হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট

মার্কিন শর্ট সেলার সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ভারতের শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি’র প্রধানের গোপন লগ্নির কথা ফাঁস করেছে। একটি বিশেষ কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে সেবির তদন্তের অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ। রিপোর্টে দাবি, সেবি প্রধানের পারিবারিক লগ্নি ছিল ওই সংস্থার বিদেশি বেনামি কোম্পানিতে। সেজনইে সেবি তদন্তে হাত গুটিয়ে রেখেছিল। হিন্ডেনবার্গের এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেবি প্রধানকে আড়াল করতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিজেপি। আর শাসক দলের এই সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীরা। বিজেপি দলের অন্দরেও এই নিয়ে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে বলে খবর।

নরেন্দ্র মোদির দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের নমুনা এখন আমাদের চোখের সামনে। যাকে দেওয়া হয়েছে অনিয়ম-বেনিয়মের ওপর নজরদারি করতে তিনি নিজেই অনিয়ম করে বসে আছেন। তারপর তাকেই দেওয়া হলো লগ্নি কারচুপির তদন্ত করতে। এরপর সেই তদন্তের ফল কী হতে পারে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মোদির অতি ঘনিষ্ঠ আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির দুর্গন্ধ এতই তীব্র যে তাকে আর চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ঠিক ছিদ্রপথে বেরিয়ে আসছে। এবার শুধু আদানি গোষ্ঠী নয়, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির প্রধান মাধবী পুরী বুচকে কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে আমেরিকার শেয়ার লগ্নি সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ।

হিন্ডেনবার্গ গত বছর জানুয়িারি মাসে তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছিল, কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠী তাদের বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারমূল্য অস্বাভাবিক বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ঘরে তুলেছিল। তার জোরে বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় উঠে আসে গৌতম আদানির নাম। একসময় মুকেশ আম্বানিকে পিছনে ফেলে ভারতের অন্যতম ধনী হয়ে ওঠেন তিনি। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর জালিয়াত ধরা পড়ায় তাদের শেয়ারে ধস নাম। আদানি গোষ্ঠীর মোট শেয়ারমূল্য দশ লক্ষ কোটি টাকারও নিচে নেমে যায়। দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। দাবি ওঠে এই জালিয়াতির তদন্তভার দেওয়া হোক সংসদীয় কমিটির হাতে। কিন্তু মোদি সরকার সংসদীয় তদন্তের বিরোধিতা করে সরাসরি আদানি গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। আদানিদের জালিয়াতি আড়াল করার জন্য দেশপ্রেমের সুড়সুড়ি দিয়ে খাড়া করে ভিন্ন বয়ান। বলা হয়, ভারতে লগ্নি ঠেকাতে এবং ভারতে অর্থনৈতিক বিকাশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এটা। দেশের বিরোধীরাও সেই ষড়যন্ত্রের সুরে গলা মেলাচ্ছে। সংসদীয় তদন্ত না করে তদন্তভার দেওয়া হয় সেবিকে। বিশেষজ্ঞ কমিটির তদন্তে ইতিমধ্যে আদানিদের নির্দোষ বলে দেওয়া হয়েছে। সেবির তদন্ত চলছে অনন্তকাল ধরে। তারা নাকি কোনও তথ্য-প্রমাণই জোগাড় করতে পারছে না। যেটুকু জোগাড় হয়েছে, তাতে আদানিদের বিরুদ্ধে কিছুই নেই।


কংগ্রেস বলেছে, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে বিজেপির বিরুদ্ধে তো কোনও কথাই বলা হয়নি। এনডিএ সরকারকেও অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়নি। এই রিপোর্টে শুধু একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপন আর্থিক লগ্নি নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে। তাহলে বিজেপি এত মরিয়া হয়ে এই রিপোর্টকে মিথ্যা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগল কেন? মহেশ জেঠমালানি থেকে শুরু করে রবিশঙ্কর প্রসাদ, অমিত মালব্য থেকে গৌরব ভাটিয়া, দলের মুখপাত্র এবং বরিষ্ঠ সাংসদরা কেন সেবি প্রধানকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন? হিন্ডনবার্গ রিপোর্টকে ভিত্তিহীন এবং প্রমাণহীন প্রতিপন্ন করতে বিজেপি দলবেঁধে মাঠে নেমে পেএছ. তারা এর পিছনে মোদি সরকারকে অপদস্ত করা এবং ভারতের আর্থিক সুস্থিতি ধ্বংসের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সন্ধান পেয়েছে। পাশাপাশি, বিজেপি আক্রমণ করেছে রাহুল গান্ধিকে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের প্রসঙ্গ টেনে রাহুল সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন দেশের শেয়ার বাজারকে।
কংগ্রেস তথা বিরোধীরাই যে প্রশ্ন তুলছে তা নয়, জানা যাচ্ছে বিজেপির অন্দরেও অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে। সেখানেও একই প্রশ্ন উঠছে, দল কেন উপযাচক হয়ে সেবি প্রধানকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। সেবির প্রধান পরিচালকের ব্যক্তিগত লগ্নি যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, উঠেছে এই প্রশ্নও। সেই অভিযোগ বিবৃতি দিয়ে অস্বীকার করেছেন সংস্থার প্রধান। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজেপি নিজেকে কেন জড়াচ্ছে। এর ফলে আরও বেশি করে বিরোধীদের অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। নিজস্ব কোনও স্বার্থের জন্যই বিজেপি এই পদক্ষেপ নিচ্ছে।

আদানি গোষ্ঠীর কারচুপি ও জালিয়াতির সহযোগী স্বয়ং সেবি প্রধান মাধবী বুচ এবং তাঁর স্বামী। আদানিদের বিদেশি ভুয়ো সংস্থায় লগ্নি করেছে বুচ পরিবার। সেই টাকা বিদেশি লগ্নি রূপে ঢুকেছে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে। এহেন বুচের নেতৃত্বে সেবি তদন্ত করছে আদানি গোষ্ঠীর জালিয়াতির। তদন্ত যে কেমন হবে, তা বুঝতে আর কারও অসুবিধা হবে না।