ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের দুই মহাপুরুষ রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে রামমোহনের উত্তরসূরী হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় । একদিকে রামমোহন যেমন সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য আন্দোলন করে সফল হয়েছিলেন তেমনি অন্যদিকে বিধবা বিবাহ আইন চালু করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এই কারণেই তাকে রামমোহনের উত্তরসূরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে রামমোহন ছিলেন মূলত ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারক ও বিদ্যাসাগর ছিলেন সমাজ সংস্কারক। এই কথা বলছি তার কারণ “উনিশ শতকে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই সমাজ সংস্কার আন্দোলন প্রবাহিত হয়েছিল দুটি স্বতন্ত্র ধারায় তার একটি ছিল ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার, অন্যটি ছিলো ধর্মের প্রশ্নকে বাইরে রেখে অথবা এড়িয়ে গিয়ে সমাজ সংস্কার। রামমোহন ছিলেন প্রথম ধারার প্রবর্তক আর দ্বিতীয় ধারার প্রবর্তক ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীএবং পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ মুখপাত্র এবং সর্বপ্রধান চালিকাশক্তি।” এখানেই দুজনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান।
বিদ্যাসাগর বেদান্তকে ভ্রান্ত মনে করতেন এবং সে ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব থেকে দেশ ও সমাজকে মুক্ত করার জন্য তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আমরা জানি যে বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার আন্দোলন বৃহত্তর বাঙালি জীবনকে যেমন প্রভাবিত করতে পারেনি তেমনি এটাও সত্য যে তার সমাজ সংস্কার কোনো ধর্ম সংস্কারের আবর্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ তো থাকেইনি এবং রক্ষণশীলতার পথকে উন্মুক্তও করেনি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যবসায়িক সত্তাকে বোঝার জন্য তদানীন্তন বাংলার আর্থিক সামাজিক কাঠামোটিও একটু বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। উনিশ শতকীয় বাংলার আর্থিক কাঠামোকে আলোচনা করতে গেলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না । এই বন্দোবস্ত ছিল ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের স্বার্থে। তার সাথে যুক্ত বাঙালিরা এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিলেন নিজেদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য একমাত্র মই হিসাবে । কেউ কেউ ইংরেজ কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছিল আবার কেউ কেউ বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সবটাই ঘটেছিল মধ্য শ্রেণীকে ঘিরে। এখানে কৃষক বা নিম্নবিত্ত মানুষ ছিল অনুপস্থিত। বদরুদ্দিন ওমর লেখেন,” উনিশ শতকের বাঙালি ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোকেরা ইংরেজের মুৎসুদ্দী হিসেবেই নিজেদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করেন। তাঁরা অনেকে মনে করতেন তাঁদের ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধির অর্থ দেশের সম্পদ বৃদ্ধি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা ধনসম্পত্তি অর্জন করেছিলেন সে প্রক্রিয়ার মধ্যে দেশীয় শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষির ধ্বংসকে ত্বরান্বিত এবং দুর্দশাকে স্থায়ী করার ব্যবস্থা ছিলো । এ জন্য দেখা যায় যে, বাঙালি অভিজাত ও মধ্য শ্রেণীর লোকেরা প্রথমদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে কিছু ধন-সম্পদ অর্জন করলেও পুরুষানুক্রমে তাঁরা এদেশে ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হননি । ব্যবসার পাট উঠিয়ে দিয়ে জমি ও জমিদারী ক্রয় করেই নিজেদের আর্থিক জীবনের ধ্বংসকে তাঁদের রোধ করতে হয়েছিল।”