• facebook
  • twitter
Tuesday, 26 November, 2024

অবহেলায় শশাঙ্কের কর্ণসুবর্ণ

অন্তরা ঘোষ ঐতিহাসিক  শহর মুর্শিদাবাদ… মুর্শিদাবাদের আনাচে-কানাচে অলিতে গলিতে ইতিহাস ছডি়য়ে ছিটিয়ে আছে.. আকাশে বাতাসে আজও নবাবী আমলের  ইতিহাসের মেঘমালা ভেসে বেড়ায়৷ মুর্শিদাবাদের সালারের নিকটস্থ মালিহাটি স্টেশন সংলগ্ন গ্রামে দেশের বাডি় হওয়ায় যখনই পুজোর সময় গ্রামের বাডি় যাই অবশ্যই একদিন লালবাগ ও তার আশেপাশে অতীত ইতিহাসকে খুঁজতে বেরিয়ে পডি়৷ লক্ষ্য করেছি যে হাজারদুয়ারি ও খোশবাগ

অন্তরা ঘোষ

ঐতিহাসিক  শহর মুর্শিদাবাদ… মুর্শিদাবাদের আনাচে-কানাচে অলিতে গলিতে ইতিহাস ছডি়য়ে ছিটিয়ে আছে.. আকাশে বাতাসে আজও নবাবী আমলের  ইতিহাসের মেঘমালা ভেসে বেড়ায়৷ মুর্শিদাবাদের সালারের নিকটস্থ মালিহাটি স্টেশন সংলগ্ন গ্রামে দেশের বাডি় হওয়ায় যখনই পুজোর সময় গ্রামের বাডি় যাই অবশ্যই একদিন লালবাগ ও তার আশেপাশে অতীত ইতিহাসকে খুঁজতে বেরিয়ে পডি়৷ লক্ষ্য করেছি যে হাজারদুয়ারি ও খোশবাগ অঞ্চলে রোজ অজস্র পর্যটকদের ভিড়.. হয়তো নবাবী আভিজাত্য, গরিমা ও ঘটনা বহুল নবাবী ইতিহাস পর্যটকদের আকর্ষণ করে৷ কিন্ত্ত মুর্শিদাবাদের এমন কিছু প্রাচীন জায়গা আছে যা গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে অথচ লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রায় অবহেলিত হয়ে পডে় আছে৷
এমনই একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থান হল কর্ণসুবর্ণ .. বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী৷ কর্ণসুবর্ণকে দেখতে জানতে চিনতে ও ইতিহাসকে অনুভব করতে একদিন বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে মালিহাটি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে বসলাম৷ কয়েকটা স্টেশন পরেই কর্ণসুবর্ণ৷ সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা কর্ণসুবর্ণ, এ ছাড়া স্টেশনের বিশেষ কোনো চাকচিক্য বা জৌলুস চোখে পড়ল না৷ টোটোতে উঠে বসলাম ঠিক হলো টোটোওয়ালা আমাদের চাঁদিপাড়ায় প্রায় দুশো বছর পুরনো নীলকুঠি, রাজবাডি়ডাঙ্গায় রাজা কর্ণের প্রাসাদ বলে পরিচিত ঐতিহাসিক স্থান, উৎখননের ফলে প্রাপ্ত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ  এবং রাক্ষসী ডাঙ্গা যেখানে খননকার্যের ফলে প্রাচীরের অংশবিশেষ ও কিছু কিছু  মূর্তি প্রাপ্ত হয়েছে এইগুলি দেখাতে নিয়ে যাবে৷
প্রথমে  চলেছি রাঙ্গামাটি চাঁদপাড়ার  উদ্দেশ্যে নীলকুঠি দেখতে৷ পিচ রাস্তার দু’ধারে কোথাও সবুজ ধানক্ষেত , কোথাও বিভিন্ন রকম সবজির বাগান, আবার কোথাও পুকুরে হাঁসদের জলকেলি.. প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি…
নীলকুঠি দেখার আগে চলুন প্রায় আড়াইশো বছর আগের ইতিহাসের পাতা উল্টে একটু দেখি৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পে ইংল্যান্ড বাণিজ্যিকভাবে প্রভূত সাফল্য পায়৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যে এই সময় নীলের চাহিদা বাডে়৷ কোম্পানি নীলকর সাহেব নামক ইংরেজ কর্মচারীদের সাহায্যে ভারতের গরীব চাষীদের জোরপূর্বক নীল চাষ করাতো৷ চাষীরা নীল চাষ করতে রাজি না হলে তাদের ওপর চলত প্রভূত অত্যাচার৷ মাত্র ২ টাকা দাদন দিয়ে চাষীদের ধান জমিতে জোর করে নীল চাষ করানো হতো৷ চাষীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি নীল থেকে মুনাফা লুটতো নীলকর সাহেবরা৷
