দ্য স্টেটসম্যান ভিনটেজ অ্যান্ড ক্ল্যাসিক কার র‍্যালি

ছবি: বিশ্বজিৎ ঘোষাল

শীতের মিঠে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে তখনও আড়মোড়া ভাঙছে কলকাতার সকাল। সেই সময় এক এক করে ভিনটেজ গাড়ি জমা হতে থাকল রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের মাঠে। রেনল্ড, ফ্লেরেস, স্টোয়ার, স্টুডিবেকার, রোলস রয়েস থেকে অস্টিন, টর্পেডো, ওলসলি, মার্সিডিজ বেনজ, ল্যান্ড রোভার মোটরসাইকেল, প্যানথর স্লোপ, ভেসপা ইত্যাদি ভিনটেজ ও ক্ল্যাসিক গাড়ি ও মোটরবাইক। এই গাড়িগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরনো ইতিহাস, যেন বা রূপকথার কাহিনী। কলকাতার রাজপথে নেমে এল সেই ইতিহাস। সাক্ষী থাকল তিলোত্তমাবাসী। কেউ বা বাজার সেরে বাড়ি ফিরছেন, কেউ যাচ্ছেন নিজস্ব কোনও কাজে– রবিবারের সকালে আয়োজিত দ্যা ভিনটেজ অ্যান্ড ক্ল্যাসিক কার র‍্যালির ছবি নিজেদের ফোনে তুলে নিতে ব্যস্ত সকলেই। দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকার উদ্যোগে আয়োজিত হল ৫৪ তম ভিনটেজ অ্যান্ড ক্ল্যাসিক কার র‍্যালি।
শতাব্দী প্রাচীন গাড়ি ও মোটরবাইকের এই র‍্যালিটি রবিবার সকালে রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব থেকে শুরু হয়ে কলকাতা শহরের ২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী থেকে শ্যামবাজার হয়ে ফের ফিরে আসে আরসিটিসি গ্রাউন্ডে। এই র‍্যালি দেখতে কলকাতার রাজপথে ভিড় জমিয়েছিলেন পথচারীরা। র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করেছিল উত্তম কুমারের ব্যবহৃত গাড়িও। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের সময় ইস্ট পাকিস্তানের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি যে মার্সেডিজ বেঞ্জ গাড়িটি ব্যবহার করেছিলেন সেই গাড়িটিও র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে জয়ের পর গাড়িটি ট্রফি হিসেবে ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত চালিয়ে এনেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। এছাড়াও ১৯৩৭ সালের প্লাইমাউথ, ১৯৫৬ সালের ডজ কিংসওয়ে ১৯২৮ সালের এসেক্স, ১৯৫১ সালের বিএসএ, ১৯৪৬ সালের অস্টিন সহ আরও অনেক ক্ল্যাসিক এবং ভিনটেজ গাড়ি দেখা গেল কলকাতার রাজপথে।
এই র‍্যালি প্রথম শুরু হয়েছিল দিল্লি শহরে ১৯৬৪ সালে দ্য স্টেটসম্যান গ্রুপের উদ্যোগে। পরে কলকাতায় তা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার তৎকালীন এডিটর ডেসমন ডয়েগ প্রথম এই র‍্যালির সূচনা করেছিলেন। সেই সময় এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের মিলিটারি অফিসাররাও। মাঝে অতিমারীর কারণে দুই বছর বন্ধ থাকলেও সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। এ বছর ৫৪তম র‍্যালিটি অনুষ্ঠিত হল রবিবার।
