শুধু কি আরেক সমুদ্র সঙ্গে উপরি পাওনাও

যাঁরা সমুদ্র ভালোবাসেন, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ ঘুরতে এলে তাদের কাছে ডেস্টিনেশন সমুদ্র মানেই দীঘা৷ আর তাই একদিনের জন্য হলেও তাদের মন দীঘা বেড়িয়ে আসতে আনচান৷ কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরেও নয়৷ দীঘাকে ঘিরে আশপাশে গড়ে উঠেছে আরও কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র: মন্দারমণি, তাজপুর, শংকরপুর, মোহনা৷ পূর্ব মেদিনীপুরের এই পর্যটনকেন্দ্রের পাশেই আবার ওডিশার সমুদ্রসৈকত৷ তালসারি, চন্দনেশ্বর, বিচিত্রপুর, উদয়পুর পর্যটনকেন্দ্র৷
তবে সমুদ্রপ্রেমীদের জন্য জানিয়ে রাখি দীঘা বাদ দিয়েও এমন একটি জায়গা পশ্চিমবঙ্গের বুকেই আছে যেখানে সমুদ্র দর্শনের সুখ মিটিয়ে নিতে পারেন৷ সেই পর্যটন কেন্দ্রটি বকখালি৷ কলকাতার কাছেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন এলাকার সমুদ্রতীরবর্তী এক পর্যটনকেন্দ্র৷ দীঘার মতো এত কোলাহল, জাকজমক না থাকলেও সমুদ্রতট রূপে পরিপূর্ণর্‌৷ সময় থেকে অপূর্ব লাগে যখন জোয়ারের সময় জলএসে ভাসিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ তট৷
পূর্ণিমা হলে তো কথাই নয়৷ আবার ভাটার সময় নেমে গিয়ে দূরে চলে যায় সমুদ্র৷ জেগে ওঠে বিরাট সাদা বালুর তট৷ সূর্যের আলোয় রুপালি রং ছড়ায় তট৷ ঝিকমিক করে৷ আর তীরজুড়ে উড়ে বেড়ায় বক৷ বকখালি পর্যটনকেন্দ্রটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে৷ তট ধরে সমুদ্রের দিকে সোজা গেলেই বড় একটি খাল৷ ভাটার সময় সেই খালে হাঁটুরও কম জল থাকে আর জোয়ারের সময় কোমরসমান৷ জোয়ারের সময় এই জল পেরিয়ে সমুদ্রপাড়ে চলে যান পর্যটকেরা৷ আর ভাটার সময় জেগে ওঠে বিশাল সাদা বালুতট৷ তখন একেবারে পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়৷ সমুদ্রের ঢেউ দেখেন লোকজন৷ ডাব খান৷ চা–কফিও মেলে৷ আর বসার জন্য মেলে প্লাস্টিকের চেয়ার৷ ঘণ্টায় ১০ টাকা৷ সমুদ্রের তীরে চেয়ার নিয়ে পর্যটকদের জন্য বসে থাকেন স্থানীয় মহিলারা৷ জোয়ার–ভাটার তালে তালে কখনো এই চেয়ার তুলে নেওয়া হয় ওপরের দিকে, জল নেমে গেলে আবার তা নামিয়ে আনা হয় সমুদ্রতীরের কাছে৷
সন্ধ্যায় বকখালির আবার আরেক চেহারা, কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করে ওঠে সমুদ্রতট৷ সমুদ্রতীরজুড়ে নানা পসরা নিয়ে বসেন দোকানিরা৷ মেলে নানা সামুদ্রিক মাছ৷ হাঙর থেকে অক্টোপাসও৷ পর্যটকদের চাহিদামতো মাছ কেটে ভেজে দেন দোকানিরা৷ মেলে ঝালমুড়ি থেকে চা-কফি৷ অদূরেই সড়কজুড়ে নানা মানের হোটেল–রেস্তোরাঁ৷ স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে বিত্তবান—সবার পকেটের উপযোগী হোটেল-রেস্তোরাঁই আছে৷ সমুদ্রতটেই মিলছে ঘোড়া-উটে চড়ার সুবিধা৷ আর নানা চিত্তবিনোদনের সুযোগ৷ আছে শিশুদের নানা খেলাধুলার ব্যবস্থা৷ ঝাউবনে ঘেরা সাদা বালুর সমুদ্রতট থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দৃশ্যও অপূর্ব৷ এক দিনের সফরের জন্য সত্যিই আদর্শ এক সমুদ্রতট৷ বকখালির আশপাশেই পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য আছে হেনরি দ্বীপ, সাগর দ্বীপ, ফেডারিক দ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ দ্বীপ৷ ফ্রেজারগঞ্জ নামকরা মৎস্যবন্দর৷ এখানে মাছ কেনাবেচা হয়৷ এখান থেকে মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে সমুদ্রে পাড়ি জমান৷ ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার৷ বকখালির সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন৷ তাঁর নামেই ফ্রেজারগঞ্জ৷ একসময় এখানে তিনি বাসও করেছেন৷ তাঁর সেই বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে৷
তবে বকখালি গেলে কিন্তু বহু উপরি পাওনাও আছে৷ মেযন এখান থেকে ব্যাটারিচালিত স্কুটারে দেখে দেখে আসতে পারেন ওয়াচ টাওয়ার, হেনরি দ্বীপ, লাঙ্গরগঞ্জ বিচ, বেনফিস হারবার, ফ্রেজারগঞ্জ, কারগিল সি বিচ৷ খরচ ৪০০ টাকার আশে পাশে৷ এই কারগিল সি বিচের অদূরে জম্বু দ্বীপ, সৌসুন দ্বীপ, নদীপথে লঞ্চে করে যাওয়া যায়৷
বকখালিতে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক বনবিবির মন্দির৷ সমুদ্রতট থেকে ঝাউবনের পাশ ধরে হেঁটে গিয়ে দেখে নেওয়া যায়৷ টিনের ঘরের মন্দির৷ এই সমুদ্রতটের আরেক আকর্ষণ লাল কাঁকড়া৷ বালি ফুঁড়ে ওঠে আর মানুষের পা পড়লেই আবার বালিতে ঢুকে যায়৷ সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
বকখালি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ মহকুমার নামখানা থানায় অবস্থিত৷ কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার৷ কলকাতা থেকে সড়কপথেও যাওয়া যায়৷ হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী আগে ফেরিতে পার হতে হতো৷ সেতু হওয়ায় এখন সরাসরিই যাওয়া যায়৷ ট্রেনযোগে নামখানা হয়েও বকখালি যাওয়া যায়৷