খলিস্তানি ইস্যুতে ভারত-কানাডা সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে নিজ্জর খুনের পর থেকেই অবনতি ঘটে চলেছে ভারত-কানাডা সম্পর্কের। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতবিরোধী খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দিচ্ছেন। এমনকি, তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের মধ্যেও রয়েছেন খলিস্তানপন্থীরা। ভারতে ফিরে এই অভিযোগ করেন প্রাক্তন কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয় বর্মা। কানাডায় ক্রমবর্ধমান খালিস্তানি নেটওয়ার্ক নিয়েও মুখ খুললেন সেদেশ থেকে ফিরে আসা ভারতীয় হাইকমিশনার।
এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে কানাডায় প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত সঞ্জয় বর্মা জানান কিভাবে তাঁকে কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা খলিস্তানিদের কাছ থেকে ক্রমাগত হুমকির মধ্যে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্যরা রাস্তায় বেরোলে খলিস্তানি চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে পড়েছে। এতে যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। তাই নিরাপত্তা শুধুমাত্র কূটনীতিক এবং কর্মকর্তাদের জন্যই নয়, আমাদের পরিবারের সদস্যদের চলাফেরার ক্ষেত্রেও সমস্যা ছিল। এইভাবে দিনের পর দিন হুমকি আসতে থাকে।’ তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ, কানাডার ফেডারেল পুলিশিং এজেন্সি, কিছু নিরাপত্তা সংস্থা তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষা করেছে।
সঞ্জয় বর্মা জানান, ‘খলিস্তানি চরমপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত দুটি নিষিদ্ধ সংগঠন আমাদের লক্ষ্য করে বেশিরভাগ হুমকি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে অনেকে কনস্যুলেট বা হাই কমিশনের সামনে জড়ো হয়ে আমাদের ভয় দেখানোর জন্য স্লোগান দিত। যখনই আমরা পাবলিক ইভেন্টে যোগ দিতাম, তারা আবার আমাদের ভয় দেখানোর জন্য স্লোগান দিত। কিন্তু আমরা সবাই এর জন্য প্রস্তুত থাকতাম। ফলে তাদের ভয় দেখানোর কৌশল কাজ করেনি। আমরা ভারতের জাতীয় স্বার্থের জন্য সেখানে ছিলাম এবং তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম।’
গত ১৩ অক্টোবর কানাডা পুলিশের ‘ইন্টিগ্রেটেড হোমিসাইড ইনভেস্টিগেশন টিম’ -এর রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ট্রুডো সরকার জানিয়েছিল সে দেশের মাটিতে খলিস্তানপন্থী জঙ্গি হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে খুনের ঘটনায় ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয়ের ‘স্বার্থ’ জড়িত ছিল। ওই অভিযোগের পরই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। সঞ্জয় বর্মা-সহ কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে আনে নরেন্দ্র মোদী সরকার। একইসঙ্গে দিল্লির কানাডা হাই কমিশনের কয়েক জন কূটনীতিককেও বহিষ্কার করা হয় ।
উল্লেখযোগ্য হল, এখন ট্রুডোর দল লিবারেল পার্টির অন্দরেই ট্রুডোর পদত্যাগের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। জানা গিয়েছে, লিবারেল পার্টির একাধিক সাংসদ প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ইস্তফার দাবি করেছেন। আগামী ২৮ অক্টোবর সময় বেঁধে দিয়েছেন তাঁর দলের সাংসদরা। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, চূড়ান্ত ভারত বিরোধিতার মাশুল গুনতে হচ্ছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে। এই আবহে ভারতে ফিরে সঞ্জয় শুক্রবার বলেন, ‘‘ট্রুডোর বৃত্তে অনেকে আছেন, যাঁরা ভারতবিরোধী এবং খলিস্তানপন্থী। ২০১৮ সালে তাঁর ভারত সফরের সময় কোন খলিস্তানপন্থীদের দেখা গিয়েছিল, তা আমরা সকলে জানি।’’ প্রসঙ্গত, ট্রুডোর ওই সফরের সময় কানাডা সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল খলিস্তানপন্থী জশপাল সিংহ অটওয়ালকে।
বিদেশ মন্ত্রকের তরফে পাল্টা অভিযোগ করা হয় যে, কানাডার আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী খলিস্তানি গোষ্ঠীগুলির সমর্থন পাওয়ার জন্য ট্রুডো সরকার নতুন করে নিজ্জর বিতর্ক তৈরী করছে। খলিস্তানি নেতা নিজ্জরকে ২০২০ সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিল ভারত। তিন বছর পর ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডায় একটি গুরুদ্বারের সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর পরে নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘ভূমিকা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন ট্রুডো। যদিও কানাডায় প্রাক্তন ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয় বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত ট্রুডো সরকার এ বিষয়ে আদালতগ্রাহ্য কোনও তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেনি।’
সঞ্জয় বর্মা জানান, ভারত থেকে যেসকল পড়ুয়ারা কানাডায় যান, তাঁদের মগজধোলাই করে দলে টানার চেষ্টা করে খালিস্তানিরা। এই পরিস্থিতিতে কানাডায় যে সব অভিভাবকরা উচ্চশিক্ষার জন্য সন্তানদের পড়তে পাঠান তাঁদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলেন সঞ্জয় বর্মা। পাশাপাশি কানাডায় পড়তে যাওয়া ভারতীয় পড়ুয়াদের উদ্দেশে তাঁর সতর্কবাণী , আশেপাশে কী ঘটছে, সেই বিষয়ে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে পড়ুয়াদের।
সঞ্জয় বর্মা বলেন, ‘মগজধোলাই হওয়া পড়ুয়াদের নিয়ে গিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে প্রতিবাদে সামিল করানো হয়। তাঁদেরকে দিয়ে জোর করে সেই সব প্রতিবাদের ছবি তোলানো হয়। এমনকি ভারতীয় পতাকার অবমাননা করানো হয়। সেই ঘটনার ভিডিও করানো হয়। এরপর বলা হয়, ভারতে ফিরে গেলে শাস্তি পেতে হবে। কানাডা সরকারের কাছে আশ্রয় চাইতে বাধ্য করা হয় সেই সব পড়ুয়াদের।’
সঞ্জয় বর্মা জানান, ‘একজন কূটনীতিক হিসেবে তিনি অবশ্যই আশাবাদী। তবে কানাডা সরকারের তরফ থেকে উদ্ভূত এই উদ্বেগ আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করে। তাই, কানাডার কর্তৃপক্ষের উচিত আমাদের মূল উদ্বেগগুলি বিবেচনা করা। যতদিন তা না করা হবে, আমরা মনে করি না যে আমাদের দেশের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকবে।’