সকাল ১০টায় দ্য স্টেটসম্যানের পতাকা উত্তোলন করেন ম্যানিজিং ডিরেক্টর ও দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্র কুমার। উপস্থিত ছিলেন দ্য স্টেটসম্যান গ্রুপের ডিরেক্টর বিনীত গুপ্ত। দিল্লি শাখার নীতীশ কাপুর, কলকাতা শাখার প্রধান গোবিন্দ মুখার্জি, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুমন ভট্টাচার্য, সাংসদ ও অভিনেত্রী জুন মালিয়া প্রমুখ। র‍্যালির সূচনা করেন রিজিওনাল ভাইস প্রেসিডেন্ট, আর্মি ওয়াইভস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অসীমা শ্রীকান্ত। এদিন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এছাড়াও প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন সঙ্গীত শিল্পী শ্রেষ্ঠা দাস। এরপর নারায়ণা গ্রুপ অফ স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন। এসেছিলেন সঙ্গীতশিল্পী ও বিধায়ক বাবুল সুপ্রিয় ও ক্রীড়াবিদ স্নেহাশিস গাঙ্গুলি।
এদিন দেখা গেল ১১১ বছরের প্রাচীন একটি স্টোয়ার গাড়িকে। মেদিনীপুরের জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরি গাড়ি কিনতে যান ১৯০৮ সালে। মেদিনীপুরের জলকাদাময় রাস্তাতে চলতে পারে এমন গাড়ির সন্ধান করতে তিনি পৌঁছে যান স্টোয়ার কোম্পানিতে। ১৯১৩ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে চারটি কাঠের বাক্সে স্টোয়ার গাড়ি এসে পৌঁছাল কলকাতা বন্দরে। সঙ্গে এলেন দুইজন জার্মান মেক্যানিক, গাড়িটিকে অ্যাসেম্বেল করার জন্য। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের একটি গ্যারাজে সেই গাড়ি অ্যাসেম্বল করা হলে তার মালিক ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরি নিজেই তা চালিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মেদিনীপুরে তাঁর জমিদারি এস্টেটে। উত্তরাধিকার সূত্রে এই গাড়িটি বর্তমানে রয়েছে তাঁরই পরিবারের প্রতাপ ও আনন্দ চৌধুরির তত্ত্বাবধানে। ১৯৫২ সালে স্টোয়ার গাড়ির কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও ওই কোম্পানির একমাত্র চালু গাড়িটি আজও রয়ে গিয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরির বংশধর আনন্দ চৌধুরিদের কাছে। ১৯৩৫–৪০ সালে বাংলার গভর্নর যে ওলসলি লিমুজিন ল্যান্ডোলেট গাড়িটি ব্যবহার করতেন সেই গাড়িটিকে কলকাতায় আনা হয়েছিল ১৯১৪ সালে। পরে নানা হাত বদলের পর ডিব্রুগড় ঘুরে কলকাতায় নিয়ে আসেন শশীকুমার কানোরিয়া। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শ্রীবন্ধন কানোরিয়া গাড়িটিকে পুরনো চেহারা অবিকৃত রেখেই নতুন করে সংরক্ষণ করেন। ১১০ বছরের পুরনো এই গাড়িটির আরোহী শ্রীবর্ধন কানোরিয়াকে দেখা গেল এই র‍্যালিতে।
ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ যে রোলস রয়েস গাড়িতে করে প্রথম রাষ্ট্রপতি ভবনে যান, ১৯৩৭ সালের সেই রোলস রয়েস গাড়িটির মালিক এখন বসন্ত কুমার কারনানি। তার রং প্রথমে কালো থাকলেও এখন করা হয়েছে ক্রিম এবং মেরুন। প্রায় ৭৮ বছরের পুরনো হলেও দীর্ঘ ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী এই গাড়িটির স্বাস্থ্য আজও অটুট।
