বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। গোটা এক বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে উমা বাড়ি ফেরেন এই আশ্বিনে। শারদীয়ার কলকাতা শহর মানেই আলোর রোশনাই, বেসামাল জনজোয়ার আর প্যান্ডেল হপিং। শহরের নামজাদা পুজো কমিটিগুলির আকর্ষণীয় থিম দেখতে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড় করে উৎসবপ্রিয় বাঙালি। নুন বিনা যেমন রান্না আলুনি, তেমনই থিমমেকার ছাড়া কলকাতার পুজো পানসে। প্রাণের শহরের এমনই কয়েকটি পুজোর থিম সম্মন্ধে একটু জেনে নেওয়া যাক।
কাঁকুড়গাছি যুবক বৃন্দ
নিহত চিকিৎসকের বাবা বলেছিলেন, সেলাই করে তিনি মেয়েকে বড়ো করেছেন। সেই কথা মাথায় রেখেই পোশাকের রূপকারদের আখ্যান ফুটিয়ে তুলেছে কাঁকুড়গাছি যুবক বৃন্দের এবারের দুর্গোৎসব। ৯৫ তম বর্ষে যুবক বৃন্দের ভাবনা ‘দর্জি মহল্লা।’ থিম শিল্পী পাপাই সাঁতরার ভাবনায় মণ্ডপের একাংশে, শোকাহত মা-বাবা’র প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে।
স্বপ্নে ভরা তরণী মাঝ নদীতে ডোবার বেদনা ফুটে উঠেছে শিল্পীর ভাবনায়। স্টেথো গলায় এক তরুণী চিকিৎসকের ছবি ঘরের দেওয়ালে টাঙানো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বানানো এই ছবি নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়ার প্রতীকী।
শিল্পী পাপাই সাঁতরা জানান, প্রথম থেকেই দর্জিদের জীবনযাত্রা তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু মাসখানেক পরেই আরজি কর হায়পাতালে এই নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীকালে ওই নিহত চিকিৎসক-পরিবারের আর্তি জনসমক্ষে এলে, শিল্পী জানতে পারেন ওই তরুণীর কেরিয়ারের সাফল্যের অন্তরালে ছিল তাঁর পরিবারের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামেরই একটি খন্ডচিত্র মণ্ডপে উঠে এসেছে।
যাদবপুর এ্যাথলেটিক ক্লাব
৫১ তম বর্ষে কারিগর শ্রী বাপাই সেন-এর হাত ধরে যাদবপুর এ্যাথলেটিক ক্লাবে এবারের পুজোর ভাবনা ‘নতুনের মাঝে পুরাতন শিল্প থাকুক চিরন্তন।’
সাঁওতালিদের ঐতিহাসিক পুতুল নাচ ‘চাদর বদর’কে নিজের ভাবনায় ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পী। চাদর বদরের ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালিদের গ্রামে গিয়ে, সবটা চাক্ষুষ করে এবং অনুভব করে তবেই কারিগর কর্মযজ্ঞে নেমেছেন। তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
এই চাদর বদর একটি কাঠের বাক্সের ভিতরে ঝোলানো কাঠের পুতুলের সাহায্যে করা হয়। পর্দা দিয়ে তিন দিক-ঢাকা থাকে। অভিনেতা প্রাচীন সাঁওতাল সংস্কৃতির শব্দ এবং শ্লোক দ্বারা পুতুল ব্যবহার করে উপজাতীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গল্প বর্ণনা করেন। পুতুলগুলিতে সংযুক্ত থাকে স্ট্রিং। সেই স্ট্রিং ব্যবহার করে পুতুলগুলি শিল্পীর দ্বারা চালিত হয়।
