• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

নির্জনতার খোঁজে……

অভিজিৎ লাহিড়ী উঠলো বাই তো পুরী যাই। আরে, সমুদ্র তো আশেপাশেই আছে… দিঘা মন্দারমণি, ডায়মন্ড হারবার, হেনরি আইল্যান্ড। এমন কি মৌসুনি দ্বীপ বা বকখালি। কিন্তু পুরীর সাগর নাকি একেবারে আলাদা! কেন ভাই? বঙ্গোপসাগর বলেই তো জানি এতকাল। এখানে নাকি বড় বড় ঢেউয়ে উল্টে পাল্টে বালি মাখতে মাখতে নাইবার তুলনা মেলা ভার। তাছাড়া জগন্নাথের ভোগ! কি

অভিজিৎ লাহিড়ী

উঠলো বাই তো পুরী যাই। আরে, সমুদ্র তো আশেপাশেই আছে… দিঘা মন্দারমণি, ডায়মন্ড হারবার, হেনরি আইল্যান্ড। এমন কি মৌসুনি দ্বীপ বা বকখালি। কিন্তু পুরীর সাগর নাকি একেবারে আলাদা! কেন ভাই? বঙ্গোপসাগর বলেই তো জানি এতকাল। এখানে নাকি বড় বড় ঢেউয়ে উল্টে পাল্টে বালি মাখতে মাখতে নাইবার তুলনা মেলা ভার। তাছাড়া জগন্নাথের ভোগ! কি স্বাদ আর কি সুবাস! এই তিন ভাই বোনের কৃপায় সারা বছর ধরে পুরো ভারতবাসীর কোনো না কোনো সময়ের ঠিকানা পুরী। আমরা ছয় বন্ধুও ঘুরে এলাম তল্পিতল্পা নিয়ে। 

