‘অপ্রতিরােধ্য : কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট উমর ফৈয়াজ‘ -এই বইটি লেখার জন্য কাশ্মীরে খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ৬ মাস কাটিয়েছিলেন লেখক ভাবনা অরােরা। এ হল লেফটেন্যান্ট উমর ফৈয়াজের জীবন নিয়ে লেখা একটি বই। ২০১৭ সালে উমরকে অপহরণ করে খুন করেছিল জঙ্গিরা। শ্রী সিমেন্ট লিমিটেডের উদ্যোগে এবং কলকাতার তাজ বেঙ্গলের সহযােগিতায় প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন আয়ােজিত ‘লেখকের সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে হাজির ছিলেন ভাবনা। এই বইটা লিখতে গিয়ে তাঁকে যে ওঠানামার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেদিনের অনুষ্ঠানে সেকথাই শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন তিনি।
ভাবনা, আপনি কিছু বলুন আপনার শেষ বইটা সম্পর্কে। এরকম একটা থিম আপনি খুঁজে পেলেন কী করে?
আমার প্রথম লেখা ফিকশন লেফটেন্যান্ট উমর ফৈয়াজ। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব সহজেই একঘেঁয়েমির শিকার হয়ে পড়ি। কয়েকজন সেনা অফিসারের অনুরােধে আমি বইটার কাজ শুরু করি। কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে ছােট করেই দেখা হয়। কিন্তু উমর ফৈয়াজ ১৮ বছর বয়সেই সেনাবাহিনীতে যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক, যখন সীমান্তের একটা পােস্ট থেকে ছুটিতে যান উমর, তখন ২০১৭ সালের ৯ মে তাঁকে অপহরণ করে খুন করে সন্ত্রাসবাদীরা। আমি বইটা একারণে লিখেছিলাম কারণ কাশ্মীর থেকে বেশি লােক সেনাবাহিনীতে যােগ দেন না। এই কাজটা করতে গিয়ে দু’বছর ধরে আমাকে আবেগের প্রচণ্ড ওঠানামার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
ফৈয়াজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যখন আপনি দেখা করেন, তখন আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
সাধারণ মৃত্যু ও শহিদের মৃত্যুর মধ্যে বিশাল ফারাক রয়েছে। যদিও আমিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবার থেকে এসেছি, তবু মৃত্যু নিয়ে এই কথাটা আমি উপলব্ধি করেছিলাম যখন প্রথম আমি এই শহিদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করি। কারগিলের যুদ্ধ ও শহিদ হওয়ার কথা আমি শুনেছি। কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে যন্ত্রণার মহর্ত হল কোনও শহিদের পরিবারে শােকজ্ঞাপন করা। বিশ্বাস করুন, এটা মােটেই সহজ কাজ নয়। আমার সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের কারণেই আমি ফৈয়াজের পরিবারের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করতে পারি। তবে সেই পরিবারের সঙ্গে দেখা করাটা একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
কাশ্মীরে আসা ও থাকার কাজটা মােটেই সহজ নয়। তাহলে আপনি কি আপনার পরিবারের কাছ থেকে এ বিষয়ে সমর্থন পেয়েছেন?
যখন আমি গবেষণার কাজ শুরু করি, তখন আমার পরিবার শ্রীনগরে ছুটি কাটাচ্ছিল। আমার গাড়িতে তখন পাথর মারা হয়েছিল। বাড়ির লােকেরা এইখবর জানতে পারল। তাঁরা বই লেখার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। আসলে ওঁরা তখন আমার নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন। এক সময়ে, আমি বই লেখার কাজটা ছেড়ে দেব বলেই ভেবেছিলাম। বিশেষ করে যখন আমি দেখলাম আমার বৌদি কঁদছেন। আমার ভাইও সেনাবাহিনীতে রয়েছে। ও তখন এগিয়ে এসে আমাকে উৎসাহ দিয়ে বই লেখার কাজটা চালিয়ে যেতে বলল। ভাই বলল, আমার বােন যদি একজন কর্মনিষ্ঠ অফিসারের সাহসের কাহিনি লিখতে না পারে, তাহলে আমার উচিত সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেওয়া।
কতদিন ধরে বইটার জন্য আপনি গবেষণা করেছেন?