ভারত তথা বাংলা এবং মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় নীলকুঠি ছিল৷ নীল চাষীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমাহীন হয় তখন চাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে৷ ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয় নীল বিদ্রোহ৷
চাঁদপাড়ায় ঢুকে স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল গলি দিয়ে ঢুকে শেষ প্রান্তে নীলকুঠি৷সরু গলি দিয়ে একটু ঘিঞ্জি এলাকায় ঢুকে পড়লো আমাদের টোটো৷ দু’ধারে বাডি় চারিদিকে মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও কোথাও স্তুপাকৃতি আবর্জনা পডে়.. বেশ নোংরা পরিবেশ৷ গলির একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ইঁটের লম্বা চিমনি চোখে পড়ল৷ স্থানীয় লোকে বলল এই জায়গাটাই নীলকুঠি নামে পরিচিত৷ যদিও কোন নীল কুঠির অস্তিত্ব আর নেই,  সেই সময়কার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসেবে রয়েছে শুধুমাত্র এই নীল জ্বাল দেওয়ার  লাল ইটের চিমনিটা৷ চিমনির মাঝখানে যে বেশ বড় গর্তের মুখ এখানেই নীল জ্বাল দেওয়া হতো৷ একেবারে কাছে গিয়ে দেখলাম ইট গুলো সংস্কারের অভাবে খসে খসে পড়ছে৷ কয়েকবার বজ্রাঘাতে এমনিতেই চিমনির উপরের মাথাটা ভেঙে গেছে৷ প্রায় আড়াইশো বছর  আগের গরিব চাষীদের ওপর নীলকরদের নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী বহনকারী এই চিমনি আজ নিজেই জরাজীর্ণ, প্রায় ধ্বংসের পথে মৃতু্যর দিন গুনছে৷
অচিরেই এই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধটিকে পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ থেকে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত বলে আমার মনে হয়৷ চিমনির পাশ থেকে কিছুটা হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে উঁচু ঢিপি৷ এটাকে নীল পাহাড় বলা হতো৷ ঢিপির উপর দাঁডি়য়ে নিচের দিকে তাকালে দেখা যাবে সবুজ সমতল চাষযোগ্য জমি৷ হয়তো এই গোটা অঞ্চল জুডে়ই একসময় নীল চাষ করানো হতো৷ কোনভাবে মাথা তুলে দাঁডি়য়ে থাকা লাল চিমনি , নীল পাহাড় ও আশেপাশের অঞ্চল গুলি দেখতে দেখতে মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল দীনবন্ধু মিত্রের লেখা সেই বিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কিছু বিখ্যাত চরিত্র.. নবীনমাধব, তোরাপ, ক্ষেত্রমনি নীলকর সাহেব আইআই উড… সব চরিত্র যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে৷
আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল রাজবাডি়ডাঙ্গা যা রাজা কর্ণের প্রাসাদ নামে পরিচিত৷ এখানে খনন কার্যের ফলে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ কিছু কিছু মাটির তলা থেকে উঠে আসে৷ নিত্যান্ত সাদামাটা ছোটখাটো মফস্বল শহর আজকের কর্ণসুবর্ণ কেমন ছিল রাজা শশাঙ্কের সময় ভাবতে ভাবতে চলেছি৷ চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ  সপ্তম শতাব্দীতে কর্ণসুবর্ণ তে এসেছিলেন৷ তার গ্রন্থ ‘জিউ জি’ তে তদানীন্তন কর্ণসুবর্ণের একটা রূপরেখা দিয়েছেন৷ সেই সময় এই নগরীকে ‘কিলনসুফলন’ বলা হত৷ যথেষ্ট জনবহুল ছিল এই নগর৷ রাজ্যের পরিধি ছিল ৯০০ মাইল৷ এখানকার জমি ছিল উর্বর, আবহাওয়া ছিল মনোরম ,নাগরিকরা ছিলেন ধনী ও বিদ্বানুরাগী৷ নগরে বেশ কিছু বৌদ্ধ মঠ এবং মন্দির ছিল৷ হিউয়েন সাং আরো বলেন যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও প্রাচীন ও ভারতের সবথেকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার এই কর্ণসুবর্ণতেই বর্তমান ছিল৷ ধর্মপ্রচারে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ এসেছিলেন এই কর্ণসুবর্ণতে৷ এমনকি সম্রাট অশোক এসেছিলেন বলেও জানা যায় হিউ এন সাঙ এর বিবরণ থেকে৷ সম্রাট অশোক নির্মিত বেশ কিছু বৌদ্ধস্তূপের নিদর্শন পাওয়া যায় এখানে৷
বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা মহারাজা শশাঙ্কের রাজধানীর অলিগলিতে ঘুরছি…  মনে মনে ভাবছি এক সময় কত সমৃদ্ধশালী ছিল এই রাজধানী শহর, আভিজাত্য ও বৈভবে পরিপূর্ণ ছিল… যার চিহ্নমাত্র আজ আর নেই৷ মন বারে বারে ঘুরপাক খাচ্ছে ইতিহাসের অলিন্দে প্রায় ১৪০০ বছর আগের অতীতে মহারাজা শশাঙ্কের সময়কালে৷  শশাঙ্ক প্রথম জীবনে গুপ্ত বংশীয় এক রাজা মহাসেনগুপ্তের অধীনে সামন্ত ছিলেন৷ পরবর্তীতে গুপ্ত রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি গৌডে় এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই সময় উত্তর ভারতে যে পাঁচটি বৃহৎ রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল সেগুলো হলো মালব, থানেশ্বর, কনৌজ, কামরূপ ও গৌড়৷ এদের মধ্যে গৌডে়র রাজা শশাঙ্ক তার কূটনৈতিক বুদ্ধি ও রণকৌশল দ্বারা থানেশ্বরের রাজ্যবর্ধনকে পরাজিত ও নিহত করেন ও কনৌজের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন৷ রাজ্যবর্ধনের ভাই ও থানেশ্বরের রাজা হর্ষবর্ধন ভাতৃহত্যার বদলা নিতে বারবার গৌড় আক্রমণ করলেও শশাঙ্কের জীবদ্দশাতে গৌড় অধিকার করতে পারেনি৷ শশাঙ্কের রাজ্যের সীমানা উত্তর ও দক্ষিণ ওডি়ষ্যা, দন্ডভুক্তি বা মেদিনীপুর, এবং পশ্চিমে মগধ ও বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷  বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, রাঙ্গামাটি ছিল রাজা শশাঙ্কের রাজধানী প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ৷
আমাদের টোটো রাজবাডি়ডাঙ্গা কর্ণের প্রাসাদের গেটের সামনে থামতেই আমার চমক ভাঙলো৷ ইতিহাসের পথ পরিক্রমাতে আপাতত বিরতি দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকলাম৷ বিশাল জায়গা জুডে় মাঠ ঘিরে রাখা হয়েছে৷ সামনেই রয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ থেকে লাগানো নীল বোর্ড যেখানে ছোট্ট করে জায়গাটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে৷ স্থানীয়ভাবে এই জায়গাটিকে রাজা কর্ণের প্রাসাদ বলা হচ্ছে৷ জনশ্রুতি আছে যে মহাভারতের অঙ্গরাজের রাজা কর্ণের রাজত্বের রাজধানী ছিল এটা৷ প্রায় ৬০ বিঘা জায়গা জুডে় অবস্থিত এই  এলাকাটিতে  অনেক জায়গাতেই  উঁচু ঢিপি দেখলাম৷ ১৮৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এস আর দাস