ওহো আসল কথাই বলা হয়নি। এই গরমে সাত ঘণ্টা ধরে বন্দে ভারতের হিমশীতল ঠান্ডা উপভোগ মনকে প্রফুল্ল করে দিয়েছিল যাওয়া আসার পথে। উঠেছি এশিয়ান বিচ ইন হোটেলের সী ভিউ ডিলাক্স কামরায়। উপরি পাওনা মিত্র কাফের রেস্টুরেন্ট একেবারে পাশেই। কচু পাতা দিয়ে চিংড়ির ঘন্ট আর কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে পেট পুজো। ইসস মনে করতেই জিভে জল চলে আসছে। বাঙ্গালী খেয়ে বাঁচো। জানেন, খুব দুঃখ হয় বিদেশিদের জন্য। কয়েকবার বাইরে বেড়াতে যাবার সূত্রে দেখেছি, তেনারা চেনেন শুধু বার্গার, পিৎজা আর স্যান্ডউইচ । সরষে পাবদা, ইলিশ ভাপা বা কচি পাঁঠার মাংসের স্বাদ এই জীবনে বুঝলোই না। অবশ্য দেখেছি দিন দিন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে এর সংখ্যা আর তাতে ভীড় বাড়ছে। শুধুই উন্নত দেশ হলে তো হবে না জানতে হবে বাসনার সেরা বাসা রসনায়।
পুরীতে এবারে ছিলাম চার রাত্রি পাঁচ দিন। অতীব এক পূণ্য তিথিতে আমাদের পদার্পণ ঘটেছিল শ্রীক্ষেত্রে। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উৎসব। এ সম্বন্ধে দু এক কথা না বললেই নয়। স্কন্দপুরাণে উল্লিখিত আছে মালব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রধান মন্দির তৈরী করেছিলেন রাজা অনন্তবর্মন দশম শতাব্দীতে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে বর্তমান মন্দিরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কলিঙ্গ শৈলীর স্থাপত্যের অপরূপ নমুনা এই বিশাল দেবালয়, যার প্রতিটি অংশে খোদাই আর ভাস্কর্যের মনোরম মেলবন্ধন। মহাবিশ্বের প্রভু জগন্নাথ দেবের মর্ত্যে আগমন ঘটেছিল দেবস্নান পূর্ণিমায়। স্বয়ম্ভু মনুর যজ্ঞের প্রভাবে এই আবির্ভাব এবং মনুর নির্দেশেই এই তিথিতে পালিত হয় জগন্নাথের জন্মোৎসব। রথযাত্রার পনের দিন আগে এই মহোৎসবে মেতে ওঠে আপামর জনগণ।
মহাস্নানপর্বের সূচনায় তিন দেবদেবীকে মন্দিরের প্রধান সেবায়েতরা পুজো করেন। তারপর স্নানবেদীতে তিন ভাইবোনকে নিয়ে আসা হয়। চামর আর তালপাতা দিয়ে বাতাস করতে করতে সাজিয়েগুজিয়ে মঞ্চে উপস্থিত করা হয়। সেখানে তখন চলে মঙ্গল আরতি আর সূর্য আরাধনা। মন্দিরের দক্ষিণ দিকের দরজার পাশের কুয়ো থেকে ১০৮ ঘটি জল তুলে তার মাধ্যমে চলে স্নানপর্ব। এরপর দুই ভাইকে পরানো হয় গজবেশ কিন্তু হিমশীতল জলে অবগাহন করে তিনজনেরই আসে প্রবল জ্বর। মন্দিরের অন্য এক ঘরে চিকিৎসা শুরু হয়। রাজবৈদ্যের দেওয়া ওষুধ ও পথ্য খেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পনের দিন বাদে নবমূর্তিতে সুসজ্জিত হয়ে দেখা দেন তারা। সেই উৎসবের নাম হল নেত্রোৎসব।
ভিন্ন মতে জানা যায় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বয়ং জগন্নাথদেব নির্দেশ দিয়েছিলেন, স্নানের পর তাঁর অঙ্গরাগ বিহীন রূপ যেন কেউ না দেখেন। তাই ১৫ দিন মন্দিরের দরজা সাধারণের জন্য বন্ধ থাকে। তিনজনের পটচিত্রে কেবল শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুমতি মেলে। আমাদের পান্ডার পারদর্শিতায় এই গজবেশে সজ্জিত তিন দেবদেবীকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাও প্রায় তিন ঘণ্টার ধাক্কা। গরমে খালিপায়ে বিস্তর হাঁটাহাঁটির পর দর্শন মিলেছিল প্রভুর। আপ্তবাক্যটি স্মরণে ছিল ‘কষ্ট ছাড়া কি কেস্ট লাভ হয়’।
পুরী মানেই চক্রতীর্থ রোডের হোটেল সমুদ্র থেকে মেরিন ড্রাইভে একেবারে স্টার্লিং রিসোর্ট পর্যন্ত লম্বা সমুদ্রতট।স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি অঞ্চলের বীচে এত বেশি দোকানপাট যে সমুদ্রের দেখা মেলাই ভার। এখন এই ভীড় মেরিন ড্রাইভ এর অনেকটা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে অত্যন্ত বিরক্তিকর ভাবে। যারা সাগরের জলকল্লোল শুনতে চান বা অবিশ্রান্ত ঢেউয়ের ভাঙ্গা গড়া দেখতে চান, তাদের চলে  যেতে হবে অনেকটা দূরে। যারা ভীড় ভালোবাসেন, চাট মসলা খেতে পছন্দ করেন এবং দোকানপাট ঘুরে ঝিনুকের গয়না কিনতে চান, তাদের জন্য আদর্শ স্থান স্বর্গদ্বারের সমুদ্র সৈকত। আমরা একদিন গিয়েছিলাম গোল্ডেন বিচে । ওটিডিসি পান্থনিবাসের কাছে এই জায়গায় ঢোকার প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি কুড়ি টাকা। সাজানো গোছানো নিভৃত মনোরম এই তটভূমি। লোকের ভীড় কম। একপাশে বাগান আর তার পাশেই গোল্ডেন প্যালেস হোটেল। ঘর ভাড়া পাঁচ হাজারের আশেপাশে। কিন্তু অপূর্ব এর অবস্থানগত বৈচিত্র্য। ঘরের বারান্দায় বসে থেকে সারাদিন অনুভব করা যায় সাগরের গোপন কথা, প্রাণভরে পরশ মেলে লোনা বাতাসের আর চেখে নেওয়া যায় নিজের বিবেককে। তরঙ্গায়িত ফেনিল জলরাশির উচ্চকিত কলরোলে যেন ঘোষিত হয় প্রকৃতির জয়গান। স্বর্ণবালুময় এই সাগরবেলায় সময় কেটে যায় এই ভাবেই।
