সাংবাদিকতায় আলোর দিশা দেখাতে ‘দ্য স্টেটসম্যান রুরাল রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড’

প্রতি বছরের মতো এবছরও ‘দ্য স্টেটসম্যান’  ঘোষণা করল “স্টেটসম্যান রুরাল রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড ২০২৩” এবং পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতার জন্য কাশরো ইরানি পুরস্কার। ইংরেজি, হিন্দি, বা যে কোনও আঞ্চলিক ভাষায় লেখা, ২০২৩ সালে প্রকাশিত সাংবাদিকদের তদন্তমূলক প্রতিবেদন থেকে শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি স্টেটসম্যানের তরফে একটি বিশেষ উদ্যোগ ।

সোমবার কলামন্দিরের কলাকুঞ্জে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হয় জোয়ান বেজ রচিত ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর থিম সং-এর উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে।এদিন  অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন স্টেটসম্যান পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবীন্দ্র কুমার। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নিলোফার বাবায়কন। এছাড়াও এদিনের মঞ্চকে আলোকোজ্জ্বল করে তোলেন দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের সদস্য সচিব জন মাথাই, হুল্লদেক রিসাইক্লিং প্রাইভেট লিমিটেডের চিফ এক্সেকিটিভ নন্দন মল প্রমুখ।

একইসঙ্গে উল্লেখ্য, এদিনের অনুষ্ঠানকে মঞ্চস্থ করতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ম্যাকিনটশ বার্ন লিমিটেড,  ন্যাশনাল জুট বোর্ড, মাহিন্দ্র অ্যান্ড মাহিন্দ্র লিমিটেড,বর্ধমান আগ্রো প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড, টাইড ওয়াটার অয়েল কোম্পানি এবং দ্য ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অফ ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাগুলি।
এদিনের মঞ্চে উপস্থিত অতিথি অভ্যাগতদের সংবর্ধনা জানান স্টেটসম্যান পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবীন্দ্র কুমার। এদিন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে   স্টেটসম্যান রুরাল রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড, এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।  তিনি বলেন, মূলত এই পুরস্কার তাঁদের জন্য যাঁরা জাতীয় স্তরে তেমনভাবে স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু এই সম্মানীয় সাংবাদিকদের নিরলস প্রচেষ্টায় দেশের অনেক অজানা তথ্য সামনে এসেছে।


এই স্বীকৃতি শুধু সাংবাদিকদের উতকর্ষমূলক কাজকে স্বীকৃতি দেয় তাই নয়, পাশাপাশি এক্ষেত্রে সাংবাদিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে গ্রামের পটভুমিকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের বাস্তব ছবি। শুধু তাই নয়, কোনও একটি বিষয়ের উপর সাংবাদিকদের গভীর অনুসন্ধান ও তার সমাধানের পথে আলোর দিশা দেখাতেও উৎসাহিত করে থাকে এই পুরস্কার প্রদানের সম্মান।

স্টেটসম্যান রুরাল অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও রয়েছে কাশরো ইরানি পুরস্কার। সি আর ইরানি ফাউন্ডেশন, একটি অলাভজনক সংস্থা । এই সংস্থার তরফে সাংবাদিকতার মান উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয় কুশরো ইরানি পুরস্কার, যা মূলত পরিবেশগত সাংবাদিকতাকে উতসাহিত করে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই বার্ষিক পুরস্কার দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতাকে স্বীকৃতি দেয়।পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য কাশরো ইরানি পুরস্কারে এ বছর সম্মানিত করা হয়েছে সাংবাদিক উজমি আথারকে।

উজমি আথারের দুটি প্রবন্ধ সাংবাদিকতার মাপকাঠিতে শীর্ষ স্থান দখল করেছে।  জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এবং সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান নোনা জল  ও সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধির কারণে মানুষের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম তাঁর প্রতিবেদনের বিষয়।  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের নোনা জল কোচির কাছে চেলানামের মতো জায়গায় স্বাদু জলে মিশে তা অব্যবহারযোগ্য করে তুলছে । দৈনন্দিন এই জলের জন্য সংগ্রাম গ্রামের বাসিন্দাদের দুর্দশা বাড়িয়ে চলেছে। এছাড়াও ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকূল বরাবর বাস করেন। ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি, বন্যা এবং ক্ষয়ের সঙ্গেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে এঁদের।

স্টেটসম্যানের গ্রামীণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এবছর প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন অপর্ণা কার্তিকেয়ন তাঁর  পিপলস আর্কাইভ ফর রুরাল ইন্ডিয়া – প্রতিবেদনটির জন্য।

অপর্ণা কৃষকদের জীবনযাত্রাকে একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন তাদের উতপাদিত ফসলের মাধ্যমে। অপর্ণার সাংবাদিক মনন ও লেখনীতে ধরা পড়েছে দক্ষিণ ভারতের গ্রাম ও শহর জুড়ে কৃষি জগতের উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক নারী কৃষক, শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবনযাপন । তাঁর প্রতিবেদন এবং উপস্থাপন বিচারকদের মাপকাঠিতে সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রথাগত এই জীবিকা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তাও অনুসন্ধান করেছেন তিনি।

