অপছন্দের দু’টি শব্দ

ভারতীয় সংসদ। ফাইল চিত্র

১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর প্রস্তাবনা সহ আংশিক সংবিধান গৃহীত হয়েছিল গণপরিষদে। সেই দিনটি স্মরণে ভারতে সংবিধান দিবস পালন করা হয়। মোদী সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২৬ নভেম্বর দিনটিতে সংবিধান দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

২০২৩ সালে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের সময় মোদী সরকার প্রত্যেক সাংসদকে স্মারক হিসাবে সংবিধানের একটি বই দিয়েছিল। সেটি ছিল সংবিধানের প্রথম সংস্করণের কপি। সেই সংবিধানে আরও অনেক কিছুর মতো ১৯৭৬ সালে যোগ হওয়া ‘সেকুলার’ শব্দটিও ছিল না। খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও বইয়ের সঙ্গে বইটির প্রথম সংস্করণটিও অতিরিক্ত সংযোজন হিসেবে ছাপা যেতেই পারে। তার একটি ঐতিহাসিক মূল্যও থাকে। কিন্তু সমস্ত সংশোধনী-সহ মূল বইটিকে বাদ দিয়ে যখন শুধু প্রথম সংস্কারণ স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়, তখন তার একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটাই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে ৬৬তম সাধারণতন্ত্র দিবসে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন দেয়। সেই বিজ্ঞাপনে সংবিধানের যে প্রস্তাবনা ছাপা হয়েছিল, সেখানেও ‘সেকুলারিজম’ এবং ‘সোশ্যালিজম’ শব্দ দু’টি ছিল না।

গত ২১ অক্টোবর শীর্ষ আদালতের বিচারপতি সঞ্জীব খান্না (তখনও তিনি প্রধান বিচারপতি হননি) এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্য সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর করা একটি মামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেকুলার’ এবং ‘সোশ্যালিস্ট’ শব্দ দু’টি ‘বেসিক স্ট্রাকচার’-এর অংশ এবং এই শব্দ দু’টি বিদেশে থেকে ধার করা নয়।


এই শব্দ দু’টি ভবিষ্যতে থাকবে কিনা, গত এক দশক ধরে লাগাতার বিরোধিতায় তা নিয়ে জনমানসে একটি সংশয় তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছে বিজেপি। যদি বিজেপি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত, সম্ভবত তারা চেষ্টা করত আরএসএস-এর শতবর্ষে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি মুছে দিতে। সেটা হয়নি। তবে তাতেই যে ভবিষ্যৎ নিরাপদ, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। হিন্দুত্ববাদীদের বক্তব্য, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি অ-ভারতীয়, বিদেশ থেকে আমদানি করা। আরএসএস-এর একটানা ৩৩ বছরের সরসঙ্ঘচালক এমএস গোলওয়ালকরও এমন মত দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন লেখাপত্রে।

সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দু’টি বাদ দেওয়ার জন্য বিজেপির চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট ব্যাখ্যায়। এই সংক্রান্ত এক মামলার আবেদন নাকচ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই রায়ে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দু’টি ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সংবিধানের মৌলিক চরিত্রেরই পরিচয় বহন করছে।

জরুরি অবস্থার সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবিধান সংশোধন করে প্রস্তাবনায় এই দু’টি শব্দ যুক্ত করেছিলেন বলে মামলার আবেদন বলা হয়েছিল সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন করতে পারে না সংসদ। সেই যুক্তি খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলেছে, এই ক্ষমতাও প্রশ্নাতীতভাবেই সংসদের আছে। সংবিধানের ৩৬৮ নম্বর ধারায় সংসদকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ওই ধারায় বলা আছে, সংবিধান সংশোধন করে এর মৌলিক চরিত্রকে বদলে দেওয়া যাবে না এবং কোনও মৌলিক বা সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা যাবে না। ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দু’টি কোনওভাবেই সংবিধানের মৌলিক চরিত্রকে আঘাত করেনি, বরং এই শব্দ দু’টি তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

এই মামলা দায়ের করেছিলেন বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এবং আরএসএস-পন্থী বলে পরিচিত শীর্ষ আদালতের আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায়। তাই বিরোধী রাজনৈতিক মহলের মতে, বকলমে বিজেপি-ই এই মামলা দায়ের করেছিল। মতাদর্শগতভাবেই আরএসএস সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ দু’টির ঘোর বিরোধী। ২০২০ সালে প্রথম এই সংশোধনী বাতিলের আরজি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন জনৈক বলরাম সিং। তারপরে একই আবেদন জানান স্বামী ও উপাধ্যায়। তিনটি আবেদনেরই শুনানি শেষে এই রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধান দিবসের পূর্ব মুহূর্তে শীর্ষ আদালতের এই রায়ে দেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হল।