এই র‍্যালিতে আর একটি যে উল্লেখযোগ্য গাড়ি দেখা যায় তা হল মার্সিডিজ বেনজ। মার্সিডিজের জন্ম জার্মানিতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত সিদ্ধার্থ শংকর রায় এক সময় নিজেই মার্সিডিজ চালাতেন। দ্য স্টেটসম্যানের কার র‍্যালিতে যে মার্সিডিজ বেনজ গাড়িটি দেখা যায় সেই গাড়িটি কিনেছিলেন এম টি মেহতা। তাঁর হাত থেকে গাড়িটি সংগ্রহ করেন শালু চৌধুরি। এখন তার মালিক সৌরজিৎ পাল চৌধুরি। গাড়িটিতে একবার আগুন ধরে গেলেও সযত্ন তাকে সারিয়ে নিয়েছে সৌরজিৎবাবু। তিনি যত্ন না নিলে হয়তো মৃত্যু হত একটি ইতিহাসের। ২০১৪ সালে এই গাড়িটি বেস্ট মেনটেইন্ড কারের শিরোপা পেয়েছিল। ভিনটেজ কার ছাড়াও পুরনো দিনের অ্যাম্বাস্যাডর, ফিয়ার্ড, স্ট্যান্ডার্ড হেরল্ডের মতো ক্ল্যাসিক গাড়িগুলিও র‍্যালিতে অংশ নেয়। এছাড়াও ১০০ বছরের পুরনো প্যানথর স্লোপ মোটরসাইকেল এবং ইতালিয়ান ভেসপা মডেলের বাইকও অংশ নেয় এই র‍্যালিতে।
এবারের র‍্যালিতে প্রায় ১৫০টি ভিনটেজ গাড়ি ও মোটরবাইক অংশগ্রহণ করেছিল। এই শহরের বিভিন্ন কার রেস্টোরার এবং কালেক্টারদের জন্যই এখনও ভিনটেজ গাড়িগুলি সচল রয়েছে। পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে ভিনটেজ গাড়ির কোনও মিউজিয়াম নেই। তার অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করে চলেছে দ্য স্টেটসম্যান, তাদের ভিনটেজ অ্যান্ড ক্ল্যাসিক র‍্যালির আয়োজন করে সাধারণ মানুষকে সেই ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে সুযোগ করে দিয়ে।
১৯৪০ পর্যন্ত তৈরি হওয়া ভিনটেজ কারের মধ্যে যারা জয়ী হয়েছেন এবং বিভিন্ন বিভাগে ট্রফি পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আনন্দ চৌধুরি, শশী কানোরিয়া, প্রদীপকুমার চোপড়া, সৌরভ দুগার, সুপ্রিয়া রায়, সুরজকুমার কারনানি, ভবসুন্দরী দে, গুরমুখ সিং খোখার, সুরেন্দ্র কুমার দুগার, সূর্যপ্রতিম মির্জা, বিজয় কুমার সুরেকা, আজম মোনেম এবং দেবপ্রেম চ্যাটার্জি। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ল্যাসিক গাড়ির বিভিন্ন বিভাগে ট্রফি জিতেছেন আজম মোনেম, ইস্টার্ন কমান্ড ইন্ডিয়ান আর্মি, সরোজেশ চন্দ্র মুখার্জি এবং অনিরুদ্ধ ঘোষ। ১৯৪৫– ১৯৬২ মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গাড়ির বিভাগে ট্রফি জিতেছেন পল্লব রায়, সুরেন্দ্র কুমার দুগার, দেবদূত রায়চৌধুরি, দেবকুমার পাল, রবি দুগার, সুব্রত সরকার, অতীন্দ্র নাথ ঘোষ এবং কমিশনার অফ পুলিশ কলকাতা। পঞ্চাশ বছর আগে তৈরি হওয়া গাড়ির ক্ষেত্রে ট্রফি পেয়েছেন সুতনু কুমার পাত্র, চিরদীপ সরকার, দেবপ্রেম চ্যাটার্জি, পল্লব রায় ও বৃন্দা গাঙ্গুলি। ১৯৭৫ পর্যন্ত তৈরি হওয়া মোটরসাইকেল এবং স্টুটারের ক্ষেত্রে ট্রফি লাভ করেছেন হরজিৎ সিং ধাঞ্জাল, প্রসূন সাউ, সৈয়দ কামালউদ্দিন হোসেন, ডঃ আব্দুল করিম, অরিজিৎ ভট্টাচার্য এবং জাকি আনোয়ার।
উল্লেখ করা দরকার, রবিবার শীতের সকালে কলকাতার রাস্তায় এই যে প্রাচীন সব গাড়ির সৌন্দর্য্য উপভোগ করা গেল তার পিছনে অবশ্যই অবদান রয়েছে স্পনসর কোম্পানিগুলির। যাদের কথা বলতে হয়, তাঁরা হলেন বিচারক, টাইম কিপার এবং মার্শাল। সর্বপরি, যাঁরা এইসব দুষ্প্রাপ্য গাড়ি সংরক্ষণ করে রেখেছেন, বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের আকর্ষনীয় সৌন্দর্য্য এবং এই র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করে সবাইকে তা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন, তাঁদের জন্য কোনও সাধুবাদই বোধহয় যথেষ্ট নয়। আর যে দর্শকদের উপস্থিতিতে এই আয়োজন সার্থক হয়ে ওঠে তাঁদের সবাইকে দ্য স্টেটসম্যানের পক্ষ থেকে অশেষ শুভেচ্ছা।