পুজোর কয়েকটি দিন মণ্ডপে এই চাদর বদর প্রদর্শীত হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোগক্তারা। আজকের যান্ত্রিক যুগে অতীতের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি কতটা প্রাসঙ্গিক সেটাই শৈল্পিক ভাবনায় তুলে ধরবে যাদবপুর এ্যাথলেটিক ক্লাব।
সমাজসেবী সংঘ
পৃথিবী এগিয়ে চলেছে জেট-গতিতে। উন্নয়নের প্রশ্নে, আধুনিকতার লক্ষ্যে, ডিজিটাল দুনিয়ায় সে হারাতে বসেছে তার প্রাচীন ঐতিহ্য। ভুলতে বসেছে গ্রামবাংলার জীবন, কৃষকের শ্রম, মাটির ঘ্রাণ আর সোনালি ধানের মূল্য। সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলা, কৃষকের দৈনন্দিন জীবন কাহিনি, সোনালি ধানের সুবাস আর মাটির স্পর্শ পেতে হলে, আসতে হবে সমাজসেবীর পুজোমণ্ডপে।
এবারের থিম ‘কর্ষণ’। মণ্ডপে ঢুকলেই ঢেঁকির ছন্দ, জলের গান, কৃষক জীবনের সংগ্রাম আর সোনালি ধানের কারুকার্য মন কেড়ে নেবে। মাতৃপ্রতিমার অলঙ্কার থেকে পরনের শাড়ি,সবই তৈরি হয়েছে আউশ ধান দিয়ে। এছাড়াও মণ্ডপের ভিতরে থাকছে জোয়াল, ঝুড়ি, লাঙল, ঢেঁকিছাঁটা চাল থেকে শুরু করে কলসি, ধানগাছ। এককথায় বলতে গেলে গ্রামবাংলার একটুকরো ছবি যেন বাস্তবায়িত হয়েছে। এবারের শিল্পী রাজু দাস জানালেন, ‘কর্ষণ’ ভাবনার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অভিমানের গাথা। তাই তাঁর ভাবনার বার্তা, ‘আর করব না চাষ, দেখি তোরা কী খাস।’
মণ্ডপের সামনে রয়েছে এক বিশালাকৃতির লাঙল, যে-লাঙল একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেবে আমাদের প্রাচীন সভ্যতাকে। মণ্ডপের ভিতরে ঢুকলে শুনতে পাওয়া যাবে ঢেঁকির গান, যে-গান গাইতে গাইতে গ্রামবাংলার মায়েরা অন্ন কোটার আনন্দে সামিল হন। বাংলার এই পুরাতনী গান নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনা করেছেন শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র। এর আগেও বিভিন্ন সম্মানে সম্মানিত হয়েছে এই পুজো। সমাজসেবী পুজো কমিটির সম্পাদক অরিজিৎ মৈত্র জানালেন, এই নতুন যুগের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি ও কৃষকের জীবনের নানা সংগ্রামের কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
আহিরীটোলা সর্বজনীন
৮৫তম বর্ষে এবারে আহিরীটোলা সর্বজনীনের ভাবনা ‘খেয়াল সেতুর বৈতরণী’। উত্তর কলকাতার সামগ্রিক চিত্র এবছরের থিমে তুলে ধরছে এই বারোয়ারি পুজো।
উত্তর কলকাতার মানুষ মনে করেন কলকাতার আত্মা রয়েছে উত্তরেই। গঙ্গার পাড়, সরু গলি, কুমোরটুলি, বাবুয়ানি, নিষিদ্ধপল্লী -সহ নানা ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে উত্তর কলকাতায়। এই অঞ্চলকে ঘিরে যত ইতিহাস রয়েছে, যা গল্প রয়েছে, তা নিজেদের শৈল্পিক ভাবনায় তুলে ধরেছে আহিরীটোলা সর্বজনীন। বিষয়ভাবনা ও রূপায়নে রয়েছেন শিল্পী অনির্বাণ দাস। পুজোমণ্ডপে থাকছে তিন ফুটের একাধিক অটো, সাত ফুটের লঞ্চ, ১১ ফুটের বাস, ৯ ফুটের লরি । মণ্ডপে দেখা যাচ্ছে, কুলির পিঠে চড়ে আসছেন দেবী দুর্গা।