• facebook
  • twitter
Sunday, 22 September, 2024

বার বার যাওয়ার আকর্ষণ চটকপুর

রূপা মজুমদার উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দার্জিলিংকে তাদের গ্রীষ্মের শৈলাবাস হিসেবে পছন্দ করেছিল, গড়ে তুলেছিল স্যানাটোরিয়াম, বিস্তৃত চা বাগান। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এ রাজ্যের মানুষ পাহাড়ি সৌন্দর্যে ভরা ট্যুরিস্ট স্পট বলতে বোঝেন দার্জিলিং এবং তার সঙ্গে আছে কালিম্পং ও কার্শিয়ংশ অথচ দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র পঁচিশ-ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের বুকে ছোট্ট

রূপা মজুমদার

উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দার্জিলিংকে তাদের গ্রীষ্মের শৈলাবাস হিসেবে পছন্দ করেছিল, গড়ে তুলেছিল স্যানাটোরিয়াম, বিস্তৃত চা বাগান। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এ রাজ্যের মানুষ পাহাড়ি সৌন্দর্যে ভরা ট্যুরিস্ট স্পট বলতে বোঝেন দার্জিলিং এবং তার সঙ্গে আছে কালিম্পং ও কার্শিয়ংশ অথচ দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র পঁচিশ-ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের বুকে ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম চটকপুর একবার গেলে, বারবার যেতে হবে, এমনই তার আকর্ষণ। চারিপাশে চোখ জুড়োনো সবুজের সমারোহ, একটু দূরে বরফে ঢাকা হিমালয়, খুব সকালে আর গোধূলিতে পাখির কলতান আর পাইনের বনের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা ঠান্ডা হিমেল বাতাস। এখানে সুখে শান্তিতে অনায়াসে দু-তিনটে দিন কাটিয়ে আবার সতেজ হয়ে শহরে ফেরা যায়। হুড়োহুড়ি করে কিছু দেখার নেই, কেনাকাটার জন্য রকমারি পশরা সাজানো দোকান নেই। এখানে হৃদয়ের শান্তি সহজে পাওয়া যায়, স্মৃতিতে গেঁথে রাখার মতন আনন্দ সঙ্গে করে নিয়ে শহরে ফেরা যায়।
টাইগার হিলের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত চটকপুর। জেলা দারজিলিং , পোস্ট অফিস সোনাদা, ব্লক চটকপুর। উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ৭৮০০ ফুট, তার মানে দার্জিলিঙের থেকেও ২০০০ ফুট উঁচুতে এর অবস্থান। এলাকাটি সিঞ্চল ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বা অভয়ারণ্যের অধীনের বনাঞ্চল। সরকারি ভাবে নাম চটকপুর ইকো ভিলেজে কমপ্লেক্স। বন –দপ্তর অধিগ্রহন করে কন্সারভেটর অফ ফরেস্ট মি. টি. ভুটিয়া ২০০৯ সালের মার্চ মাসে চটকপুর গ্রামের উদ্বোধন করার ফলে অখ্যাত গ্রামটি মর্যাদা পেল ইকো ট্যুরিস্ট স্পট-এর। এখানে বাস করে মূলত নেপালিরা, কয়েক প্রজন্ম ধরেই। হাতে গোণা কয়েক ঘর পাহাড়ি মানুষের জীবিকা আগে ছিল চাষ আবাদ, গোরু, হাঁস–মুরগী পালন আর সাইকেলে চড়ে দূরের গ্রামে দুধের যোগান দেওয়া। ইদানীং স্বীকৃত ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে যাওয়াতে গ্রামের মানুষের গ্রাসাচ্ছদনের নতুন এক দিশা পায়। এই শান্ত গ্রামের মানুষের এখন অন্যতম জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্যুরিস্টের জন্য হোম-স্টের ব্যবস্থা রাখা। অতএব একবার কষ্ট করে সেখানে যেতে পারলে থাকার জায়গার অভাব হবেনা।
কী করে যাবেন :