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিন্তু সে পথে হাঁটেননি । আমরা সবাই অবগত আছি যে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত হিসেবে নিজের জীবন শুরু করে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে তিনি শিক্ষা বিভাগের ইন্সপেক্টরের পদেও আসীন ছিলেন। চাকরি এবং সেই কর্মস্থলের উন্নতি বিধান এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক ও সামাজিক সংস্কারে তিনি ছিলেন একজন উদ্যমী পুরুষ । আমরা বিদ্যাসাগরের অসীম কর্মজগতের মধ্যে শুধুমাত্র তার ব্যবসায়িক সত্তাটিকে ধরার চেষ্টা করছি এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে। তাঁর শিক্ষা বিস্তারের জন্য যে কর্মের উদ্যোগ তা ছিল বাঙালি জাতির প্রতি তাঁর বিভিন্ন অবদানের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ অবদান । শিক্ষা বিস্তারের জন্যই তাকে ব্যবসায় নামতে হয়েছিল, তাও আবার শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়কেই কেন্দ্র করে। এটি ছিল তার বাস্তব একটি পদক্ষেপ । অর্থ ছাড়া যে শিক্ষা হয় না এটা তিনি অনুভব করেছিলেন। তাই আমরা দেখি যে ১৮৫১ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদপ্রাপ্ত হয়েও তিনি বেশ কিছু প্রগতিশীল ও বাস্তব সিদ্ধান্ত নেন । সেগুলো হল প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তকগুলির রক্ষন ও মুদ্রণ, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য জাতির ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া, ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন গ্রহণের রীতি প্রবর্তন করা, সংস্কৃত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত গ্রন্থ রচনা করা, দু মাসের জন্য গ্রীষ্মের ছুটির ব্যবস্থা করা, সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা। এই ক্ষেত্রে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন গ্রহণের সিদ্ধান্তের মধ্যেই আমরা পরবর্তী একজন বাস্তববাদী অর্থনীতি সচেতন মানুষের সাক্ষাৎ পাই। শুধু তাই নয় তাঁর এই বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে নতুন গ্রন্থ প্রণয়ন ও মুদ্রণের যে কথা বলা হয়েছে তার মধ্যেও নিহিত আছে একজন তন্বিষ্ঠ মুদ্রকের প্রয়োজনীয়তা। এছাড়া শিশুদের জন্য তার যাবতীয় গ্রন্থ প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট।
একটা অপবাদ আছে তা হলো বাঙালি ব্যবসায়ে বিমুখ। এ কথাটি তিনি মানেননি। ১৮৪৭ সালে তিনি তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে একটি ছাপাখানা খোলেন । নাম ছিল ‘সংস্কৃত প্রেস’। এখন কথা হল যে, তখন তো অনেক মুদ্রণ খানা প্রায় তৈরি হয়ে গেছে তবে আবার কেন নতুন করে মুদ্রণ খানা খুলতে হলো? আসলে তাঁর যে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি ও পাঠক্রম তা যেন কোন মতেই ব্যাহত না হয় এবং পরমুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে হয়। বর্তমানের ডিজিটাল প্রেস তো নয়ই, লোহারও নয়, সে ছিল কাঠের প্রেস। এই প্রেস খুলতে তখনকার দিনে খরচ হয়েছিল ছ’শো টাকা । তাও ধার করে স্থাপন করতে হয়েছিল। ধার করেছিলেন বন্ধু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ।এই টাকা পরিশোধ করতে তিনি উঠে পরে লেগে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন গ্রন্থ, বিশেষ করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মার্শাল সাহেবের কাছ থেকে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ছাপার কাজ নিয়েছিলেন।