কন্যা সংক্রান্তি কবে? এই হিন্দু রীতি পালন করলে মানুষের জীবনে কী কী উন্নতি হয়?

সুভাষ পাল

‘কন্যা সংক্রান্তি’! সম্প্রতি বেশ কয়েক বছর ধরে এই শব্দ বন্ধটি খুব আলোচিত হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যমে। মানুষের আধ্যাত্মিক আগ্রহ সেই কৌতূহল যেন আরও বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তিথি নক্ষত্রের হিসেব অনুযায়ী, সূর্য ১২টি রাশির প্রত্যেকটিতে এক মাস করে অবস্থান করে। তার এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমনের সময়কে সংক্রান্তি বলা হয়। প্রত্যেকটি রাশিতে গমনের সময়ে সেই আসন্ন রাশির নাম অনুযায়ী সংক্রান্তির নামকরণ করা হয়। এভাবেই ১২টি রাশির ১২টি নাম দেওয়া হয়েছে।

তাহলে এবার মূল প্রশ্নে আসা যাক। ‘কন্যা সংক্রান্তি’ আসলে কী? বছরের কবে, কখন এই সংক্রান্তি হয়? হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে কিভাবে পালন করা হয় এই সংক্রান্তি? এই সংক্রান্তি পালনে মানুষের জীবনে কী কী উপকার হয়? চলতি বছরে কন্যা সংক্রান্তি কবে ও কোন সময়ে পড়বে?


তিথি নক্ষত্রের হিসেব অনুযায়ী, সূর্য যখন সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে গমন করে, তখন সেই সময়কে ‘কন্যা সংক্রান্তি’ বলা হয়। প্রতি বছর ক্যালেন্ডারের নিয়ম অনুসারে তারিখ ও বারের পরিবর্তন হলেও এর একটি তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী সময় থাকে। সাধারণত বাংলা মাসের শেষ দিনে সংক্রান্তি হয়। কন্যা সংক্রান্তিও প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষেই আসে। আবার তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই দিনেই হয় বিশ্বকর্মা পূজা। শুধু তাই নয়, এই কন্যা সংক্রান্তির দিনে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। প্রসঙ্গত পিতৃপক্ষ এই দিন থেকে শুরু করে ১৬ দিন ধরে চলে। এবং মহালয়ার দিনে শেষ হয়ে মাতৃপক্ষের সূচনা হয়।

এ ব্যাপারে কলকাতার বিশিষ্ট জ্যোতিষী, বাস্তুবিদ ও পণ্ডিত কল্পতরু শাস্ত্রী বলেন, মূলত উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে কন্যা সংক্রান্তি পালনের রেওয়াজ বেশি আছে। বাংলাতে এই সংক্রান্তি কিছুটা পালিত হলেও এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলন হয়নি। বরং এই দিনে বাঙালিরা বিশ্বকর্মা পুজোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

কন্যা সংক্রান্তির মহত্ব
এবার আসা যাক, আমরা এই সংক্রান্তি পালন করলে কী কী উপকার পেতে পারি? হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, সূর্যদেবকে সৃষ্টি রহস্যের সঞ্চালক বলা হয়। সেজন্য কন্যা সংক্রান্তির দিনে যিনি স্নানপূর্বক সূর্য দেবের পূজা অর্চনা করেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে স্থিতি ও সফলতা আসে। কন্যা সংক্রান্তির দিনে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করলে সাংসারিক এবং মানসিক জীবনে স্থিতি আসে। পাশাপাশি পূর্ব পুরুষের আত্মাও বিশেষভাবে শান্তিলাভ করে। কথিত আছে, এই দিনে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করলে পূর্ব পুরুষরা সন্তুষ্ট হয়ে পরলোক থেকে তাঁদের সন্তানদের আশীর্বাদ করেন। কন্যা সংক্রান্তির দিনে দান করলে ভগবান বিশেষভাবে প্রসন্ন হন। এই দিনে দান করলে মনুষ্য জীবনে বিশেষ পুণ্যি লাভ হয়। এই দিনে গরিব, অসহায়, জরাজীর্ণ মানুষকে সাহায্য করাটা অত্যন্ত শুভ বলে ধরা হয়। কথিত আছে, ‘কন্যা সংক্রান্তি’র দিনে পূর্ব পুরুষের প্রতি পূজা অর্চনা করলে পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয়। সেজন্য এই দিনে নিয়ম মেনে পূজা অর্চনা করাই শ্রেয়। যাতে নিজের অভীষ্ট পূরণ হয়।

কন্যা সংক্রান্তি কবে ও কোন সময়ে পড়বে?
এখন প্রশ্ন হল, চলতি বছরে ঠিক কবে এবং কোন সময়ে কন্যা সংক্রান্তি পালন করবেন? পঞ্জিকার মত অনুসারে, চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সোমবার অর্থাৎ ‘কন্যা সংক্রান্তি’-র গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই দিনে সকাল ৬টা ১৭ মিনিটে সূর্যোদয় হবে। এবং সূর্যাস্ত সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে। আর সংক্রান্তির মুহূর্ত সন্ধ্যা ৭টা ৪৩ মিনিট। এই দিনে পূণ্যকাল মুহূর্ত দুপুর ১২ টা ২১ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত। আর মহা পুণ্যকাল মুহূর্ত বিকেল ৪টে বেজে ২৪ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত।

কন্যা সংক্রান্তি পালনের নিয়ম কী?
কথিত আছে, হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ‘কন্যা সংক্রান্তি’র দিন পূজা প্রস্তুতির আগে প্রথমেই স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নিতে হয়। এরপর পূজার স্থানও ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিতে হয়। এরপর একটি ছোটো চৌকির ওপর লাল কাপড় অথবা আসন বিছিয়ে দেওয়া হয়। ওই আসনের ওপর গঙ্গাজলপূর্ণ কলস স্থাপন করে তার মুখে আমের পল্লবের সঙ্গে কলা বেঁধে দিতে হয়। এবং কলসের সঙ্গে অক্ষত, রোলি, মৌলি, চন্দন, সিঁদুর, ধূপ, ফুল ইত্যাদি একটি থালায় ভরে কলসের মুখে রাখা হয়। এরপর ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে ফুল ও অন্যান্য উপকরণ নিবেদন করে পূজা অৰ্চনা করা হয়। এভাবে ভোরে সদ্য ওঠা সূর্যের প্রতি “ওম সূর্যায় নমঃ” মন্ত্রটি জপ করতে হয়। এই পূজার শেষে সূর্য দেবতা এবং আপনার পূর্ব পুরুষদের প্রতি আরতির রেওয়াজ রয়েছে। সেই সঙ্গে সূর্য দেবতা ও পূর্ব পুরুষদের ফল ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।

এই শুভ দিনটিকে অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বংশ পরম্পরায় মেনে চলেন। বাংলায় কন্যা সংক্রান্তিকে লক্ষ্মী পূজার মতো পালন করা হয়। এই দিনে কৃষকরা তাঁদের ফসলের পূজা করেন। অনেকে ভোরে উঠে শুদ্ধ বস্ত্রে কৃষি ক্ষেতে দুধ কলা সহকারে অর্ঘ নিবেদন করে থাকেন। এই দিনে অনেকে উপবাস থেকে ভগবানের ধ্যানে মগ্ন হন। এই দিনে সাত্বিক আহার গ্রহণের রীতি রয়েছে। অনেকেই এই দিনে ডাল, চাল, সব্জি, ফল সহকারে অন্ন গ্রহণ করে থাকেন।