হাথরস, ৯ জুলাই – হাথরসের পদপিষ্টের ঘটনার ৭ দিন পর উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দিল রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল। রিপোর্টে দুর্ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তির বয়ান রেকর্ড করে জমা দেওয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ সেখানে রয়েছে। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক একাধিক কারণও ছিল। তার মধ্যে প্রধান কারণ হল আয়োজকদের গাফিলতি।এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে জেলার ৬ জন সরকারি আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। পুলিশ তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, অনুষ্ঠানের আয়োজকরা ভিড়ের বিষয়টিকে গুরুত্বই দেননি।
এদিকে হাথরসের ঘটনার জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতির নেতৃত্বে এই ঘটনা তদন্ত হোক এই দাবি তুলে মামলা দায়ের হয়েছে শীর্ষ আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এই মামলার অনুমতি দিয়েছেন। আগামী শুক্রবার এই মামলার শুনানি হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টেরই এক আইনজীবী এই মামলা রুজু করেছেন। তিনি চান, পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে এই পদপিষ্টের ঘটনার তদন্ত হোক।
গত ২ জুলাই হাথরসে পদপিষ্ট হয়ে ১২১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। স্বঘোষিত ধর্মগুরু ‘ভোলে বাবা’র সৎসঙ্গ অনুষ্ঠানে ৮০,০০০ মানুষের সমাবেশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই সংখ্যা ২ লক্ষ ছাড়িয়ে প্রায় আড়াই লক্ষের কাছে চলে যায়। অনিয়িন্ত্রিত, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের তরফে সিট্ গঠন করা হয়।
ওই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার ছয় আধিকারিককে সাসপেন্ড করে। এছাড়াও সাসপেন্ড করা হয়েছে সার্কেল অফিসার, বিডিও, স্থানীয় থানার পুলিশকর্তা এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির দুই ভারপ্রাপ্ত কর্তাকেও। তাঁরা হলেন- এসডিএম রবীন্দ্র কুমার, সার্কেল অফিসার আনন্দ কুমার, স্টেশন হাউস অফিসার আশিস কুমার, তহসিলদার সুশীল কুমার, কচোড়ার চৌকি ইনচার্জ মনবীর সিং এবং পোড়ার চৌকি ইনচার্জ ব্রিজেশ পাণ্ডে। তারা যে রিপোর্ট দিয়েছে তার ভিত্তিতেই ৬ সরকারি আধিকারিক সাসপেন্ড হয়েছেন।
এই ৬ জন আধিকারিকের মধ্যে রয়েছেন সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট যিনি ভোলে বাবার প্রার্থনা সভার অনুমতি দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আছেন জেলার এসডিএম, যিনি অনুষ্ঠানস্থল পরিদর্শন করেন নি। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদেরও ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানাননি । অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বিরুদ্ধেও বড় অভিযোগ করা হয়েছে এই রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত ভিড় হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে আন্দাজ করেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ।
উল্লেখযোগ্য হল, সিট রিপোর্টে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সুরজ পাল ওরফে ‘ভোলে বাবা’ বা নারায়ণ সাকার হরির নামের উল্লেখ করা হয়নি। আর, এই কারণেই সিটের রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অথচ, এই ভোলে বাবাই হাথরসের ধর্মীয় অনুষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা তথা সংগঠক। তাঁর ওই অনুষ্ঠানেই ১২১ জন পদপিষ্ট হয়ে মারা যান। আহত হন অসংখ্য ভক্ত। সুরজ পাল অতীতেও এমন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেছেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম দিতেন সৎসঙ্গ।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, অনুষ্ঠানে ঢোকা এবং বেরনোর জন্য মাত্র ২টি দরজার ব্যবস্থা ছিল। আর ভিড় নিয়ন্ত্রণে মাত্র ৭০ জন পুলিশকর্মী ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান , যেখানে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে অতিরিক্ত বেশি সংখ্যক মানুষ ঢুকে পড়েছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের বা বেরানোর পথটিও ছিল অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ।
পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল দুর্ঘটনার দিন অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীদের সঙ্গে এবং ১৩০ জন প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে। তারপরই এই রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। ঘটনার পরপরই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই ঘটনার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সিট, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বলা সেই ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়নি।
এদিকে স্বঘোষিত ধর্মগুরু ‘ভোলে বাবা’র আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেলের অনুষ্ঠানকে বদনাম করতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে! ১০-১২ জন দুষ্কৃতী ভিড়ের মধ্যে বিষাক্ত স্প্রে ছড়িয়ে দিয়েছিল। আর সেই কারণেই ঘটে বিপর্যয়।ভোলে বাবার আইনজীবী এপি সিং-এর দাবি, ভোলে বাবার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্র করে ঘটনা ঘটানো হয়েছে।যদিও দুর্ঘটনার পর থেকেই ‘নিখোঁজ’ ‘ভোলে বাবা’। তবে তিনি ভিডিও বার্তা দিয়ে হাথরসের ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন। পুলিশের সঙ্গে তিনি সবরকম সহযোগিতা করবেন বলেও জানিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পাটনা আদালতে একটি মামলা রুজু হয়েছে।