পরে ধার পরিশোধ হয়ে যাবার পর তিনি বিভিন্ন সিলেবাসের বইও ছাপতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর প্রেসের উন্নতি ঘটল। বাংলা ছাপার জগতে এক নতুন দিনের সূচনা হলো বলা যায়। ” ১৮৫৫ সাল নাগাদ বইয়ের ব্যবসা থেকে মাসে অন্তত হাজার টাকা আয় হত বিদ্যাসাগরের। বছর দুয়েক পর কলকাতার ছেচল্লিশটি প্রেস থেকে ৫৭১৬৭০ কপি বাংলা বইয়ের মধ্যে সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা বই ছিল ৮৪২২০টি। এক বছরে বিদ্যাসাগরের বইয়ের ২৭টি সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে — এমন তথ্যও আছে। আজকের বিচারে পরিসংখ্যান গুলোর মানে দাঁড়ায় সেকালে পাঠ্যবইয়ের বাজারের অনেকটাই ছিল বিদ্যাসাগরের দখলে।”
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে বিদ্যাসাগরের পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছিল দুটি কারণে। এক তিনি শিক্ষা বিভাগের ইন্সপেক্টর থাকার জন্য তাঁর সব বইই পাঠ্য করেছিলেন এই প্রেস থেকে এবং দ্বিতীয়তঃ তিনি যেহেতু সরকারের কাছের মানুষ ছিলেন সেহেতু সরকারি সুযোগ সুবিধা নিতে কসুর করেন নি। কিন্তু এই তত্ত্ব বা অভিযোগ আমরা মানছি না। কারণ ইংরেজ শাসনে থেকে ইংরেজ শাসকের কাছ থেকে অনেক দাবি আদায়ের মতো এটাও একটা দাবি আদায় বা ইংরেজকে পরোক্ষে কাজে লাগিয়ে দেশীয় শিক্ষা ও মুদ্রণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনকে দেশের ও দেশবাসীর উন্নতি সাধন বলেই মনে করি।
শুধু মাত্র মুদ্রণ নয়, এরসঙ্গে তিনি সংস্কৃত প্রেসের পাশাপাশি একটি পুস্তক ভান্ডারও তৈরি করেন। এটা ছিল তাঁর প্রখর বাস্তববোধ ও ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। একটা হিসাব কষে অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে প্রেসের আয় ও চাকরির বেতন দুটো নিয়ে তাঁর আয় বেশ ভালোই ছিল। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তারা বিদ্যাসাগরের মানবহিতৈষণা মূলক কাজকর্মকে ছোট করে তাঁর আর্থিক লাভালাভের দিকে এক অশুভ ঈঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ইঙ্গিতটা যে প্রকৃতই অশুভ ছিল তা বোঝা যায় সংস্কৃত কলেজের প্রাচীন সিন্দুকটি খোলার পর। বিদ্যাসাগর তাঁর রোজগার সব জমা করে গিয়েছিলেন বাংলার বিধবাদের কল্যাণে। নিজে পরবর্তী কালে কার্মাটারে হতদরিদ্র, অভুক্ত আদিবাসীদের মধ্যে গিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সেখানে রীতিমতো তিনি গরীব আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিনা পারিশ্রমিকে নিজের হাতে করতেন। এই চিকিৎসায় তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। নিজের জীবনকে জুড়ে নিয়েছিলেন ওইসব প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে।
সবশেষে আরো একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আলোচনা শেষ করতে চাই। তা হলো, মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে তিনি বাংলা লিপির আধুনিকী করণও করেছিলেন। এটি যেমন মুদ্রণের স্বার্থে তেমনি আমাদের ভাষার স্বার্থে। একথা কিন্তু ভুললে চলবে না। একজন গবেষক তাই লেখেন, ” Another area in which Vidyasagar ‘s experience as a printer gave him unique knowledge was in the reform of Bengali typography and printing. Vidyasagar reformed Bengali typography into an alphabet of twelve vowels and forty consonants and grappled with the problem of ‘ joined letters’ which continues to plague typographers in the digital age.”
শিক্ষা ও আধুনিকতাবাদ, সমাজ সংস্কার ও প্রগতি এবং বিজ্ঞানমনস্কতা — এই ছিল তাঁর লক্ষ্য। শিক্ষার বিস্তারকেই তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের উন্নতি ও প্রগতির মূল সূত্র হিসাবে বিবেচনা করে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। এই বিষয়টাকে বুঝতে হবে — তাহলেই তাঁর মুদ্রণ ব্যবসার মূল সূত্রটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না।