এখানে খনন কার্যশুরু করেন৷ প্রায় কুডি় বছর ধরে চলা এই খনন কার্যে মাটির তলা থেকে উঠে আসে বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যবহূত নানা সরঞ্জাম, তামা ও ব্রোঞ্জের  বিভিন্ন মূর্তি ও প্রচুর শিলমোহর৷ খননকার্যের ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের বাসভবন, থাকার বেশ কিছু কক্ষ, পড়ানোর জন্য শ্রেণিকক্ষ, স্নানের জন্য কুয়ো ইত্যাদি ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে৷ হিউয়েন সাঙের বর্ণনা অনুযায়ী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও আগে তৃতীয় বা চতুর্থ শতাব্দীর এই বৌদ্ধবিহারই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যার নাম রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার৷
ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম মাটির তলা থেকে উঠে আসা বৌদ্ধবিহারের ভগ্নাবশেষ৷ কোথাও চারদিকের প্রাচীরের অংশবিশেষ, কোথাও ইঁটের তৈরি গোলকৃতি বসার স্থান, আবার কোথাও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গা..  মনে হয় বৌদ্ধ-ভিক্ষুকদের থাকার কক্ষ ছিল৷ লম্বা প্রাচীরের একাংশ মাটির তলা থেকে উঠে এসেছে দেখে মনে হচ্ছে যেন রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারের চারপাশে বিশাল জায়গা জুডে় বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছিল৷ ইটের তৈরি উঁচু বসার জায়গা এক স্থানে দেখলাম৷ এই উচ্চ স্থান গুলিতে সম্ভবত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসে শিক্ষাদান করতেন বলে আমার মনে হল৷ খন৷নকার্যের ফলে যে ধ্বংসাবশেষ মাটির তলা থেকে উঠে এসেছে  সেগুলির স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী  একই রকম যার থেকে মনে করা হয় এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুডে় রক্তমৃত্তিকা  মহাবিহার ছিল৷ কিছুটা দূরে একটা প্রাচীন কুয়ো দেখতে পেলাম৷ লাল ইঁটের তৈরি এই কুয়োর নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হলাম৷ আজও গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে৷ ওর ভেতরে যে রিং লাগানো সেগুলো দেখলাম লোহার৷ অর্থাৎ তখন নির্মাণ কার্যে লোহার ব্যবহার ছিল৷
একটা জিনিস দেখে আমার খুব খারাপ লাগল৷ যে কুয়ো বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের স্নানের অথবা পানীয় জলের জন্য ব্যবহৃত হতো সেই কুয়োর মধ্যে আজ গড়াগডি় খাচ্ছে জলের বোতল, কাগজের চায়ের কাপ, সিগারেট প্যাকেট আরো কত কি৷ এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় যে উঁচু ঢিপি রয়েছে সেখানে খননকার্যশুরু করলে আরো কত ইতিহাস মাটির তলা থেকে উঁকি দেবে৷ কিন্ত্ত  দুর্ভাগ্যের বিষয় বহুদিন আগেই খননকার্যথেমে গেছে৷ ঢিপিগুলোতে এখন ছাগল চড়ছে৷ পুরো জায়গাটা রেলিং দিয়ে ঘেরা সেই রেলিংগুলিতে লোকে জামা কাপড় মিলছে৷ এত গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস আজ এইভাবে অবহেলায় তার গরিমা হারাচ্ছে ভাবতেও কষ্ট লাগছে৷
এরপর আমরা গেলাম এখান থেকে পাঁচ সাত মিনিট দূরে রাক্ষসীডাঙ্গায়৷ জায়গাটার এমন অদ্ভুত নাম কেন বোধগম্য হলো না৷ সত্যিই কি কোন রাক্ষসীর বসবাস ছিল নাকি!
