গত বেশ কয়েকমাস ধরে সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী বিল ঘিরে কেন্দ্র সরকার ও বিরোধী সাংসদদের দ্বন্দ্ব চরমে। বিরোধীদের প্রতিবাদের জেরে একাধিকবার মুলতুবি হয়েছে অধিবেশন। বিলটির সংশোধনী নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠিত হলেও কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতৈক্য হয়নি। বরং বিরোধী সাংসদরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে শাসকদল ওয়াকফ বিলে সংশোধনী একতরফাভাবে এনেছে। আর সেই বিলটি লোকসভায় পাশ হয়ে গেলেও রাজ্য সভায় পাশ হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক সংশয়। রাজনৈতিক মহলে এই বিলটি নিয়ে জোর চর্চা শুরু হলেও অনেকের কাছে ওয়াকফ বিল সম্পর্কে ধারনা স্পষ্ট নয়। আদতে কী রয়েছে এই বিলে? কোন কোন বিষয়ে সংশোধনী আনার চেষ্টা করছে সরকার পক্ষ?
জানা গিয়েছে, ইসলাম ধর্মের মানুষের কাছে যে সম্পত্তি তাঁদের ধর্ম প্রচার ও উন্নতিকল্পে দান করা হয়, সেটিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে। সেভাবেই এই সম্পত্তি যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা মনে করেন, ওয়াকফ আসলে ঈশ্বরের সম্পত্তি। সেজন্য এই সম্পত্তি বিক্রি করা, এমনকি ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সারা দেশে ওয়াকফ বোর্ডের ৮.৭ লক্ষেরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে, যা ৯.৪ লক্ষ একর জুড়ে বিস্তৃত। রেল এবং ভারতীয় সেনার পর দেশে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডেরই।
সুলতানি যুগ অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এই ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য একটি কমিটি বা বোর্ড গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। বোর্ডের মূল কাজ হবে ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন পাশ হয়। ১৯৯৫ সালে সেই আইন সংশোধন করে ওয়াকফ বোর্ডকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরপর ২০১৩ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়ে আরও একবার ওয়াকফ আইন সংশোধন করা হয়।
এখন সবার মনে একটাই প্রশ্ন, এই ওয়াকফ সংশোধনী বিলে ঠিক কী রয়েছে? কী কী বিষয়ে পরিবর্তন আনতে চাইছে সরকার পক্ষ? আর সেই সংশোধনীর প্রয়োজনই বা হচ্ছে কেন? বিরোধীরাই বা কী চাইছেন?
এ বিষয়ে সরকার পক্ষের যুক্তি হল, বর্তমানে যে আইন রয়েছে, তাতে ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনও ভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকে না। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারে ওয়াকফ বোর্ড। কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির দাবি, ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মুসলিমরা। পরিবর্তে সমস্ত সুবিধা ভোগ করছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী। নতুন আইন কার্যকর হলে সাধারণ মুসলিমরা উপকৃত হবেন। তাছাড়া, সাচার কমিটির রিপোর্টেও বলা হয়েছিল ওয়াকফ নিয়মের সংস্কারের প্রয়োজন।
এবার দেখা যাক, ওয়াকফ সংশোধনী বিলে ঠিক কী বলা হয়েছে? জানা গিয়েছে, বর্তমান ওয়াকফ বিলের ৪০ নম্বর ধারা আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ডের দখল করা সম্পত্তি বা জমিতে কোনও রকম সরকারি পর্যালোচনা বা রিভিউ করা যায় না। কোনও পর্যালোচনা ছাড়াই ওয়াকফ বোর্ড জমি দখল করতে পারে। কোনও সম্পত্তি নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ওয়াকফ বোর্ডের আইনি বিবাদ চললেও তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না সরকার পক্ষ। মূলত এই আইনেই ওয়াকফ বোর্ডের অধিকার খর্ব করতে চাইছে সরকার। বিতর্কিত কোনও সম্পত্তির মালিকানা আদতে কার, তাও খতিয়ে দেখার আইনি এক্তিয়ার সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণেই রাখতে চাইছে।
এছাড়া নতুন সংশোধনীতে আরও একাধিক ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করতে চাইছে কেন্দ্র। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের সেই একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। পরিবর্তে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ক্ষমতা জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনও আধিকারিকের হাতে দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব।
বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিরোধীরা। আপত্তি উঠেছে নতুন বিলে ওয়াকফ বোর্ডে দুই অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বন্দোবস্ত নিয়েও। বিরোধীদের যুক্তি, এই বিল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সত্তায় আঘাত। বিশেষ করে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের প্রবেশ নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে বিরোধী শিবিরের। তাঁদের দাবি, একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে টার্গেট করার জন্য এই বিল আনা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের একাংশের ধারনা, এই আইন পাশ হয়ে গেলে ইসলামিক সম্পত্তি সরকার হস্তগত করবে।
প্রসঙ্গত পুরনো আইন অনুযায়ী, কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করলে, চিরদিনের জন্য সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবেই বিবেচিত হত। নতুন বিল পাশ হলে এবার সেই নিয়মকেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে। ফলে যে সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডের বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটি ইসলামিক ধর্মস্থান বা অন্য কোনও ইসলামিক প্রার্থনাস্থল তৈরি হলেও সেটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করা যাবে।