ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক এবার অন্য আরও চারটি ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও ‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা প্রদান করায় আমরা খুব খুশি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সামাজিক মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে সারা ভারতের বাংলাভাষাভাষী মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাই যে ‘বাংলা’কে অবশেষে ভারত সরকার একটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে এই স্বীকৃতি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম এবং আমরা আমাদের দাবির সমর্থনে যাবতীয় গবেষণার ফলাফলের তিনটি খণ্ড জমা দিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় সরকার আজ সন্ধ্যায় আমাদের গবেষণালব্ধ দাবি মেনে নিয়েছে এবং আমরা অবশেষে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক শীর্ষে পৌঁছেছি।’
ভারতীয় বাঙালিদের জন্যে এই বার্তা সত্যিই আনন্দের। তবে স্বীকৃতি ‘ছিনিয়ে’ নেওয়ার প্রয়োজন কেন অনুভব করলেন মুখ্যমন্ত্রী?
১১১ বছর আগে এশিয়ার প্রথম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সারা পৃথিবীতে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলায় সাহিত্যচর্চাও ক্রমে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে হিন্দিসহ সারা ভারতের সমস্ত ভাষার সাহিত্যিকরাই যেমন বাংলা ভাষার অগ্রণী সাহিত্যিকদের লেখা কৃতিগুলিকে শ্রদ্ধা ও সমীহ নিয়ে দেখতেন, আজও সেভাবেই দেখেন, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বিমল করের সাহিত্য ভারতের বিভিন্ন ভাষায় এত বেশি অনুবাদ হয়েছে যে তাঁদেরকে অনেকেই তাঁদের নিজের ভাষার লেখক বলেই জানেন। পরবর্তীকালে সমরেশ বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কিম্বা মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও সমাদৃত।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দি ও ইংরেজিকে যোগাযোগ রক্ষার ভাষা হিসেবে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হলে, আর সরকারিভাবে বিভিন্ন সময়ে আসামে, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ে অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হলেও অন্যান্য প্রধান ভারতীয় ভাষার সাহিত্যিকরা কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রতি এই শ্রদ্ধা ও সমীহর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। কিন্তু ২০০৪ সালে, ভারত সরকার ঘোষণা করে, যে ভাষাগুলি কিছু কঠোর মানদণ্ড পূরণ করে সেগুলিকে ভারতের ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।
২০০৬ সালের একটি প্রেস রিলিজে, কেন্দ্রীয় পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অম্বিকা সোনি রাজ্যসভাকে বলেছিলেন যে ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসাবে শ্রেণিবিন্যাসের জন্য বিবেচিত ভাষাগুলির যোগ্যতা নির্ধারণ করতে যে মানদণ্ডগুলি নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলি হল, ১. ১৫০০-২০০০ বছর সময়কালের লিপিবদ্ধ ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ্যের অতি প্রাচীনত্ব; প্রাচীন সাহিত্য বা পাঠ্যসমূহের একটি ধারাবাহিকতা থাকতে হবে, ২. যে ভাষার সাহিত্য প্রস্তাবকদের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি মূল্যবান ঐতিহ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে; ৩. সেই ভাষার সাহিত্যিক ঐতিহ্য মৌলিক হতে হবে এবং যা অন্য বাক্-সম্প্রদায় থেকে ধার করা নয়; ৪. সেই ধ্রুপদী ভাষা এবং তার সাহিত্য সে ভাষার আধুনিক রূপ থেকে স্বতন্ত্র হওয়ায় ওই ধ্রুপদী ভাষা এবং তার পরবর্তী রূপ বা তার শাখাগুলির মধ্যে স্বল্প বিচ্ছিন্নতাও থাকতে পারে। এই সব কিছু বিবেচনা করার জন্য ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক দেশের স্বনামধন্য ভাষাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি ‘ধ্রুপদী ভাষা’ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভারত সরকার একে একে ছয়টি ভাষাকে ভারতের ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেগুলি হল – তামিল, সংস্কৃত, তেলুগু, কন্নড় , মালয়ালম ও ওড়িয়া। সেই তালিকায় বাংলা ভাষার নাম না থাকায় বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিকরা তখন অবাক হয়েছেন। অনেক ভাষাতাত্ত্বিক ব্যক্তিগতভাবে এবং সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান তখন বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা প্রদানের জন্য যুক্তি ও তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাপ্ত্র জমা দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্সটিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ, পশ্চিমবঙ্গের নির্দেশক স্বাতী গুহ আর তাঁর টিমের অবদান। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ভুবনেশ্বর কেন্দ্রের কয়েকজন নবীন গবেষকও। তাঁরা শুধু আবেগ কিম্বা যুক্তি দিয়ে নয়, প্রথাগতভাবে ভারত সরকারের ওই ‘ধ্রুপদী ভাষা কমিটি’র চাহিদা অনুসারে সমস্ত তথ্য ও প্রমাণের যোগান দিয়ে গেছেন।
অবশেষে এবার শারদোৎসবের আগে এই সুসংবাদ এলো। এবার বাংলাসহ আরও ৫ টি ভাষা এই ‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা পেল। সেগুলি হল মারাঠী, পালি, প্রাকৃত এবং অসমীয়া।
‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা পাওয়ায় এই ভাষাগুলির কী লাভ হবে? ১নভেম্বর ২০০৪ তারিখের ভারত সরকারের প্রস্তাব নং ২-১৬/২০০৪-ইউএস (আকাদেমি) অনুসারে, ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসাবে ঘোষিত একটি ভাষার ক্ষেত্রে যে সুবিধাগুলি যুক্ত হবে তা হল: ১. ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষায় বিশিষ্ট পণ্ডিতদের জন্য দুটি বড় বার্ষিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২. ধ্রুপদী ভাষায় পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য একটি ‘সেন্টার অফ় এক্সিলেন্স’ স্থাপন করা হয়েছে। ৩. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিতদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘প্রফ়েশনাল চেয়ার’ তৈরি করা হয়, এতদিন শুধু ছ’টি ধ্রুপদী ভাষাই এই সুবিধাগুলি পেয়ে এসেছে। এবার বাংলা, মারাঠী, পালি, প্রাকৃত এবং অসমীয়া ভাষাও সেই সুযোগ পাবে।
বাংলা ভাষার গৌরব তা রবীন্দ্রনাথ নজরুল সহ অসংখ্য বিপুল প্রতিভাসম্পন্ন স্রষ্টার ভাষা বলে, ভাষা শহিদদের ভাষা বলে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভিত্তি-ভাষা বলে, সত্যজিৎ রায়ের ভাষা বলে। পৃথিবীর ষষ্ঠ বা সপ্তম ভাষা বা ভারতের দ্বিতীয় বহুকথিত ভাষা–সেটাও এমন-কিছু নয়।
ভাষার আসল শক্তি তা সেই ভাষা তার বক্তাদের কী কী দেয়, আর তার বক্তারা তাকে কী কী দেয় তার ওপর নির্ভর করে। কারণ ভাষার নিজের দেওয়ার শক্তি নেই, বক্তারা তাকে কী দেওয়ার যোগ্য করে নির্মাণ বা নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাই আসল প্রশ্ন। তা কি তার বক্তাদের আশ্বাস দেয় ? অর্থাৎ বক্তারা কি তাকে নিয়ে আশা ও আশ্বাস পোষণ করে ? তা কি তার বক্তাদের দৈনন্দিন যাপনে কোনও সাহায্য করে–অর্থনৈতিক যাপনে, শুধু সাংস্কৃতিক যাপনে নয়? এখানে আসে রাষ্ট্রের দায়িত্ব–রাষ্ট্র কি ভাষাটিকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক ভূমিকা দিয়েছে–প্রধানত এই ভাষায় লেখাপড়া করে কি ভালো চাকরি পাওয়া যায় ?
ধ্রুপদী নামটা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তার কর্তব্য শেষ করছে, না আর কোনও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন করুন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতির মূল্য কতটা সে তর্কে না গিয়েও মনে রাখুন, শিক্ষায়, গবেষণায কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। প্রশ্ন করুন রাজ্য সরকার কী নতুন সংকল্প নিচ্ছে এই ভাষাকে নিয়ে। স্কুলের শিক্ষা, বিশেষত বাংলা শিক্ষার কোনও উন্নয়নের পরিকল্পনা আছে তার ?
এই স্বীকৃতির খবরে আনন্দিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমীরা এখন সামাজিক মাধ্যমে দাবি তুলেছেন, অন্যান্য রাজ্য যেমন সেই রাজ্যের প্রধান ভাষাকে স্কুল- কলেজে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাধ্যতামূলক করে, এবার পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা সরকারও একইরকম পদক্ষেপ নিক।