ইরান ও ইজরায়েলের যুদ্ধের কালো মেঘে ঢেকে আছে ভারতীয় অর্থনীতির বিপদ

ইরান ও ইজরায়েলের যুদ্ধের আবহে ভারতের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে কালো ছায়া। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি, অন্যদিকে দেশের খনিজ তেলের জোগানে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুই দেশের যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যেই ভারতের শেয়ার বাজারে এর কুপ্রভাব শুরু হয়ে গিয়েছে। হু হু করে নামছে শেয়ার বাজারের সূচক। বিশেষ করে অক্টোবর মাসের প্রথম তিনদিনের শেয়ার সূচকের পতন আতঙ্ক ধরিয়েছে লগ্নিকারীদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের শীর্ষ কর্তারা বিষয়টি নিয়ে তড়িঘড়ি আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন।

এই যুদ্ধের জেরে ভারতের মুদ্রাস্ফীতি হবে দ্রুত হারে। ফলে রিজার্ভ ব্যাংককে রেপো রেট কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হতে পারে। যা আরবিআই-এর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত গত ১ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে ইজরায়েলের ওপর ইরানের অতর্কিত হামলার জেরে ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। অন্তত ২০০ মিসাইল ইরানের সীমানা পেরিয়ে ইজরায়েলের আকাশে প্রবেশ করে। এই মিসাইলের ৯০ শতাংশ ব্যর্থ হয়েছে বলে ইজরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে চুপ করে বসে থাকবে না সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র ইজরায়েল। এমনই আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিছক হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ নন। অনেকে বিশ্বযুদ্ধেরও আশঙ্কা করছেন। কারণ, এই দুই দেশের পক্ষে ও বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্র। সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় হল, একদিকে ইজরায়েলের পক্ষে যেমন রয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানির মতো শক্তিধর রাষ্ট্র, ঠিক তেমনি, ইরানের পক্ষে রয়েছে রাশিয়ার মতো আগ্রাসী ও শক্তিশালী দেশ। ফলে যুদ্ধ শুরু হলে এই দুই দেশকে কেন্দ্র করে পৃথিবী জুড়ে দুটি অক্ষ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় অর্থনীতিতে বড় উদ্বেগের বিষয় হল, খনিজ তেল সরবরাহের অনিশ্চয়তা। কারণ, দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আসে বিদেশ থেকে। ইরানও বিশ্বের খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। যদিও আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইরান থেকে খনিজ তেল কেনে না দিল্লি। তবে এই যুদ্ধের ফলে ইজরায়েল যদি ইরানের তেলের ঘাটি একবার উড়িয়ে দেয়, তাহলে শুধুমাত্র ভারত নয়, গোটা পৃথিবীতে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। দ্রুত দুর্মূল্য হয়ে উঠবে এই ‘তরল সোনা’। কারণ অন্যান্য সরবরাহকারী দেশগুলির উৎপাদিত তেলের চাহিদা বেড়ে যাবে বিশ্বজুড়ে। ফলে বিশ্ব বাজারে তেল অগ্নিমূল্য হবে।

স্বাভাবিকভাবে প্রভাব পড়বে ভারতের অর্থনীতিতেও। এমনিতেই জ্বালানি তেল ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ, তেলের দাম একবার বৃদ্ধি পেলেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহন খরচও বেড়ে যাবে। বাড়বে রান্নার গ্যাসের দামও। হু হু করে মূল্যবৃদ্ধি হবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। দেশজুড়ে এক অকাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস শুরু হয়ে যাবে। ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধের আবহে ইতিমধ্যেই বেশ কিছুটা বেড়ে গিয়েছে তেলের দাম। গত ৪ অক্টোবর ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেল প্রতি দাম ৭৭ ডলার ছাড়িয়ে যায়। যা আগামীতে ৮৫ডলার ছোঁয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবিষয়ে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, বিশ্ববাজারে দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে তার প্রভাব পড়বে ঘরোয়া বাজারে। বাড়বে পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম।

যদিও অর্থনীতির এই ধাক্কা সামলাতে ভারতের হাতে যে কোনও ‘আয়রন ডোম’ নেই, এমন নয়। এমনিতেই ভারত খনিজ তেল আমদানির ক্ষেত্রে ইরানের ওপর নির্ভরশীল নয়। পাশাপাশি, তরল সোনা আমদানির ক্ষেত্রে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির ওপর ভারতের নির্ভরতা দ্রুত কমছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এই নির্ভরতা অনেকটাই কমেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আসে রাশিয়া থেকে।

এবিষয়ে উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আমেরিকা সহ পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলি পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি রাখে। সেই সময় থেকে যুদ্ধের খরচ ও অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে মোদির সরকারের স্মরণাপন্ন হন পুতিন। ভারতকে সস্তা দরে তেল বিক্রির প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। খনিজ তেলের গুরুত্ব বুঝে কেন্দ্রের মোদী সরকারও সেই প্রস্তাব পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো লুফে নেয়।

শুধু তাই নয়, বিশ্বের সর্বাধিক খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব। সেই দেশের সঙ্গে মোদী সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও তেল উৎপাদনকারী পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থায় প্রয়োজনে এইসব দেশগুলিকে বেশি পরিমাণে তেল সরবরাহের অনুরোধ জানাবে ভারত।