সামনের বিরাট উঁচু জায়গা জঙ্গলে ভরে গেছে৷ স্থানীয় লোকেরা জানালো, এই জায়গাটিকেই রাক্ষসীডাঙ্গা বলে৷ এখানেও খননকার্যহয় ও ভগ্ন প্রাচীর, বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে৷ বেশ কিছুটা হেঁটে উঁচু জায়গায় উঠে দেখলাম জঙ্গলের মাঝে ভাঙ্গা দেওয়ার উঁকি মারছে৷ স্থানীয় মানুষদের কাছে জানলাম যে বহুদিন থেকেই জায়গাটা এভাবেই পডে় আছে৷ প্রথম প্রথম কিছুদিন খননকার্য হয়েছিল তারপর বহু বছর আর সরকার থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করা বা খননকার্যশুরু করার কোন উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি৷ উঁচু ঢিপি থেকে নেমে দেখলাম এক বহু প্রাচীন  ঝুডি়যুক্ত প্রায় অথর্ব বটগাছ.. বৃদ্ধ বটগাছের গায়ে কান পাতলে হয়তো শশাঙ্কের সময়ের ইতিহাসের অনেক কথাই জানা যাবে৷ এই বটগাছের পাশেই রয়েছে একটি মাজার৷ মজারটি কত পুরনো কেউ বলতে পারল না৷ এখানকার স্থানীয় লোকেরা তাদের জন্ম থেকেই দেখছে৷ মাজারের অপরদিকে তৈরি হয়েছে, ঈদগা৷ এটি অবশ্য বেশি পুরনো না , নতুন তৈরি হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়৷
দিন শেষ হয়ে আসছে, আমাদের এবার স্টেশনের দিকে যেতে হবে বাডি় ফেরার জন্য৷ অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু গায়ে মেখে আমরা টোটোতে উঠে বসলাম স্টেশনে যাবার জন্য৷ মন বিক্ষুব্ধ হয়ে রইল এটা ভেবে যে ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এবং যে জায়গা বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী সেই গৌরবান্বিত ঐতিহাসিক জায়গার প্রতি পুরাতত্ত্ব বিভাগের  এত উদাসীনতা কেন! এখনো যদি
রাজবাডি়ডাঙ্গার ঢিপি বা রাজা কর্ণের প্রাসাদ বলে অভিহিত ইতিহাসের ধুলো মাখা এই জায়গাটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, ও আবার খননকার্যশুরু করা না হয় তাহলে ইতিহাস ধীরে ধীরে অপশ্রীয়মান হয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে.. শশাঙ্কের রাজধানী শুধুমাত্র কাপড় মেলা  ও গরু ছাগল বিচরণের জায়গা হিসেবে রয়ে যাবে. আগামী প্রজন্ম হয়তো জানবেই না ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার বা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণর কথা৷ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মহারাজা শশাঙ্কের রাজধানীকে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম৷ মনের কোনে কোথাও ক্ষীন আশা রইল যে হয়তো আবার খননকার্যশুরু হবে.. মাটির তলায় চাপা পড়া ইতিহাসেরা বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান হবে… বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী তার যথাযথ মর্যাদা ফিরে পাবে৷