দ্বিতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন জ্যোতি যাদব। জ্যোতি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, যিনি কলম ধরেছেন শক্তিশালী অপরাধ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।  বিস্তারিত নথি পর্যালোচনা করে তাঁর চোখে ধরা পড়েছে চিকিতসক, দালাল,  রাজনীতিবিদদের আঁতাত। তাঁর প্রবন্ধ গুলির মধ্যে রয়েছে বিহারের দলিত নারীদের কথা, যাঁরা লোভী চিকিতসকদের চক্রের শিকার হয়ে তাঁদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারাচ্ছেন।

তৃতীয় পুরস্কারে সম্মানিত বিগনেশ। বিগনেশের প্রবন্ধের বিষয়  “উথুকুলি মাখন, যার ইতিহাস লুকিয়ে আছে তামিলনাড়ুর একটি গ্রামের। তাঁর প্রতিবেদন,  নিখোঁজ মহিষের ঘটনা এবং একটি ছোট শহরের পরিচয়” যেটি তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুরের এক গ্রামের একটি আকর্ষণীয় গল্প। “উথুকুলি মাখন” ছিল একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড, যা দূর-দূরান্তের মানুষদেরও আকর্ষণ করেছিল। উথুকুলির মাখন মালয়ালাম ভাষাভাষী ব্যবসায়ীদের মুগ্ধ করেছিল।

দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা  উথুকুলিতে আসতেন মাখন কিনতে, যা দীর্ঘ তিন মাস ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও তাজা থাকত। উথুকুলির মাখনের জনপ্রিয়তা ট্রাভাঙ্কোর, কোচিন এবং মালাবারের রাজ্যগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে, ‘৮০-র দশক থেকে গ্রামবাসীদের জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আসে। প্রথাগত কুটিরশিল্প ছেড়ে গ্রামবাসীরা বস্ত্র শিল্পে ঝুঁকে পড়ায় উথুকুলির মহিষের সংখ্যাও কমতে শুরু করে। তিরুপ্পুরে বস্ত্র শিল্পের প্রসারের পাশাপাশি উথুকুলির মাখন শিল্পকেও পুনরুজ্জীবিত করার নতুন প্রচেষ্টা চলছে।

এদিনের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয় যার বিষয়বস্তু ছিল ‘বিশ্বের নানা সমস্যার মুলে রয়েছে আয়ের অসঙ্গতি।’ এই আলোচনাসভা সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মনিদীপা ব্যানার্জী। বক্তা হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন আমলা তথা রাজ্যসভার সদস্য জহর সরকার। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণ প্রসাদ, কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন এবং ডক্টর শেষাদ্রি চারি।

সাংবাদিক মনিদীপা ব্যানার্জীর উল্লেখ করেন ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩-এর মধ্যে ভারতের শীর্ষ ১ শতাংশ আয় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই ১ শতাংশের হাতে কেন্দ্রীভূত রয়েছে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ। আলোচনায় উঠে আসে ভারতে আয় এবং সম্পদের বৈষম্যের বিষয়গুলি। বিশেষ বক্তাদের আলোচনায় উঠে এসেছে বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফল , যেখানে দেখা গেছে ভারতে ক্রমেই বাড়ছে বৈষম্য।

বিশ্বজুড়ে এই অতি সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্পদ এবং সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমানহারে বৈষম্য বৃদ্ধির বিষয়টি এদিনের বিতর্ক তথা আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বক্তা কৃষ্ণ প্রসাদ বলেন, প্রাচীনকাল থেকেই , বলা যায় ফরাসি দেশে  শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় এই ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ছিল এবং থাকবে। এর কারণ আমাদের সমাজের শিক্ষাগত বৈষম্য, জাতিগত বিভেদের মতো বিষয়গুলি। আলোচনায় উঠে আসে ক্ষুধার সূচকের নিরিখে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১ তম স্থানে।

বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে ধনী-গরিবের মধ্যে আয়ের সবথেকে বেশি বৈষম্য থাকা দেশগুলির মধ্যে নাম রয়েছে ভারতের। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের সেরা ধনী ১০ শতাংশের হাতে জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত রয়েছে।  তালিকার নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ দেশবাসীর মিলিত সম্পদের  পরিমান মাত্র ১৩ শতাংশ। এদিনের বক্তাদের আলোচনায় উঠে আসে বৈষম্যের নানা দিক ও তার কারণসমূহ।

দ্য স্টেটসম্যান আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা সমস্ত ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্যই উন্মুক্ত। এর উদ্দেশ্য হল গ্রামীণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উৎকর্ষতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং গ্রামীণ ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির গভীর পর্যালোচনা ও তার প্রচার। সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা, সঠিক তথ্য, পেশাদারিত্ব, এবং গুণাগুণের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনের মূল্যায়ন । বিশিষ্ট অতিথি এবং পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবীন্দ্র কুমার ও অন্যান্য কর্তাব্যক্তি ও কর্মীদের সহায়তায় সর্বাঙ্গীনভাবে সুন্দর হয়ে ওঠে এদিনের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।