সৈয়দ হাসমত জালাল
গত ৫ আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর, বলা যায়, আমূল বদলে গিয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক। ওইদিন শেখ হাসিনা নিজের দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে এসেছেন এবং ভারত সরকারের আশ্রয়ে রয়েছেন কোনও গোপনীয় স্থানে। হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই তীব্র সমালোচনা করেছেন। এই নিয়ে তীব্র ভারত-বিদ্বেষ প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের সমর্থকদের মধ্যেও। সেখানকার বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনের নেতারাও, এমনকি সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বিএনপি-র কোনও কোনও নেতাও যে ভাষায় বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন, তা অকল্পনীয়।
খালেদা জিয়ার বিএনপি দলটি একসময় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায়ও ছিল। সে সময় ভারতের সঙ্গে তাঁদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল প্রতিবেশীসুলভ এবং শান্তিপূর্ণ। তাই এই দলের নেতাদের এই ধরনের বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত। এই দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভি যেভাবে ভারতীয় শাড়ি পুড়িয়েছেন এবং ভারতের তিনটি রাজ্য বাংলা, বিহার, ওড়িশা তাঁরা দখল করে নেবেন বলে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, তা নিতান্তই বালখিল্যসুলভ এবং হাস্যকর। কোনও কোনও ধর্মীয় এবং ছাত্রনেতা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দখল করার হুমকি দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে একটি মানচিত্রের ছবি ছিল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছিলেন, মাহফুজ আলমের ওই পোস্টের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত। মজার কথা, মাহফুজ আলম কয়েক ঘণ্টা পরেই মুছে ফেলেন ওই পোস্টটি। ভাবলে অবাক হতে হয়, সরকারি ক্ষমতায় থাকা কেউ এ ধরনের বিকৃত মানচিত্র পোস্ট করতে পারেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত যখন যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তখন মাহফুজ আলমের মতো মানুষদের কি আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত নয়!
অন্যদিকে, হাসিনা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনে বহু নির্মম ঘটনা সামনে এসেছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ হাজার ২০০টি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। এইসব তথ্য পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠন এবং মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে। প্রথামিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও পরে বাংলাদেশ সরকার সরকারিভাবেই জানিয়েছে, এই ইস্যুতে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ৮৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ব্যাপারে সারা বিশ্বেই কম-বেশি প্রতিবাদ হয়েছে। সেখানে হিন্দুসহ সব সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার প্রবলভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলেছে মার্কিন সরকারও। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে সেখানে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টি সরকারিভাবে উত্থাপন করেছিলেন।
বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, যা খুবই স্বাভাবিক। এখানকার বহু হিন্দু বাঙালির আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশে এখনও রয়ে গেছেন। তাছাড়া একই ভাষা, একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছেন দুই বাংলার মানুষ। তাই ওখানকার মানুষের উপর নির্যাতন এপারের মানুষদের ক্ষুব্ধ করেছে। বিশেষ করে সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের প্রতি প্রশাসনিকভাবেও যে ব্যবহার করা হয়েছে, তা যে মানবাধিকারকে অন্যায়ভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক আইন মতে, আদালতে যে কোনও অভিযুক্তের আইনজীবী পাওয়ার অধিকার আছে, যে আইনজীবী ওই অভিযুক্তের পক্ষে সওয়াল করবেন। আশ্চর্যের বিষয়, গণমাধ্যমে দেখা গিয়েছে সেখানকার আইনজীবীরাই সমবেতভাবে চিন্ময়কৃষ্ণের আইনজীবী নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন। এমনকি কোনও আইনজীবী তাঁর পক্ষে দাঁড়ালে তাঁকে ‘গণধোলাই’ দেওয়া হবে বলে শাসিয়েছেন। কোনও সভ্য দেশে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
যদিও এ বিষয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনও তিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে বা বাংলাদেশে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে দেখা যায়নি। তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এটি ভারত এবং বাংলাদেশ এই দুটি রাষ্ট্রের বিষয়। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু করার নেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক আলোচনার সাহায্যেই বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অতি সম্প্রতি দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে একটি কূটনৈতিক নোট, যাকে ‘নোট ভার্বাল’ বলা যেতে পারে, তুলে দেওয়া হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে। তাতে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে প্রত্যর্পণের কথা বলা হয়েছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই নোটের প্রাপ্তির কথা জানানো হলেও শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আসলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে বিচারের জন্য ভারত এখনই হস্তান্তর করবে, এরকম কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের যুক্তি, জুলাই-আগস্টে গণহত্যার বিচারের জন্য তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এটাকে কোনও জোরালো দাবি বলে সম্ভবত মনেই করছে না ভারত। তার কারণ কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বলেই মনে করা হচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তিতে পরিষ্কার বলা আছে, রাজনৈতিক অভিযোগে কোনও ব্যক্তিকে হস্তান্তর করা যাবে না। সুতরাং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এই যুক্তি প্রযোজ্য হবে এবং তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোই স্বাভাবিক। এছাড়াও ওই চুক্তি অনুযায়ী তিনি কোনও ‘ফিউজিটিভ ক্রিমিনাল’ বা ফেরারি আসামি নন। তিনি গত পাঁচ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। সুতরাং তিনি কোনও পলাতক আসামি নন এবং ভারত তাঁকে আতিথেয়তা দিচ্ছে, যেমন আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে দলাই লামাকে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও নিশ্চয়ই জানে, এখনই এবং এইভাবে শেখ হাসিনাকে তাঁরা ফেরত পাবেন না। কিন্তু সেখানকার বিভ্রান্ত জনগণকে তুষ্ট রাখতেই সম্ভবত এই পদক্ষেপ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ যেভাবে তাদের সম্পর্ক নিবিড় করে তুলছে, তা ভারত ভালো চোখে দেখবে না। সম্প্রতি অস্ত্রশস্ত্র ভর্তি পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। আবার বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে চলেছে পাকিস্তানি সৈন্য, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানি সৈন্য-মহড়া উপলক্ষ্যে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-চেতনাসম্পন্ন বহু সংখ্যক মানুষ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মাটিতে আবার পাকিস্তানি সৈন্যের আগমন সমর্থন করেন না। কিন্তু তাঁরা এখন নিরুপায়।
ভারত কোনোভাবেই এ সময় কোনও আগ্রাসী মনোভাব দেখায়নি। বাংলাদেশের তুলনায় ভারত একটি বৃহৎ দেশ ও বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশের দিক থেকে এখনই কোনও ভয়ের কারণ না থাকলেও পাকিস্তান যে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটাবে, এ বিষয়ে সতর্ক নিশ্চয়ই থাকতে হবে। ভারত এবং বাংলাদেশ এক দীর্ঘ ইতিহাসের ও সংস্কৃতির শরিক, এ কথা মাথায় রেখেই দুই দেশকে কূটনৈতিক স্তরে শান্তিপূর্ণ পথে এগোতে হবে। পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি দেশের অর্থনীতিও। দুই দেশেই সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন, শান্তিকামী মানুষের অভাব নেই। তাঁদের শুভবোধ জয়ী হোক, এটাই কাম্য।