প্রাথমিক গন্তব্য – প্লেনে এলে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট , আর ট্রেণযাত্রায় নিউ-জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে ভাড়া গাড়ি নিয়ে সোজা চটকপুর ইকোভিলেজ। সময় লাগে আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘন্টা। দূরত্ব প্রায় ৬৪ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং-এর পথে হিল কার্ট রোড অথবা রোহিণী রোড ধরে সোজা কার্শিয়ং, তারপর সেখান থেকে সোনাদা পৌঁছলে আর মাত্র ৬-৭ কিলোমিটার দূরে চটকপুর। তবে সোনাদা থেকে ফরেস্টের ভেতরের রাস্তা যথেষ্ট খারাপ, ড্রাইভাররা দূরত্ব বাঁচাতে এ পথই সচরাচর ধরে থাকে। গাড়ির ঝাঁকুনির জন্য শারীরিক আসাচ্ছন্দ্য অবশ্য ভুলিয়ে দেবে যাত্রা পথের দুধারের ঘন বনানী, অফুরন্ত সবুজের সমারোহ, আর আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে দেখা যাবেই অরণ্য শীর্ষের ফাঁকে ফাঁকে নির্মল আকাশ। যেহেতু এটি অভয়ারণ্যের মধ্যে, তাই বন-দপ্তরের কাছে শুল্ক জমা দিতে হয়, সে ব্যবস্থা অবশ্য হোম-স্টে করে রাখতে পারে।
থাকার জায়গা –
পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি যখন ঢুকবে, চোখে পড়বে কংক্রিটের তোরণের মাথায় বড় বড় করে লেখা আছে “ওয়েলকাম টু চটকপুর ইকো ভিলেজ”।
প্রচুর প্রাইভেট হোমস্টে। ভাড়া মোটামুটি সবারই অল্প-বিস্তর এক। ঘরগুলো যদিও তেমন বড় নয়, ভাড়া স্থির হয়, মাথা পিছু এবং দিন পিছু। অতিথি আপ্যায়নে এঁরা সিদ্ধহস্ত। ঠান্ডা যথেষ্ট, তাই সব ঘরেই লাগোয়া টয়লেটে গিজারের ব্যবস্থা থাকে, আর থাকে চারবেলা ঘরোয়া খাওয়ার ব্যবস্থা। বেডটি, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, বিকেলের স্ন্যাক্স, আর ডিনার, পাহাড়ি মানুষ যত্নের কোন ত্রুটি রাখেনা। লুচি, রুটি, পাঁউরুটি, পরোটা, মোমো, আচার, ভাত, ডাল, সবজি, ডিম, মুরগী, শূয়োরের মাংস থাকেই। হোম-স্টেগুলো পাহাড়ের ওপরে ধাপে ধাপে সাজানো, স্থানীয় মানুষের ভাষায় “আপার চটকপুর”, পাহাড়ের মাঝামাঝি অবস্থানেও আছে গুটি কয়েক হোমস্টে, আর লোয়ার চটকপুরে অর্থাৎ ইকো ভিলেজ শুরুর মুখেই রয়েছে একটি সাজানো গোছানো প্রাইভেট হোম-স্টে। তবে এখানে সব চেয়ে আরামের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, অতি প্রশস্ত সরকারি ফরেস্ট কটেজে। বিশাল বিশাল ঘর, কাঠের আসবাবে সাজানো, ঘরের দু পাশে চওড়া বারান্দা, বারান্দায় বসে বনের সৌন্দর্য আর পাখির ডাক সারাদিন ধরে দিব্য উপভোগ করা যায়। ফরেস্ট কটেজে থাকার জন্য আগে থেকে অন-লাইনে বুক করা যায়।
দ্রষ্টব্য –
দৃষ্টির নাগালে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজংঘা, পাইনের জঙ্গল, অজস্র নাম না জানা গাছ, পাখির কলতান, উদ্ধত লাল, হলুদ, সাদা রডোড্রেন্ডন, স্নিগ্ধ সূর্যোদয়, বিকেলের নীলিমায় পাহাড়ের আড়ালে অস্তমিত সূর্যের রশ্মি মাখা মায়াবী গোধূলি। এখানে যা কিছু দেখার সবই পায়ে হেঁটে দেখতে হবে। হাঁটা পথের শেষে দেখা দেবে কালো জলে ভরা ছোট্ট এক পুকুর, জলের মধ্যে বিশালাকার এবড়ো খেবড়ো কালো পাথর। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস এই “কালা পোখরি এক পবিত্র স্থান। পুকুরের পাড়েই রয়েছে অস্থায়ী মন্দির। এ পথে বন্য প্রাণি-চিতা, ভাল্লুক, হরিণ এমনকি কপাল ভাল থাকলে রেড পান্ডার দেখাও মিলতে পারে। এ পথেই একটা বিশেষ জায়গা থেকে ধাপে ধাপে পাথুরে পথ নীচে চলে গেছে মংপুর দিকে। স্থানীয় মানুষ এ পথে দিব্য যাতায়াত করে। ফরেস্ট কটেজ থেকে পাহাড়ের ধাপ পেরিয়ে ওপরে বেশ কিছুটা হাঁটা পথে পড়বে “সান রাইস পয়েন্ট”। আদতে এটি একটি “ওয়াচ টাওয়ার”। খুব সকালে এখানে এসে দাঁড়ালে ৩৬০ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্ব জুড়ে পাহাড়ের দৃশ্য অপূর্ব লাগবে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সেখান থেকে সান্দাকফুও চোখে পড়তে পারে।
দার্জিলিঙের ভিড় এড়িয়ে এখানে নাকি রোজ নিয়ম করে লোকে বেড়াতে আসছে। আসে স্থানীয় স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা, জৈব বৈচিত্র্যের পাঠ নিতে। এ গ্রাম নরবু শেরপা, তিলবাহাদুর রাই, নাগপা থাপা, শ্যাম থাপাদের নিজস্ব বনভূমি। এ তল্লাটকে এরা যত্নে আগলে রাখছে। প্রকৃতিও তাই এখানে উজাড় করে সমস্ত বনজ মায়া ঢেলে দিয়েছে।