বইটা লিখতে আমার পুরাে দুটো বছর লেগেছে। ৬ মাস আমি কাশ্মীরে থেকেছি। কেউ যদি সেনাবাহিনীকে নিয়ে কিছু লিখতে চায় তখন তাঁকে নানা স্তরে অনুমতি নিতে হবে। নিজের নিরাপত্তা নিয়েও আমার চিন্তা ছিল। প্রথমে আমি ফৈয়াজের পরিবারের কাছে যাই শােকজ্ঞাপন করতে। দিল্লির থেকে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাই অনুমতি পাওয়ার পরেও কমান্ডিং অফিসার আমাকে আটকে দিতে পারেন। কারণ কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। তাই প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনী আমাকে আটকে দেয়। এবং তখন আমার মনে হয়েছিল বইটা বােধহয় আর লেখা হবে না। তারপর একদিন কমান্ডিং অফিসারের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। পরে আমি কমান্ডিং অফিসারের সম্মতি আদায় করতে পারি।
যেহেতু আপনি অনেক গবেষণা করেছেন, তাই আপনি কি বলতে পারেন কেন লেফটেন্যান্ট উমর ফৈয়াজ নিজে বিপদে রয়েছেন জেনেও খুড়তুতাে ভাইয়ের বিয়েতে যোগ দিতে গেলেন?
আমি এই প্রশ্ন সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি যে এই পরিস্থিতি এড়ানাে যেত কিনা। আমি কমান্ডিং অফিসারকেও প্রশ্ন করেছি কেন ওকে ছুটিতে পাঠানাে হয়েছিল? উত্তরে কমান্ডিং অফিসার বলেছিলেন, কেউ যদি তাঁর নিজের বাড়ি যেতে চায় তাহলে কতদিন তাঁকে আটকে রাখা যায়? আমার মনে হয়, উমর কখনও ভাবতেই পারেনি যে ওর জীবন বিপন্ন হতে পারে। যদিও ওর বান্ধবী কিন্তু ওঁকে যেতে বারণই করেছিল।
কাশ্মীরের অশান্তির জন্য বই লেখার কাজটা মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার কথা কি মনে হয়েছিল আপনার?
অনেকবারই মনে হয়েছিল। বইলেখার জন্য কেউ সাহসী হতেই পারে। কিন্তু তাকে যুক্তিবাদী হতে হবে। আমি যে ধরনের সমার্থন পাচ্ছিলাম সেগুলিও হিসাবে রেখেছিলাম। অজানা ফোন নম্বর থেকে অনেকবারই হুমকি ফোন পেয়েছি। এফআইআর দায়ের করেছি। কিন্তু এসবে কোনও লাভ হয়নি।
আট থেকে নয় বছর আগে, কাশ্মীরের পরিস্থিতি ছিল অনেক স্থিতিশীল। কিন্তু গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। সে থেকে আপনার কী মনে হয়?
কাশ্মীরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরে এখন বড় লড়াই গােয়েন্দাদের সঙ্গে। এই লড়াইয়ে অস্ত্রশস্ত্র দরকার হয় না। পাকিস্তানের তরফে যেসব গােয়েন্দা ঢােকানাে হয়েছে তারা খুবই সক্রিয়। কাশ্মীরি যুবকেরা এখন মজার কিংবা উদ্দীপনা জাগাতে পারে এমন ভিডিও আর পান না। যেমন হােয়াটসঅ্যাপে আমরা দেখাতে পারি। তারা পান এমন ভিডিও যেগুলাে বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা কিংবা অর্ধসত্যে ভরা। পাক সেনারা সবসময় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে যে ভারত তাদের আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে। ভারতীয়দের চেয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বেতন আনেক বেশি। তাই ওরা একটার পর একটা কাণ্ডকারখানা চালিয়ে যায়। জানি না কখন এই সংকটের শেষ হবে।
আরেক দিক থেকে দেখলে, এই সংকটের জন্য কাশ্মীরি তরুণেরা ভালাে কোনও সুযােগ পান না। সেনাবাহিনী অপারেশন শুরু করলে ইন্টারনেট সংযােগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কোনও শিক্ষাগত বিষয়ের সুযােগ নিতে গেলে ছাত্রছাত্রীদের জম্মু গিয়ে একটা আবেদনপত্র জমা করতে হয়। তাই ধীরে ধীরে তরুণেরা হাতে বন্দুক তুলে নেয় ও সন্ত্রাসবাদী বনে যায়।