কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তা তো রয়েছেই, আছে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদ। ‘গ্রন্থপঞ্জি’ বিভাগে রয়েছে প্রতিটি গ্রন্থের প্রকাশসাল, প্রকাশকের নাম ও ঠিকানা, প্রচ্ছদসহ যাবতীয় তথ্যপঞ্জি। রয়েছে প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি গ্রন্থের প্রচ্ছদপ্রতিলিপি। এবং পাশাপাশি রয়েছে দুর্লভ বেশ কিছু আলোকচিত্র। আলোকচিত্রের সঙ্গে রয়েছে পরিচিতিও।
সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনবর্জিত বিপুল আয়তনের এই প্রামাণ্য সংখ্যার চমৎকার একটি প্রচ্ছদ এঁকেছেন সুমন কবিরাজ।
আদম জয় গোস্বামী সংখ্যা।
সম্পাদক : গৌতম মণ্ডল।
প্রচ্ছদ : সুমন কবিরাজ।
৬৫০ টাকা।