পুরীর আশেপাশে বেড়ানো মানেই কোনারক, চন্দ্রভাগা বীচ, চিলকা বা ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির বা উদয়গিরি খণ্ডগিরি ও নন্দনকানন। প্রত্যেকটি স্থানই নিজ গুণে মহিমান্বিত। এবং প্রায় প্রতিটি পুরী ভ্রমনার্থীর এক বা একাধিক বারের ডেস্টিনেশন। হাজারো ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিনিয়ত নিয়ে চলেছে মানুষদের এই সব জায়গাতে। তাই এবার আমরা বেছে নিয়েছিলাম এমন দুই পর্যটন কেন্দ্র যার নামই শোনেনি বহু  লোক। দেরাস বাঁধ আর ছন্দক অভয়ারণ্য। ভুবনেশ্বর থেকে মাত্র কুড়ি কিমি, কটক থেকে তিরিশ কিমি এবং পুরী থেকে প্রায় আশি কিমি দূরে খোরদা অঞ্চলের অন্তর্গত দেরাসে যখন পৌঁছালাম, তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে। জন প্রতি চল্লিশ টাকা টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম জঙ্গল এলাকায়। সুন্দর পায়ে চলা রাস্তায় গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলাম উঁচু বাঁধের দিকে। হঠাৎই দেখা মিলল বিস্তীর্ণ সেই জলাধারের। 1967 সালে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের আওতায় গঠিত হয় দেরাস। চতুর্দিকে পাহাড় আর নিবিড় বনানীর মাঝে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে অবস্থান করছে এই জলাশয়। যখন রাত্রি নামে, বন্য পশুরা এখানে ভীড় করে জল পানের উদ্দেশ্যে। দিনের বেলায় বোটিং এর বন্দোবস্ত আছে। আছে ভিউ পয়েন্ট, যেখানে দাঁড়িয়ে সময় কেটে যায় কোনো হিসেব না রেখেই। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় অতি মনোরম ও মায়াবী হয়ে ওঠে চতুর্দিক। শীতকালে এখানে বসে চড়ুইভাতির আসর। প্রকৃতির কোলে নির্মল একটা দুপুর বা বিকেল কাটাতে ছুটে আসে আশেপাশে বা দূরের লোকজন। কাছেই আছে ফার্ম হাউস এবং দেরাস নেচার ক্যাম্প। এক ঝলক দেখা গেল ফরেস্ট রেস্ট হাউস। বাঁধের ওপরেই। সব মিলিয়ে এক দুর্দান্ত পরিবেশ যা মনকে নাড়া দেবেই।
দেরাস থেকে মোটামুটি পনের কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হাজির হলাম ছন্দক ডামপাড়া অভয়ারণ্যে। প্রবেশপথটি সুসজ্জিত। এখানে জঙ্গল সাফারির বন্দোবস্ত আছে। গাড়ী পিছু ভাড়া ১৫৭৫ টাকা। এক ঘণ্টার ট্রিপ। গভীর শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য। পথের বাঁকে প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা পাইথনের দেখা মেলা অথবা হস্তিযুথের মুখোমুখি হওয়া কিছু মাত্র আশ্চর্যের নয়। আছে লেপার্ড, ভালুক আর হরিণ। তবে মূলতঃ এটি হস্তীদেরই বিচরণভূমি। যে সব হাতিরা বিগড়ে যায়, তাদের ঠিক পথে ফেরানোর জন্য আছে পুনর্বাসন কেন্দ্র। সেখানেই দেখা মিলল শঙ্করের। কি যে তার মাথায় ভূত চেপেছিল, কে জানে! এ পর্যন্ত পাঁচ জন মানুষকে সে কোনো না কোনোভাবে পরপারে পাঠিয়েছে, এমন কি তার মাহুত বাবাজিকেও ছাড় দেয় নি। পুরোদমে চিকিৎসা চলছে ওর। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে ফিরবে নিজদলে। ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় উঠে দেখি এক বিশাল প্যানোরামা। আদিগন্ত বিস্তৃত পর্বতরাজি আর গহন গভীর অরণ্যে চারদিক পরিপূর্ণ। তার মধ্যে দেখা যায় এক জলাশয়….নাম তার কুমারখুন্তি। ছন্দকের বন্যপ্রাণীদের জলপানের ব্যবস্থা এখানেই। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটাও বেশ গা ছমছমে। ঘণ্টাপোকার শব্দ আরো যেন রহস্যময় করে তুলছে পথকে। মাঝে মাঝেই গাড়িচালক গাড়ি থামিয়ে নজর দিচ্ছেন জঙ্গলের গভীরে। আমরাও পরম আগ্রহে তাকিয়েছি সেই পানে। চোখে কিছু পড়ে নি। কিন্তু পথের শোভা বড়োই মনোমুগ্ধকর। খানিকটা অজানা এই ছন্দক অভয়ারণ্য আর তার কুমারী রূপ আমাদের মনে এক স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে ফুর্তিতে এইভাবেই কাটলো বেশ কয়েকটা দিন কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকে না। একসময় ঘরে ফিরতেই হয়। চার পাঁচ দিন পুরীতে কাটিয়ে আর মিত্র কাফের খাবার খেয়ে চরম উজ্জীবিত হয়ে কলকাতা ফিরলাম বন্দে ভারতে।